» » রক্ত বাদল ঝরে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

রক্ত বাদল ঝরে

দশম পরিচ্ছেদ : অমানুষী অত্যাচার ও অগ্নিপোত

মর্গ্যান তারপর এল জামাইকা দ্বীপে—এখানকার গভর্নর হচ্ছেন তারই স্বজাতি, অর্থাৎ ইংরেজ।

মর্গ্যানের শক্তি ও খ্যাতি শুনে ফুলমধুলোভী ভ্রমরের মতো চারিদিক থেকে বোম্বেটের পর বোম্বেটে এসে তার দলে যোগ দিতে লাগল—তাদের বেশির ভাগই ইংরেজ। জামাইকার গভর্নর পর্যন্ত তাকে আর বোম্বেটের মতো অভ্যর্থনা করলেন না,—এমনকি তাকে একখানা মস্তবড় জাহাজও দান করলেন। এমন দান পেয়ে মর্গ্যানের আনন্দ আর ধরে না, কারণ এর উপরে ছিল ছত্রিশটা কামান! এত বড় জাহাজ কোনও বোম্বেটেরই ভাগ্যে জোটে না।

সেই সময়ে ওখানে এসে একখানা বড় ফরাসি জাহাজও নোঙর করেছিল, তার উপরে ছিল চব্বিশটা ইস্পাতের ও বারোটা পিতলের কামান। এ জাহাজখানাকে পেলে তার শক্তি অত্যন্ত বেড়ে উঠবে বলে মর্গ্যান ফরাসিদের কাপ্তেনকে নিজের দলে যোগ দেওয়ার জন্যে আহ্বান করলে। কিন্তু ফরাসিরা রাজি হল না—ইংরেজ বোম্বেটেদের তারা বিশ্বাস করে না।

মর্গ্যানের ভারি রাগ হল—ফরাসিদের সাজা দেওয়ার জন্যে ছুতো খুঁজতে লাগল। ছুতো পাওয়াও গেল।

কিছুদিন আগে সমুদ্রে খাদ্যাভাব হওয়ার দরুন ফরাসিরা একখানা ইংরেজ জাহাজ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেছিল এবং তখন জাহাজে টাকা ছিল না বলে ইংরেজদের সঙ্গে এই ব্যবস্থা করেছিল যে, জামাইকায় ফিরে এসে তারা খাবারের দাম কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দেবে।

ব্যাপারটা কিছু অন্যায় নয়। কিন্তু এই ছুতোই বিবেকবুদ্ধিহীন মর্গ্যানের পক্ষে যথেষ্ট হল। সে বাইরে কিছু না ভেঙে ফরাসি জাহাজের কাপ্তেন ও কয়েকজন পদস্থ কর্মচারীকে নিজের জাহাজে নিমন্ত্রণ করলে। তারা কোনওরকম সন্দেহ না করেই নিমন্ত্রণ রাখতে এল। তখন তাদের হাতে পেয়ে দুষ্ট মর্গ্যান বললে, ‘ইংরেজদের কাছ থেকে তোমরা খাবার কেড়ে নিয়েছ। সেই অপরাধে তোমাদের বন্দি করলুম।’—তারপর সে জামাইকার গভর্নরের দেওয়া বড় জাহাজখানায় বন্দিদের পাঠিয়ে দিলে।

আবার নতুন সমুদ্রযাত্রা করবার দিন স্থির হল। ইংরেজ বোম্বেটেরা আসন্ন লাভের আনন্দে জাহাজে জাহাজে উৎসবে মেতে উঠেছে! নাচ-গান-বাজনা চলছে—সবাই মদের নেশায় বেহুঁশ।

আচম্বিতে একসঙ্গে যেন অনেকগুলো বাজ ডেকে উঠল এবং সমুদ্রের বুকে যেন দপ করে জ্বলে উঠল একসঙ্গে শত শত বিদ্যুৎ!…চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল।

মর্গ্যানের সেই বড় সাধের বিরাট জাহাজ শূন্যে উড়ে গেল ভেঙে গুঁড়ো হয়ে। মাত্র তিরিশজন লোক কোনওগতিকে রক্ষা পেল এবং একমুহূর্তেই মারা পড়ল তিনশো পঞ্চাশ জন ইংরেজ।

বোম্বেটেদের মতে, বন্দি ফরাসি কাপ্তেন ও তাঁর সঙ্গীরাই নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জাহাজের বারুদখানায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

