ঐতিহাসিক সমগ্র
সিরাজের বিজয় অভিযান : সাত
পুত্রহীন আলিবর্দির তিন কন্যার সঙ্গে তাঁর তিন ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহ হয়েছিল। মধ্যম ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ আহম্মদ পেয়েছিলেন পূর্ণিয়ায় নবাবি করবার ভার। তিনি পরলোক গমন করবার পর তাঁর ছেলে সওকত জং হলেন পূর্ণিয়ার নবাব (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে)।
সেই সময়েই সিরাজ করেন মাতামহের সিংহাসনে আরোহণ।
ছোট মাসির ছেলে সিরাজ তাঁর চেয়ে বয়োকনিষ্ঠ হয়েও হবেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার সর্বময় কর্তা, এটা সওকতের মোটেই ভালো লাগল না। তাঁর ধারণা হল আলিবর্দির সিংহাসনের উপরে তাঁরই দাবি সর্বাগ্রে। তার উপর বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর তখন থেকেই সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছিলেন। তিনি সওকতকে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবার জন্যে গোপনে প্ররোচনা দিতে লাগলেন।
সওকতও টোপ গিলতে দেরি করলেন না। তিনি দিল্লির বাদশার উজির ইমাদ-উল-মুল্ককে এক কোটি টাকা উৎকোচ দিয়ে নিজের নামে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব বলে ফরমান আনিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলেন এবং সিরাজকে সোজাসুজি জানিয়ে দিতে কসুর করলেন না যে—’ভালোয় ভালোয় সুড়সুড় করে সিংহাসন থেকে নেমে পড়ো। ঢাকায় গিয়ে আমার তাঁবে থেকে চাকরি করো!’
সওকতের দম্ভ চূর্ণ করবার জন্যেই সিরাজ সসৈন্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ইংরেজরা নিজমূর্তি ধারণ করে বলে পিছনে শত্রু রেখে তিনি পূর্ণিয়ায় যেতে পারেননি। জুন মাসে কলকাতার পতন ও ইংরেজ বিতাড়িত হল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল বাদলের ঘনঘটা। তারপর বর্ষাকাল কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে সিরাজ আবার বেরিয়ে পড়লেন সদলবলে।
সওকত ছিলেন একেবারেই অপদার্থ জীব। তাঁর হামবড়া ভাবের জন্যে কেউই তাঁকে পছন্দ করত না। সর্বদাই তিনি নেশায় চুর হয়ে ইয়ারদের সঙ্গে নর্তকীদের নাচগান নিয়ে মেতে থাকতেন।
সিরাজের সেনাপতি রাজা মোহনলাল সর্বাগ্রে নিজের ফৌজ নিয়ে পূর্ণিয়ায় প্রবেশ করলেন। মনিহারি নামক স্থানের কাছে সওকতও সসৈন্যে এগিয়ে এলেন সিরাজকে বাধা দেওয়ার জন্যে।
সৈন্যবলে সিরাজ ছিলেন সওকতের চেয়ে অধিকতর বলীয়ান। কিন্তু পূর্ণিয়ার ফৌজের সামনে ছিল এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যা উত্তীর্ণ হওয়া সহজসাধ্য নয়। কাজেই সিরাজের গোলন্দাজরা জলাভূমির এপারে দাঁড়িয়েই কামান দাগতে লাগল। সওকতের গোলন্দাজদের সেনাপতির নাম শ্যামসুন্দর, জাতে বাঙালি কায়স্থ। তিনিও দাগতে লাগলেন নিজেদের কামান।
দুই পক্ষে কামানযুদ্ধ চলছে, এমন সময়ে সওকত নিজের অশ্বারোহী সেনাদলকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে হুকুম দিলেন।
প্রবীণ সেনাপতিরা নারাজ। বললেন, ‘ওই অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে দুর্গম জলাভূমির জল-কাদা পার হওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের সকলকেই মারা পড়তে হবে।’
কিন্তু সওকত হচ্ছেন মস্তবড় সবজান্তা—যুদ্ধ না করেও সেরা যোদ্ধা। তিনি মহা খাপ্পা হয়ে সেনাপতিদের যা মুখে আসে তাই বলে গালাগালি দিতে লাগলেন।
সে গালাগালি দীর্ঘকাল ধরে সহ্য করতে না পেরে সেনানীরা রাগের মাথায় অশ্বারোহী ফৌজ নিয়ে জলাভূমির ভিতর দিয়েই বাংলার সৈন্যদের আক্রমণ করতে চললেন।
হাবলা সওকত জানতেন না, কত ধানে হয় কত চাল! তিনি ভাবলেন, আমার ঘোড়সওয়াররা যখন হামলা দিতে ছুটেছে, তখন লড়াই তো ফতে হয়ে গিয়েছেই! আমি আর এখানে দাঁড়িয়ে মিছে মাথা ঘামিয়ে মরি কেন?
নিজের তাঁবুর ভিতরে ঢুকে তিনি বললেন, ‘লে আও ভাং। নাচো, গাও, ফুর্তি করো!’
তাঁবুর ভিতরে চলছে যখন নবাব ফুর্তির হুল্লোড়, জলাভূমির উপরে তখন সিরাজের কামানগুলো ঘন ঘন হুমকি দিয়ে হু-হু করে ছুটিয়ে দিয়েছে অগ্নিময় মৃত্যুঝড়! পূর্ণিয়ার অশ্বারোহীরা দলে দলে হতাহত হয়ে জলাভূমিকে করে তুললে রক্তরাঙা। অবশেষে তারা আর অসম্ভবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে না, ছত্রভঙ্গ হয়ে দিকে দিকে পলায়ন করতে লাগল।
সেনাপতিরা তখন পলায়মান সৈনিকদের আবার উৎসাহিত করবার জন্যে তাঁবুর ভিতর থেকে সওকতকে বাইরে টেনে আনলেন। কিন্তু নবাব বাহাদুরের তখন শোচনীয় অবস্থা—নেশার চোটে আর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। সকলে মিলে ধরাধরি করে তাঁকে হাতির উপরে তুলে দিলে। কিন্তু কাকে তিনি উৎসাহিত করবেন? রণক্ষেত্রে তখন উপস্থিত আছে মাত্র পনেরো-ষোলোজন পূর্ণিয়ার সৈনিক।
শত্রুপক্ষের এক গুলিতে সওকত ইহলোক ত্যাগ করলেন সেই বেহুঁস অবস্থাতেই। মাটির উপরে পড়ে গেল নবাবের রত্নখচিত উষ্ণীষ।
মনিহারির যুদ্ধে জয়ী হয়ে সিরাজ ব্যর্থ করে দিলেন মিরজাফরের প্রথম ষড়যন্ত্র।
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ হচ্ছে বিজয়ী সিরাজের জীবনে সবচেয়ে মহিমময়। ফিরিঙ্গিরা পলাতক, প্রতিদ্বন্দ্বী সওকত পরাজিত ও নিহত, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের থোঁতা মুখ ভোঁতা—সিরাজউদ্দৌলা হচ্ছেন বঙ্গ-বিহার-ওড়িশার একাধিপতি।