» » সিরাজের বিজয় অভিযান

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

সিরাজের বিজয় অভিযান : পাঁচ

যেমন অনেক দাগি অপরাধী পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে বাইরে নিরীহ দোকানি সেজে দোকান চালায়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে করে চুরি ও রাহাজানি, এদেশে এসে ইংরেজরাও সেই নীতিই অবলম্বন করেছিল।

বাইরে তারা নির্বিরোধী বণিক ছাড়া যেন আর কিছুই নয়। বাজারে নিজেদের মাল বেচে কিছু লাভের লোভেই সাত সাগরে পাড়ি দিয়ে তারা এদেশে আসে এবং ধরনধারণে জাহির করে, যেন তারা নবাব-বাদশার দাসানুদাস।

কিন্তু তলে তলে তাদের আসল ফন্দি ছিল—’ছুঁচ হয়ে ঢুকব, ফাল হয়ে বেরবো।’

একটি বিখ্যাত গল্প আছে। আরব দেশের মরুভূমিতে তাঁবু খাটিয়ে বাস করত এক বেদুইন।

দুপুরের ঝাঁঝালো রোদে পুড়ে মরুবালু আগুন হয়ে উঠেছে। এমন সময়ে একটা উট ধুঁকতে ধুঁকতে এসে বললে, ‘মহাশয়, রোদের তাপে প্রাণ যায়। আপনার এই তাঁবুর ছায়ায় মাথাটা একটু গলিয়ে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেব কি?’

বেদুইন দয়াপরবশ হয়ে বললে, ‘আচ্ছা।’

অল্পক্ষণ পরে উট বললে, ‘মহাশয়, মাথা তো বাঁচল, কিন্তু বুক যে জ্বলে যায়! তাঁবুর ভিতরে বুক পর্যন্ত রাখতে পারব কি?’

বেদুইন বললে, ‘আচ্ছা!’

খানিক বাদে উট বললে, ‘মহাশয়, মাথা আর বুক তো ঠান্ডা হল, কিন্তু দেহের বাকি অংশ যে ঝলসে যাচ্ছে। ওটুকুকে আর বাইরে রাখি কেন?’

বেদুইন বললে, ‘আচ্ছা, ভিতরে এসো।’

উট নিজের গোটা দেহ নিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকল। ছোট্ট তাঁবু, একসঙ্গে উট আর বেদুইনের ঠাঁই হল না। অতএব উটকে ভিতরে রেখে বেদুইনকেই বেরিয়ে যেতে হল তাঁবুর বাইরে।

এদেশে এসে ফিরিঙ্গি বণিকরাও অবলম্বন করেছিল তথাকথিত উষ্ট্র-নীতি।

প্রথমে তারা বিবিধ পণ্য নিয়ে এখানে পদার্পণ করে। কিছু কিছু জমি ইজারা নেয়। মাথা রাখবার জন্যে ঘরবাড়ি বানায়। তারপর নানা অছিলায় দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ করতে থাকে। তারপর ক্রমে ক্রমে ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে।

কিন্তু ধূর্ত ফিরিঙ্গি বণিকরা নবাব-বাদশাদের চোখে ধুলো দিতে পারেনি।

পোর্তুগিজরা যখন হুগলিতে অন্যায়রূপে প্রবল হয়ে উঠবার চেষ্টা করছিল, তখন ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাজাহান সৈন্য পাঠিয়ে দেন তাদের উৎখাত করবার জন্যে। মোগল সাম্রাজ্যের সেই পূর্ণগৌরবের যুগেও পোর্তুগিজরা সহজে বাগ মানেনি। জলপথে ও স্থলপথে মোগলদের তারা প্রাণপণে বাধা দেয়। প্রায় তিনমাস ধরে লড়াই করে মোগলদের ঠেকিয়ে রেখে অবশেষে পোর্তুগিজরা পরাজয় স্বীকার করে। তাদের বন্দি করে আগ্রায় শাজাহানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দিদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশই ভোগ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই ব্যাপারের পর থেকে বাংলাদেশে শক্তি হিসাবে পোর্তুগিজদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙে যায়।

পোর্তুগিজ পর ইংরেজদের পালা। কিন্তু অনেক আগেও ইংজেরা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির অনুসরণ করতে ছাড়েনি। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দেও শায়েস্তা খাঁর আমলে ইংরেজরা একবার হিজলি নামক স্থানে মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। তারপর ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে নানা গোলযোগের সুযোগে তারা  কলকাতায় পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্মাণ করে। তারপর নবাব মুরশিদকুলি খাঁ ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের আর কোনও নতুন দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করে দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ইংরেজরা বাংলাদেশে প্রধান হয়ে ওঠবার চেষ্টা করে। মোগল বাদশাহের রাজশক্তি তখন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে দেখে ইংরেজরা সাহস পেয়ে বাংলাদেশে আবার কেল্লা তৈরি ও ফৌজ গঠন করতে চায়।

কিন্তু নবাব আলিবর্দিও নির্বোধ নন। কারণ ইতিমধ্যেই তিনি দেখেছিলেন, ফরাসি ফিরিঙ্গি দুপ্লে ঠিক ওই উপায়েই দাক্ষিণাত্যের মুসলমান শাসকদেরও চেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। ইংরেজদের ডেকে তিনি বলেন, ‘তোমরা হচ্ছ সওদাগর, তোমাদের আবার কেল্লার দরকার কী? আমিই যখন তোমাদের রক্ষা করবার ভার নিয়েছি, তখন আর কোনও শত্রুকেই তোমাদের ভয় করবার দরকার নেই।’

আলিবর্দির জীবদ্দশাতেই সিরাজ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। অল্পবয়সেই তিনি রাজ্যচালনার কূটকৌশল কিছু কিছু আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন এবং মাতামহের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন একাধিক রণক্ষেত্রে। রীতিমতো বালকবয়সেই সিরাজ পেয়েছিলেন সেনাচালনার ভার। মুতাক্ষেরীন পাঠে বোঝা যায়, রণক্ষেত্রে শত্রুর সামনে নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে সিরাজ যাতে সৈন্যচালনায় দক্ষ হতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই আলিবর্দি তাঁর উত্তরাধিকারী দৌহিত্রকে দিয়েছিলেন উপযোগী শিক্ষালাভের সুযোগ।

হলওয়েল বলেন, আলিবর্দি তাঁর মৃত্যুশয্যায় নাকি সিরাজকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে। আধুনিক ঐতিহাসিক বলেন, এ উক্তির কোনও প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাক আর না থাক, আলিবর্দি যে ইংরেজদের সুনজরে দেখতেন না, এটা সিরাজের অবিদিত থাকবার কথা নয়। তার উপরে বাল্যকাল থেকেই ফিরিঙ্গিরা ছিল তাঁর চোখের বালি। তিনি বলতেন, ‘ফিরিঙ্গিদের শাসন করবার জন্যে দরকার কেবল একজোড়া চটিজুতো।’

এই সিরাজ সিংহাসনের অধিকারী হয়েছেন বলে  কলকাতার ইংরেজরা দস্তুরমতো তটস্থ হয়ে উঠল।