ঐতিহাসিক সমগ্র
সিরাজের বিজয় অভিযান : দুই
পনেরো বৎসর আগেকার কথা।
এক সাহিত্যিক বন্ধুর আমন্ত্রণে প্রথমে জিয়াগঞ্জে গিয়ে উঠলুম। জিয়াগঞ্জকে মুর্শিদাবাদের শহরতলি বলা যায়।
তারপর সেখান থেকে গঙ্গাজলে নৌকো ভাসিয়ে চললুম খোসবাগের দিকে, সেখানেই আছে সিরাজউদ্দৌলার সমাধি। আমার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক।
নৌকো ভাসছে গঙ্গানদীতে, না কোনও ছোট খালের জলে? স্থানে স্থানে শিশুরাও পায়ে হেঁটে গঙ্গা পার হয়ে যায়, এ আমি স্বচক্ষে দেখলুম। স্রোতের নামগন্ধও নেই। এ-গঙ্গার একটিমাত্র গুণ, কলকাতার মতো জল এখানে পঙ্কিল নয়। সমুদ্রনীল স্বচ্ছ জল, তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্পঞ্জের মতো দেখতে পুঞ্জ পুঞ্জ শেওলা ভাসে। গঙ্গার তলদেশে বার বার দৃষ্টিচালনা করেও কোনও ছোট-বড় জলচর জীব আবিষ্কার করতে পারলুম না। শুনলুম কেবল বর্ষাকালেই এখানকার গঙ্গা আবার হয়ে ওঠে বেগবতী স্রোতস্বতী।
গঙ্গাতীরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ। কেবল তীরে নয়, নদীগর্ভেও ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় যেখানে-সেখানে? বোঝা গেল, যেখান দিয়ে আমাদের নৌকো বয়ে যাচ্ছে, আগে সেখানেও ছিল মানুষের বসতি।
সঙ্গীরা দেখিয়ে দিলেন—ওই জগৎ শেঠের ভিটে!
জগৎ শেঠ? সারা ভারতে অদ্বিতীয় ধনকুবের বলে খ্যাতি যাঁর ছড়িয়ে পড়েছিল, টাকার দরকার হলে যাঁর কাছে হাত পাততেন নবাব-বাদশারাও, যাঁর প্রকাণ্ড প্রাসাদ ছিল মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রধান গৌরব—সেই মহীয়ান জগৎ শেঠের বাস্তু-ভিটা?
কিন্তু কোনও প্রাসাদই চোখে পড়ল না। কেবল গঙ্গাতীরে এবং গঙ্গানীরে দেখা গেল একটা ভাঙা স্তূপের খানিক খানিক অংশ। এখানে একটা গরু, ওখানে একটা কুকুর এবং এক জায়গায় চুপ করে বসে আছে কী একটা পাখি।
দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে হিন্দুদের মধ্যে প্রধান চক্রী ছিলেন এই জগৎ শেঠ! তিনি বার বার চক্রান্ত করেছিলেন বাংলার তিন নবাবের বিরুদ্ধে—সরফরাজ, সিরাজউদ্দৌলা এবং মিরকাসিম। অবশেষে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ তাঁকে মুঙ্গেরের গঙ্গায় ডুবিয়ে মারা হয়—সেটা হচ্ছে মানুষের প্রতিশোধ। তারপর এখানে তাঁর প্রাসাদও গঙ্গাগর্ভে লাভ করেছে সলিলসমাধি—এটা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ। জগৎ শেঠের নিঃস্ব বংশধররা আজ উদরান্নের জন্যে পরমুখাপেক্ষী, তাঁর বিপুল বিত্তের এক কপর্দকও আর বিদ্যমান নেই, কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে আছে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ঘৃণ্য কাহিনি।
আবার শুনলুম—ওই নবাব আলিবর্দির টাঁকশাল। ইতিহাসে লেখে, নবাবের টাঁকশালের অস্তিত্ব ছিল জগৎ শেঠের প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যেই। সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে দু-তিনটে জীর্ণ দেওয়াল—তাদের উপরে নেই ছাদের আবরণ।
আবার শোনা গেল—ওই সিরাজউদ্দৌলার প্রমোদশালা! সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বৃদ্ধ আলিবর্দির নয়নের মণি। দাদুর কাছে আবদার ধরে রাশি রাশি টাকা ফেলে তিনি ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে যে রম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, হিরাঝিলের স্বচ্ছ জলে সে দেখত তার নিজের প্রতিচ্ছবি। সিরাজের পতনের পরে ক্লাইভের সঙ্গে মিরজাফর এসে এই প্রাসাদের মধ্যেই বাংলার মসনদে আরোহণ করেছিলেন।
কিন্তু আজ বুঁজে গিয়েছে সে হিরাঝিল। বাংলার শূন্য মসনদ স্থানান্তরিত। প্রমোদশালার বদলে দেখলুম পুঞ্জীভূত ‘রাবিশ’।
যদুপতির সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে মথুরাপুরী এবং শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে অযোধ্যাধাম। এখানেও হয়েছে সেই মহাকাল নাটকের পুনরাভিনয়।