মর্গ্যানের সেই বিশ্বাসঘাতকতার ফল তাকে হাতে হাতেই পেতে হল।

অতবড় জাহাজ ও এত লোক হারিয়ে মর্গ্যান একেবারে ভেঙে পড়ল। কিন্তু সে বেশিক্ষণের জন্যে নয়। রাগে অজ্ঞান হয়ে বাকি বোম্বেটেদের নিয়ে আবার ফরাসিদের সেই বড় জাহাজখানা আক্রমণ ও অধিকার করলে।

তারপর তারা সমুদ্রের জলে নিজেদের দলের বোম্বেটেদের লাশ খুঁজতে লাগল—অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্যে নয়, লুণ্ঠন করবার জন্যে। যাদের আঙুলে আংটি ছিল তাদের আংটিসুদ্ধ আঙুল কেটে নেওয়া হল, যাদের পকেটে টাকাকড়ি ছিল তাদের পকেট থেকে টাকাকড়ি চুরি করা হল। তারপর মৃতদেহগুলোকে সামুদ্রিক জীবদের মুখে সমর্পণ করে তারা অম্লানবদনে আবার জাহাজে উঠে অগাধ সাগরে পাড়ি দিল।

দলের সাড়ে তিনশো লোক মারা পড়ল, তবু মর্গ্যানের নামের জোরে সঙ্গীর সংখ্যা হল যথেষ্ট! পনেরোখানা জাহাজে প্রায় হাজারখানেক বোম্বেটে তার সঙ্গে চলল। দুরাত্মার পাপসঙ্গীর অভাব হয় না। সবচেয়ে বড় জাহাজে রইল মর্গ্যান নিজে—কিন্তু তাতে কামান ছিল মোটে চোদ্দোটা, তাও ছোট ছোট।

এবারে মর্গ্যান কিছু মুশকিলে পড়ল। কারণ যাত্রারম্ভের সময়ে তার মাথায় অনেক বড় বড় ফন্দি ছিল; কিন্তু কিছুদিন পরে তার দলের প্রায় পাঁচশো লোকসুদ্ধ সাতখানা জাহাজ অকূল সাগরে কোথায় হারিয়ে গেল। মর্গ্যান কিছুকাল অপেক্ষা করেও তাদের দেখা পেলে না। কাজেই এখানে-ওখানে ছোটখাটো ডাকাতি করেই সে সময় কাটাতে লাগল।

মর্গ্যানের দলে এক ফরাসি কাপ্তেন আছে, সে আগে ছিল বিখ্যাত লোলোনেজের সঙ্গে। সে পরামর্শ দিলে : ‘আপনিও মারাকেবো শহর লুট করবেন চলুন। আমি সেখানকার পথঘাট চিনি, আমাদের কোনও কষ্ট হবে না।’—এ প্রস্তাবে মর্গ্যানের নারাজ হওয়ার কারণ ছিল না।

তারা মারাকেবোর সমুদ্রে এসে হাজির হল। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে যখন শহরের খুব কাছে এসে পড়ল, স্পানিয়ার্ডরা তখন তাদের দেখতে পেলে। লোলোনেজের নগরলুণ্ঠনের পর তারা এখন আর একটা নতুন কেল্লা তৈরি করেছিল—সেইখানে বোম্বেটেদের সঙ্গে তাদের বিষম যুদ্ধ হল। কিন্তু এবারেও স্পানিয়ার্ডরা জিততে পারলে না, মারাকেবো শহরের হতভাগ্য বাসিন্দারা আবার নরকযন্ত্রণা ভোগ করলে। সেই একই বিয়োগান্ত নাটকের পুনরাভিনয়। সবিস্তারে আর বর্ণনা করবার দরকার নেই।

তারপর জিব্রালটার নগরের পালা। কিন্তু লোলোনেজ তাদের যে সর্বনাশ করে গিয়েছিল, জিব্রালটারের বাসিন্দারা এখনও তা ভুলতে পারেনি। কাজেই বোম্বেটেদের সাড়া পেয়ে তারা পঙ্গপালের মতো দলে দলে শহর ছেড়ে পলায়ন করতে লাগল—সমস্ত মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়ে।

বোম্বেটেরা শহরে ঢুকে দেখলে—সে এক নিঝুমপুরী। না আছে রসদ, না আছে ধনরত্ন, না আছে জনমনুষ্য! চারিদিক সমাধির মতো খা খা করছে!

কেবল একটি লোক পালায়নি। তার পোশাক ময়লা, তালিমারা, ছেঁড়াখোড়া। বোম্বেটেরা জানত না যে, সে জন্মজড়ভরত—পাগল বললেও চলে।

তারা তাকে যত কথা শুধোয়, সে খালি বলে, ‘আমি কিছু জানি না, আমি কিছু জানি না।’

বোম্বেটেরা তখন তাকে নিজেদের প্রথামতো বিষম যন্ত্রণা দিতে শুরু করলে।

পাগলা বললে, ‘ওগো, আর যাতনা দিও না! আমার সঙ্গে চলো, আমি তোমাদের আমার সমস্ত ঐশ্বর্য দান করছি!’

