» » দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার
🕮

চন্দন

‘দেখে নাও বস! এই হল আমাদের বয়েজ হোস্টেল! আগামী চার বছর তোমাকে এখানেই রগড়াতে হবে।’ চন্দনকে বলল বিলু।

চন্দন ঘাড় তুলে পাঁচতলা বিল্ডিংটার দিকে তাকাল। তারপর কোলাপসিবল গেট টপকে ভেতরে ঢুকল।

‘আদতে বাড়িটা ছিল ইউ শেপের। ইউ এর মাথাটা ফাঁকা। পরে স্টুডেন্ট বাড়ল। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ ইউএর মাথায় মাত্রা টেনে এটাকে বর্গক্ষেত্র বানিয়ে দিয়েছে। মাত্রাওয়ালা উইংটার নাম অ্যানেক্স।’ চন্দনকে বোঝায় বিলু। ‘ওটাই নর্থ উইং। আমরা যে গেট দিয়ে ঢুকলাম সেটা সাউথ উইং। আমাদের বাঁদিকে ওয়েস্ট আর ডানদিকে ইস্ট উইং। চল, হোস্টেলের অফিসে চল। কশান মানি জমা দিতে হবে।’

গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোর ধরে বাঁদিকে এগোয় বিলু। সুটকেস হাতে চন্দন তার পিছন পিছন। তার মনে পড়ে যাচ্ছে ক্যান্টিনে সিনিয়রদের কাছে মুরগি হওয়ার কথা…

মুড়ির টিন আর সুটকেস ক্যান্টিনে রেখে ক্লাসে গিয়েছিল চন্দন। ক্লাসের শেষে ক্যান্টিনে ফিরে দেখল মুড়ির টিন বেদখল হয়ে গিয়েছে। জীবনদার থেকে পেঁয়াজ আর সরষের তেল জোগাড় করে, কোথা থেকে খোলায় ভাজা গরম বাদাম এনে মস্ত বড় একটা স্টিলের গামলায় মুড়ি মেখে তাই দিয়ে লাঞ্চ সারল সিনিয়ররা।

উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হওয়া গ্রামের ছেলের হাতে মুড়ির টিন—সবাই মিলে বেদম খোরাক করছিল। তখনই বৃন্দা এসে তাকে বাঁচিয়ে দিল। মেয়েটা নির্ঘাৎ কলকাতায় থাকে। তা না হলে ওরকম মোমের মতো ফরসা হয় না। আর কী স্মার্ট! ফট করে হাত ধরে টান মারল। তখনই চন্দনের প্যান্টের ভিতরে ফড়ফড়ানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস আজ জাঙিয়া পরা ছিল। এখানে আর নতুনগ্রামের মতো পপলিনের আন্ডার উইয়্যার পরে থাকা যাবে না।

কখনও কোনও মেয়ে তার গায়ে হাত দেয়নি। পরীক্ষার আগে মানসিক উত্তেজনা কমাতে বাথরুমে গিয়ে খারাপ কাজ করে নিত চন্দন। তখন চোখের সামনে ভেসে উঠত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কিংবা ক্যাটরিনা কাইফের মুখ। মমতাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েগুলোকে দেখে কখনও পছন্দ হয়নি চন্দনের। সবুজপেড়ে সাদা শাড়ি পরা পুঁটলি এক একটা। কিন্তু বৃন্দা? পুরো সোনাক্ষী সিনহা। মেয়েটার কথা ভাবতেই আবার শরীর শক্ত হয়ে গেল চন্দনের।

র‌্যাগিংপর্ব মেটার পরে বৃন্দা আপ্পুর সঙ্গে লেডিজ হোস্টেলের দিকে চলে গিয়েছিল। চন্দনকে পাকড়াও করেছিল রিপু। চন্দনের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক ভাট বকার পরেই বুঝে গেছে এ মাল তাদের দলের ছেলে। এর পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তার বদলে অন্য ফ্রেশারকে পাকড়ানো যাক। জীবনদার কাছ থেকে সুটকেস নিয়ে চন্দনের হাতে গছিয়ে বলেছিল, ‘ফোট রে! ছেড়ে দিলাম। রাতে হোস্টেলে দেখা হবে।’

সুটকেস নিয়ে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে টুকটুক করে বয়েজ হোস্টেলের দিকে আসছিল চন্দন, এমন সময় বিলু তাকে পাকড়াও করেছে। সব্যসাচীর ভাষণের সময় এই দাদাটার মুখ চিনে রেখেছিল চন্দন। র‌্যাগিং হলে হেল্প করবে এই আশ্বাসবাণী শুনে ওদের দেওয়া লিফলেট থেকে নিজের মোবাইলে যে চারটে নম্বর সেভ করেছে, তার মধ্যে বিলুর একটা।

ভোরবেলায় বাসে আর ট্রেনে মোবাইলটা ভালো করে দেখার ফুরসত পায়নি চন্দন। পরে দেখেছে। চায়নার মোবাইল। রংচঙে স্ক্রিন, লাউড স্পিকারের মতো আওয়াজ। এফএম রেডিয়ো, ব্লু টুথ, ক্যামেরা, টর্চ, অডিও এবং ভিডিও প্লেয়ার—কী নেই? চন্দন প্রথমে ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটা রিংটোন হিসেবে সেট করেছিল। এই গানটা বাজারে খুব চলছে। পরে মনে হল, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাই ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ গানটা রেখেছে। নরম, রোমান্টিক, মিষ্টি গান। কেউ বিরক্ত হবে না।

হোস্টেলের অফিসে একজন কর্মচারী বসে থাকলেও রুম অ্যালটের দায়িত্বে আছে মোর্চার সমর্থকরা। অর্থাৎ রিপুর চেলারা। বিলু অন্য দল হওয়া সত্ত্বেও এদের সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। অফিসে ঢুকে এক ছাত্রকে বলল, ‘এই লাটু, একে একটা রুম অ্যালট কর। রিপুদা পাঠাল।’

কর্মচারী ভদ্রলোক অ্যাড্রেস প্রূফের ফোটোকপি নিলেন, পাসপোর্ট সাইজের দুটো ছবি নিলেন, কশান মানি জমা নিলেন, ছ’মাসের হোস্টেল ভাড়া অ্যাডভান্স নিলেন। ভাড়া হাস্যকর রকমের কম। ছ’মাসের জন্য দুশো টাকা। কশান মানি পাঁচশো টাকা। সাতশো টাকার রসিদ নিয়ে লাটুর সামনে দাঁড়াল চন্দন। তার দিকে তাকিয়ে লাটু বলল, ‘নতুনগ্রামের মাল? বাবা কোন পার্টি করে?’

লাটুকে মাপল চন্দন। সারাদিনের অভিজ্ঞতায় সে একটা জিনিস বুঝেছে। শহর আর গ্রামের লোকেদের মধ্যে কোনও তফাত নেই। দু’দল দু’রকমের বদমায়েশ। ডিল করার টেকনিকটা তাই আলাদা। গম্ভীর মুখে চন্দন বলল, ‘আমার বাবা পঞ্চায়েত প্রধান।’

‘গুড! তোকে একশো পঁচিশ নম্বর রুমে অ্যালট করলাম। আমার ঘরে। চার তলার একদম লাস্ট ঘর। ইস্ট উইং। ঘর থেকে বেলেঘাটা মেন রোড দেখতে পাবি। যা।’

থতমতো খেয়ে চন্দন বলল, ‘চাবি?’

পাশ থেকে বিলু বলল, ‘আমার সঙ্গে চল। তোকে পৌঁছে দেব।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিলু বলল, ‘তুই বাঘের ঘরে ঢুকলি।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল চন্দন।

‘ওটা ”হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি”-র অফিস ঘর। ”হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি” বল বা ”স্টুডেন্টস ইউনিয়ন” বল, সব এখন মোচা পার্টির দখলে। ওরা ইচ্ছেমতো রুম অ্যালট করে, রুম থেকে ছেলেপুলে ভাগিয়ে দেয়, মারধোর করে।’

‘মারধোর করে?’

‘হ্যাঁ। অ্যানেক্স ব্লকে ছেঁদোরা ব্লু ফিল্ম দেখছিল…’

‘ছেঁদো আবার কী? মোচা তো জানি…’

চন্দনের কথা শুনে মুচকি হাসে বিলুদা। ‘জাতীয়তাবাদী পার্টির স্টুডেন্ট উইঙের নাম ”ছাত্রদল”। ওটাকেইআদর করে ‘ছেঁদো পার্টি’ বলা হয়।’

‘এটা নতুন শিখলাম। তারপর?’

‘একদিন দশ-বারোজন ”ছেঁদো” মিলে একসঙ্গে রুমে বসে ব্লু ফিল্ম দেখছিল। তখন রিপু আর লাটু গিয়ে বেধড়ক ঠেঙিয়েছিল’।

বিলুর কথা শুনে চন্দন চুপ করে রইল। তিনতলায় পৌঁছে বিলুদা বলল, ‘কীরে, তোর কিছু বলার নেই?’

চন্দন একটানা সিঁড়ি চড়ে হাঁফাচ্ছে। সুটকেস নামিয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘মারধোর করাটা অত্যন্ত অন্যায়। কিন্তু একসঙ্গে বসে ব্লু ফিল্ম দেখাটা কীরকমের নোংরামো?’

‘ব্লু ফিল্ম দেখা নিয়ে তোর রিজার্ভেশান আছে নাকি?’ ত্যারছা চোখে তাকায় বিলু।

‘যতই গ্রামে থাকি না কেন, যতই উচ্চমাধ্যমিক ফার্স্ট হই না কেন, যতই চাষার ছেলে হই না কেন বিলুদা, এটা দু’হাজার দশ সাল। আমার নিজের কম্পিউটার না থাকলেও বন্ধুবান্ধবের আছে। ইন্টারনেটের কারণে ব্লু-ফিল্ম এখন জল ভাত। আমি গুরুমশাইগিরি ফলাচ্ছি না। আমার বক্তব্য, ব্লু ফিল্ম দেখে উত্তেজনা হলে ওরা কী করবে?’

‘আমরা সবাই যা করি।’

‘সেটা কোথায় করবে?’

‘ওই ঘরের কোনেই চাদর দিয়ে ঢাকা একটা কিউবিকল করা ছিল।’

‘তাহলে রিপুদা ওদের পিটিয়ে বেশ করেছে।’ বিরক্ত মুখে বলে চন্দন। বিলু চন্দনের পিঠ থাবড়ে বলে, ‘এর মধ্যে রিপুর ফ্যান হয়ে গেলি? একটু সামলে চল। একশো পঁচিশ নম্বরে তোর রুমমেট কারা হবে জানিস?’

‘কারা?’

‘খোদ রিপু আর লাটু। এই হোস্টেলের প্রতি ঘরে চারটে করে বেড আছে। একশো পঁচিশ নম্বর ঘরটা বোর্ডার্স কমিটির অফিসঘর। দিনরাত্তির মিটিং আর পোস্টার লেখা হয়। যে পারে, হুটহাট ঢুকে পড়ে। পড়াশুনার পরিবেশ নেই। পারলে কিছুদিন বাদে রুমটা চেঞ্জ করে নিস।’

চারতলার করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন দেখল লম্বা টানা বারান্দা বরাবর পরপর ঘর। ঘরের দরজার মাথায় রুম নম্বর লেখা। বেশির ভাগ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার দুপাশে দুটো জানলা। খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের চারকোণে চারটে খাট রাখা রয়েছে। প্রতি খাটের পাশে একটা করে টেবিল, চেয়ার আর কাবার্ড। কোনও কোনও ঘরে এক্সট্রা ফারনিচার বলতে আলমারি। ঘরগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছেলেরা ঘরে বসে পড়ছে, আড্ডা মারছে অথবা ল্যাপটপ ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এইসব দেখতে দেখতে চন্দন বলল, ‘রুম চেঞ্জ করে কোন ঘরে যাব? প্রোগ্রেসিভ মেডিকাল ফোরামের ঘরে? যেখানে তুমি আর সব্যসাচীদা রুমমেট?’

চন্দনের মাথায় গাঁট্টা মেরে বিলু বলল, ‘খুব বেঁড়ে পাকা হয়েছিস। আমি আর সব্যসাচী একরুমে থাকি না। সব্যসাচী অ্যানেক্স ব্লকে থাকে। ওর রুমমেট নর্থ ইস্টের কয়েকটা ছেলে। আমি দোতলায় থাকি। রুম নম্বর থার্টি সেভেন। পরে কখনও ঘুরে যাস। আর এই নে, তোর রুম।’

একশো পঁচিশের দরজা হাঁ করে খোলা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখে চন্দনের কান্না পেয়ে গেল। এই ঘরে তাকে থাকতে হবে? আগামী চার বছর?

অন্য ঘরের মতোই এ ঘরের চার কোণে চারটে খাট। কিন্তু ঘরে কোনও টেবিল নেই। নেই কোনও কাবার্ড। টেবিল আর কাবার্ডের অনুপস্থিতিতে যে ফাঁকা জায়গাটা তৈরি হয়েছে, সেখানে গোটাদশেক মোল্ডেড প্লাস্টিকের লালরঙা চেয়ার মিটিং করার জন্য রাখা হয়েছে। ঘরের চারটে বিছানার মধ্যে যে দুটোতে গদি এবং চাদর পাতা রয়েছে। বাকি দুটো খাটে গদি নেই। খটখটে কাঠের তক্তপোশের ওপরে ডাঁই করে রাখা রয়েছে মোটামোটা ডাক্তারির বই আর পার্টির মুখপত্র ‘জনমত’-এর দিস্তে। দেওয়ালে লেনিন, মার্কস ও স্ট্যালিনের ছবি টাঙানো। হালকা নীল রঙের দেওয়ালে লাল রঙে বড় বড় হরফে লেখা, ‘তুমি আলো আমি আধাঁরের পথ ধরে, আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।’ এক কোণে প্রচুর লাঠি রাখা রয়েছে। লাঠির মাথায় লাল ফ্ল্যাগ লটকানো।

ঘরে বসে দুটো ছেলে ল্যাপটপে কীসব করছিল। চন্দন আর বিলুকে ঢুকতে দেখে একটা ছেলে বলল, ‘কী ব্যাপার বিলুদা?’

‘এর নাম চন্দন সরকার। লাটু এই রুমটা ওর নামে অ্যালট করেছে।’ বলল বিলু।

‘চন্দন সরকার? যে এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে?’ ভুরু নাচাল ছেলেটি, ‘ওয়েলকাম বস। আমার নাম সুব্রত সরকার। আমি এই ফ্লোরের রিপ্রেজেনটেটিভ। এই ফ্লোরে কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের নিয়ম চলে না। শুধু সুব্রত সরকারের নিয়ম চলে।’

সুব্রতর কথা বলার ধরনে মিঠুন চক্রবর্তীর ছাপ পরিষ্কার। চন্দন হেসে ফেলে বলল, ‘সরকার বাহাদুর, রুমে পা রাখতে পারি?’

‘ঢুকে পড় বে। বেশি ন্যাকামো করিস না।’ কিবোর্ডে খটখট করতে করতে পাশ থেকে বলল অন্য ছেলেটি, ‘আমার নাম বান্টি গাঙ্গুলি। আমরা দুজনেই সেকেন্ড ইয়ার। কাজেই তোকে র‌্যাগ করার হক আমাদের আছে। কিন্তু আমরা সেটা করব না। কেন না ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি থেকে তোকে নিয়ে লেখা মেলটা এক্ষুনি এল। এই দ্যাখ।’ ল্যাপটপ খাটের ওপরে রেখে চন্দনকে ইশারায় ডাকে বান্টি। সুটকেস একপাশে রেখে চন্দন পিছন ফিরে তাকায়। বিলু আর নেই। নিজের কাজে চলে গেছে।

টুকটুক করে এগিয়ে সুব্রত আর বান্টির পাশে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকায় চন্দন। সুব্রত সরকারের মেলবক্সে খোলা রয়েছে। ইনবক্সের প্রথম মেলের সাবজেক্ট ম্যাটার হল, ‘সারপ্রাইজ গিফট ফর চন্দন সরকার’।

‘নিজেই পড়।’ ল্যাপটপ চন্দনের দিকে এগিয়ে দেয় বান্টি। চন্দন মেলের ওপরে কার্সার নিয়ে গিয়ে ডাবল ক্লিক করে। খুলে যায়, বৈদ্যুতিন চিঠি। চিঠির বক্তব্য হল—

শ্রী সুব্রত সরকার,

ফ্লোর রিপ্রেজেনটেটিভ,

হোস্টেল বোর্ডাস কমিটি,

ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।

মান্যবরেষু,

প্রতিবারের মতো এবারও আমরা রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির পক্ষ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম স্থানাধিকারিকে একটি উপহার দিতে আগ্রহী। বিশেষ সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে চন্দন সরকার, যিনি এবারের উপহারটি পাচ্ছেন, আপনাদের কলেজে ভরতি হবেন এবং আপনাদের পরিচালিত হোস্টেলে বসবাস করবেন। আমরা তাই অন্যান্য বারের প্রথা অনুযায়ী কলকাতা শহরের বিখ্যাত নগরনটি মিস কামিনীকে পাঠিয়ে দিলাম। শ্রী চন্দন সরকার একটি সন্ধ্যা মিস কামিনীর সাহচর্যে কাটান, এই আমাদের বাসনা।

ধন্যবাদান্তে,

রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির পক্ষে,

গোষ্ঠচাঁদ।

চিঠি পড়ে অবাক হয়ে চন্দন বান্টির দিকে তাকাল। এরা মশকরা করছে নাকি? গ্রামের ছেলে বলে সে কি ছ্যাবলামোটা ধরতে পারছে না? মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ঠিক হয়েছে সে কোন ফ্লোরের কোন রুমে থাকবে। এর মধ্যেই রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির পক্ষে গোষ্ঠচাঁদ এই মেল সুব্রত সরকারকে করে দিল? ঢপবাজির একটা সীমা থাকা উচিত।

‘তুই কী ভাবছিস আমি জানি।’ গম্ভীর মুখে বান্টি বলে, ‘আসলে গত তিন বছর ধরেই উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয় ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হয়ে প্রথমে একশো পঁচিশে উঠেছে। মিস কামিনীর তাই রুটিনটা জানা। উনি একশো চব্বিশে অপেক্ষা করছেন। তুই যা।’

এইবারে চন্দন ধ্বস খেল। মিনমিন করে বলল, ‘বয়েজ হোস্টেলে তো মেয়েরা অ্যালাওড নয়।’

‘এই হল গ্রামের ছেলেদের সমস্যা। রামচাঁদ শ্যামচাঁদ গ্রুপ অব কোম্পানিজের নাম শুনেছিস? ওদের ইয়ারলি টার্নওভার জানিস? ওদের ফিল্যানথ্রপি নিয়ে কোনও ধারণা আছে? মিস কামিনীর বিজি স্কেজুল নিয়ে কোনও ধারণা আছে?’

‘স্কেজুল মানে কী?’

‘এটা একটা ইংরিজি শব্দ, ফার্স্ট বয়!’ চন্দনের কান মুলে বলে সুব্রত, ‘যাকে তোরা শিডিউল বলে থাকিস। এনিওয়ে, মিস কামিনী ভীষণ ব্যস্ত। ফালতু ঝামেলা করিস না। পাশের ঘরে যা।’ একশো চব্বিশ নম্বর ঘরের দিকে আঙুল দেখায় বান্টি।

এইবারে চন্দন সামান্য ঘাবড়াল। মিস কামিনীটা না হয় এদের ঢপ। কিন্তু কোনও মেয়েকে পাশের ঘরে এনে থাকলে বিরাট বিপদের কথা। বাংলা সিরিয়ালে চন্দন দেখেছে যে মোবাইলে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও তুলে এমএমএস ক্লিপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় সব মোবাইলে। সেখান থেকে ইউটিউবে। সেখান থেকে খবরের কাগজে। তখন কী হবে? ক্যান্টিনের র‌্যাগিং-এ বৃন্দা বাঁচিয়ে দিয়েছে। হোস্টেলের র‌্যাগিং-এ কে বাঁচাবে? অশালীন আচরণের জন্য হাজতবাস কপালে নাচছে। ডাক্তারি পড়াও বন্ধ হয়ে যাবে।

‘কী রে? যা!’ হুকুম করছে সুব্রত।

চন্দন আর একবার লড়াই দিল। ক্যাজুয়ালি বলল, ‘তোমরা বলছ যখন তখন ওঁর সঙ্গে একবার আলাপ করে আসি।’

একশো পঁচিশ নম্বর ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের সামনে দাঁড়াল সে। ঘরের দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ। বাইরে থেকে দরজায় নক করে চন্দন। সামান্য প্রতীক্ষার পরে ভিতর থেকে ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। যেন ঘুঙুর পরে কেউ হাঁটছে। রিনরিনে মহিলা কণ্ঠ প্রশ্ন করে, ‘কে?’

ভয়ের চোটে হৃৎপিণ্ড ব্যাঙের মতো লাফিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে। হাত-পা মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা। অ্যাবাউট টার্ন হতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল চন্দন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি চন্দন সরকার।’ তার মনে ক্ষীণ আশা, দরজা না খুলে ওপ্রান্ত থেকে কোনও ছেলে মেয়েলি গলায় আলাপ চালিয়ে যাবে।

‘আসুন। আমি মিস কামিনী।’ দরজার একপাল্লা খুলে উঁকি মেরেছে শাড়ি পরা একটি মেয়ে। রংচঙে শাড়ি, ঝকমকে ব্লাউজ, একগলা ঘোমটা, একহাত চুড়ি, মেয়েলি সুগন্ধ…

চন্দন এক দৌড়ে একশো পঁচিশে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘বান্টিদা, সুব্রতদা, আমি পারব না।’

‘কী পারবি না?’ টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেটের প্যাকেট বার করতে করতে বলল সুব্রত।

‘ওই ঘরে যেতে পারব না। প্লিজ। তুমি আমাকে অন্য কিছু করতে বলো।’ কেঁদে ফেলেছে চন্দন।

‘চাষার ছেলে একেই বলে,’ রাগরাগ চোখে বান্টি বলে, ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ এবং রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির ঐতিহ্য নষ্ট করছিস তুই। এবার কিন্তু র‌্যাগড হতে হবে। সেটা সামলাতে পারবি তো?’

‘যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব। শুধু ওই ঘরে যেতে বোলো না।’

‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ঐতিহ্য ভঙ্গ করার শাস্তি সাংঘাতিক। প্রিন্সিপালকে জানালে তোকে রাস্টিকেট করতে পারেন।’ ঘাড় বেঁকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বান্টি, ‘আমি এখন মিস কামিনীকে সোনাগাছি ফেরত পাঠাই কী বলে? ওঁর ঘণ্টা পিছু চার্জ দশ হাজার টাকা। দু-ঘণ্টার জন্য এসেছেন। কাজ না করে উনি রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির থেকে টাকা নেবেন না। আর গোষ্ঠচাঁদ যদি জানতে পারেন যে ওঁর বাপ-ঠাকুরদার টাকা এইভাবে নষ্ট হয়েছে, তাহলে আমাদের ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে আমাদের হাসপাতালের যে কটা ইউনিট চলে তার থেকে উনি নাম তুলে নেবেন।’

‘সিটি স্ক্যান, ইউএসজি, এমআরআই বন্ধ হয়ে যাবে।’ নতুন সিগারেটের প্যাকেটের ফয়েল ছিঁড়ছে সুব্রত।

‘কত গরিব পেশেন্ট মারা যাবে!’ কপাল চাপড়াচ্ছে বান্টি।

‘আমি ব্যাপারটা ম্যানেজ করব।’ চন্দনের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলে সুব্রত, ‘কিন্তু তোকে শাস্তি পেতে হবে। তুই এই সিগারেটের প্যাকেটটা আমাদের সামনে শেষ কর।’ সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই চন্দনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে।

‘আমি সিগারেট খাই না।’ চোখের জল মুছে বলে চন্দন।

‘দুটো অপশন,’ চন্দনের নাকের ডগায় দু’আঙুল নেড়ে বলে সুব্রত, ‘হয় দশটা সিগারেট চেইন স্মোক করবি। অথবা আগামী দু’ঘন্টা মিস কামিনীর সঙ্গে কাটাবি। চয়েস ইজ ইয়োর্স।’

‘আম… আমি পারব না…’ একশো পঁচিশের দরজার দিকে তাকিয়ে বলে চন্দন।

‘গালে মারব এক থাবড়া!’ বাঘডাকা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে সুব্রত। ‘খা শালা। খা!’ প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে চন্দনের ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দেয় সে। দেশলাই জ্বালিয়ে আগুনের শিখা সিগারেটের তলায় ধরে বলে, ‘ইনহেল কর বাঞ্চোত!’

কত লোক তো সিগারেট খায়। নিজেকে বোঝায় চন্দন। তারা প্রত্যেকেই কোনও একদিন শুরু করেছিল। তারও আজকে শুরু হল। এইভাবে নেওয়া যাক এই র‌্যাগিংকে। ধোঁয়া মুখে নিয়ে নাক দিয়ে বার করে দিলেই হল। তাহলে ফুসফুসে ঢুকবে না। এইটুকু পারবে না? পরপর দশবার? তাহলেই ঝামেলা থেকে মুক্তি! মুখের সিগারেট দাঁত দিয়ে চেপে হালকা প্রশ্বাস নেয় সে। ওমনি কুৎসিত, তিতকুটে, কষা স্বাদে মুখ ভরে যায়। কাঁপতে থাকা হাতে সিগারেট ধরে চন্দন। যে ভাবে অন্যরা সিগারেট ধরে, সেই কায়দায় তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে সিগারেট রেখে খকখক করে কাশতে থাকে।

‘আস্তে আস্তে খা। চাপ নিস না।’ সান্ত্বনা দিচ্ছে বান্টি। ‘আমাদের হাতে এখন অনেক সময় আছে।’

দু’আঙুল আবার ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে আসে চন্দন। এখনও তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তার কতটা নিকোটিনের জ্বালা আর কতটা অপমানের, বোঝা যাচ্ছে না।

পাঁচ মিনিটের ধস্তাধস্তিতে প্রথম সিগারেট শেষ হল। প্রকৃত চেইন স্মোকিং এর কায়দায় সিগারেট থেকে সিগারেট ধরাতে হল চন্দনকে। এখন আর অতটা খারাপ লাগছে না। দু’আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরাও রপ্ত হয়ে গেছে। ডান হাতের বদলে বাঁ হাতে সিগারেট নিয়ে টান মারে সে। বান্টি হাততালি দিয়ে বলে, ‘কেয়াবাত!’

তৃতীয় সিগারেটটা খারাপ লাগল না। সিগারেট নিয়ে লোকে এত বাড়াবাড়ি কেন করে? সে তো ইনহেল করছে না। কায়দা করে মুখের মধ্যে ধোঁয়া রেখে নাক দিয়ে বার করে দিচ্ছে। এইভাবেই আগামী সাতটা সিগারেট পোড়াতে পারবে না? আলবাত পারবে!

চতুর্থ সিগারেট ধরানোর সময় থেকে মাথাটা হালকা হল। টেনশান কমে গেছে। সুব্রত আর বান্টিকে আর তেমন খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, মিস কামিনীর সঙ্গে দেখা না করে সে সত্যিই অন্যায় করেছে। ঐতিহ্যভঙ্গের শাস্তি তার প্রাপ্য।

পঞ্চম সিগারেটের মাঝামাঝি সময় থেকে চন্দনের মাথা ঘুরতে শুরু করল। সারা শরীর জুড়ে ঝিমঝিম ভাব, চোখের সামনে লাল নীল বল নাচছে, জিভ শুকিয়ে আসছে, বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে, গা গরম। তাও আরও দুটো সিগারেট শেষ করল চন্দন।

অষ্টম সিগারেটে প্রথম টান মারতেই চন্দনের চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে এল। বসে থাকা অবস্থা থেকে মেঝেতে সটান পড়ে গেল সে। মেঝে আর মাথার খুলির সংঘর্ষের ফলে ঠনাত করে আওয়াজ হল। তবে চন্দন আওয়াজ শুনতে পায়নি। সে অজ্ঞান।

আওয়াজ শুনে একশো চব্বিশ থেকে দৌড়ে বেরোয় টিনটিন। শাড়ি খুলে ফেললেও এখনও ব্লাউজ পরে রয়েছে। মাথায় বিনুনির উইগ, হাতে একগাছা চুড়ি। বিরক্ত হয়ে সুব্রত আর বান্টিকে বলল, ‘লাটুর মাথায় কোনওদিনও বুদ্ধি হবে না। ছোকরাটাকে কাঠি করতে গিয়ে তোদের দিয়ে মেল চালাচালি করাল, আমাকে শাড়ি পরাল। কতখানি সময় নষ্ট বল তো? ফ্রেশার্স ওয়েলকামে আমাদের নাটকের ড্রেস রিহার্সালের জন্য আবার শাড়ি আয়রন করতে হবে।’

‘চল। আবার রিহার্সাল শুরু করি। ফ্রেশার্সের দিন সেকেন্ড ইয়ারের তরফ থেকে ‘ফিফটি ফিফটি’ নামের এই ওয়ান অ্যাক্ট প্লে-টা নামাতেই হবে।’ চন্দনকে পাঁজাকোলা করে খাটে শুইয়ে, হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে সুব্রত বলে। ‘বাইজির পোশাকে টিনটিনের মুজরা এই নাটকের প্রধান অ্যাট্রাকশান। নাটকের শেষে সবাই দেখবে নায়িকা আসলে ছেলে। কী আইডিয়া মাইরি!’

‘বেশি ভাটাস না। আধঘণ্টার নাটকে দু’বার ড্রেস চেঞ্জ। আমি শালা পাগল হয়ে যাচ্ছি। থেকে থেকেই ডায়ালগ ভুলে যাচ্ছি। কেন যে মরতে নাটকটা লিখেছিলাম।’ গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরোয় টিনটিন। পিছন পিছন সুব্রত।

বান্টি জাগ থেকে জল নিয়ে চন্দনের মুখে ঝাপটা দেয়। ছেলেটার এখনও হুঁশ এল না কেন? চন্দনকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের তলায় শুইয়ে দেবে নাকি? কনফিউজড হয়ে যায় সে। হঠাৎই মোবাইলের ঝনঝন। চন্দনকে ছেড়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। সবুজ বোতাম টিপে বলে, ‘বলো আপ্পুদি।’

‘মিস্টার অ্যান্ড মিস আইএমসির পাঁচটা ছেলে ক্যান্ডিডেট বেছেছিস? না বাচ্চা ছেলেগুলোর পায়ুপ্রহারে ব্যস্ত?’ আপ্পু ঝাঁঝিয়ে ওঠে লেডিজ হোস্টেল থেকে। ‘ফ্রেশার্স ওয়েলকাম আর মাত্র সাতদিন বাকি। আজ এগারো তারিখ। শনিবার। সামনের শনিবার প্রোগ্রাম। ফার্স্ট ইয়ারের দশজন ছেলে মেয়ে নিয়ে এই বিউটি কনটেস্ট আইএমসির ফ্রেশার্স ওয়েলকামের ইনটিগ্রাল পার্ট। এটা যেন কেঁচে না যায়।’

‘আজই তো ছেলেগুলো হোস্টেলে ঢুকল। এখনও সবাইকে ছানবিন করার সময় পাইনি।’ আমতা আমতা করে বান্টি। থার্ড ইয়ারের দিদিটিকে সে বিলক্ষণ সমঝে চলে।

‘আমি দুটো মেয়ে সিলেক্ট করেছি। কালকের মধ্যে আরও তিনজন বাছব। হোস্টেলাইট আর ডে স্কলার মিলিয়ে পাঁচটা ছেলে জোগাড় কর। পাঁচ দশের ওপরে হাইট, স্মার্ট, ইংরিজি বলতে পারে, ভালো চেহারা। পাবি না এমন পাঁচটা ছেলে?’

‘আমার সামনে এখন যে হোস্টেলাইট রয়েছে তার হাইট পাঁচ দুই। ইংরিজি জানে না। চাষার ছেলে চলবে?’

‘ভ্যাট!’ ফোন কেটে দিয়েছে আপ্পু। শ্রাগ করে বান্টি একশো পঁচিশ থেকে বেরিয়ে যায়। চন্দন এখনও অজ্ঞান।