বোম্বেটেরা ভাবলে, এ লোকটা নিশ্চয়ই কোনও ধনী ব্যক্তি, কেবল তাদের চোখে ধুলো দেওয়ার ফিকিরেই গরিবের সাজ পরেছে।

অতএব তারা তার সঙ্গে সঙ্গে চলল, পাগলা তাদের নিয়ে একখানা ভাঙা কুঁড়েঘরে গিয়ে বললে, ‘দ্যখো, আমার কত ঐশ্বর্য!’

ঘরের ভিতরে ছিল কেবল কতকগুলো মাটির বাসন ও গুটিতিনেক টাকা।

বোম্বেটেরা খাপ্পা হয়ে বললে, ‘কী! আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা? দ্যাখ তবে মজাটা।’

পাগলা বললে, ‘জানো আমি কে? আমার নাম হচ্ছে শ্রীযুক্ত সিবাস্টিয়ান স্যানসেজ, আমি হচ্ছি মারাকেবোর লাটসাহেবের ভাই।’

বোম্বেটেরা তার কথা সত্য ভেবে নিয়ে অধিকতর লুব্ধ হয়ে তাকে আবার যন্ত্রণা দিতে লাগল। তাকে দড়িতে বেঁধে শূন্যে টেনে তুললে এবং তার গলায় ও দুই পায়ে বিষম ভারী ভারী বোঝা ঝুলিয়ে দিলে। তারপর সেই অভাগাকে পাপিষ্ঠরা জ্যান্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে মারলে।

বোম্বেটেরা তারপর সে দেশের বনে বনে চারিদিকে খুঁজে বেড়াতে লাগল এবং অনেক চেষ্টার পর একে একে প্রায় আড়াইশো স্পানিয়ার্ডকে গ্রেপ্তার করলে।

স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে ছিল এক কাফ্রি গোলাম।

মর্গ্যান তাকে হুকুম দিলে, ‘ওরা কিছুতেই যখন টাকার কথা বলবে না, তখন ওদের দল খানিকটা হালকা করে দে!’

কাফ্রি গোলাম একে একে কয়েকজনকে হত্যা করলে—অন্যান্য বন্দিদের চোখের সামনেই। তারপর বোম্বেটেদের খুশি করবার জন্যে সেই দুষ্ট কাফ্রি একজন বৃদ্ধ স্পানিয়ার্ডকে দেখিয়ে বললে, ‘ওই লোকটা অনেক টাকার মালিক।’

বুড়োর কপাল পুড়ল। বোম্বেটেরা টাকা চাইলে, বুড়ো বললে, ‘এ পৃথিবীতে আমার যথাসর্বস্ব হচ্ছে চারশো টাকা।’

বোম্বেটেরা বিশ্বাস করলে না। দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা সেই বুড়োর দুখানা হাতই মড়মড় করে ভেঙে দিলে। তারপর তার হাত ও পায়ের বুড়ো আঙুলে দড়ি বেঁধে তাকে শূন্যে টেনে তুললে। সেই অবস্থায় তারা লাঠি দিয়ে দড়ির উপরে এমন ঝাঁকানি মারতে লাগল যে, প্রত্যেক ঝাঁকানির সঙ্গেই বৃদ্ধের ক্ষীণ প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হল। এই বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতাতেও খুশি না হয়ে বোম্বেটেরা বুড়োর পেটের উপরে সেই অবস্থাতেই আড়াই মন বোঝা চাপিয়ে দিলে। এবং সেই সঙ্গে আগুন জ্বেলে হতভাগ্যের দাড়ি-গোঁফ, চুল ও মুখের চামড়া—সব পুড়িয়ে দিলে। তারপর তাকে নামিয়ে একটা থামে বেঁধে রাখা হল এবং চারদিন তাকে প্রায় অনাহারে রাখা হল বললেই চলে।

বুড়ো বেচারি খুব ছোট একটা সরাইখানা চালিয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান করত। অনেক কষ্ট ও অনেক চেষ্টার পর কিছু টাকা ধার করে এনে বোম্বেটেদের দিয়ে সে-যাত্রা সে মুক্তি পেল বটে, কিন্তু তার দেহ এমন ভয়ানকভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল যে, খুব সম্ভব তাকে আর বেশিদিন এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হয়নি।

এরাই হচ্ছে প্রেমের অবতার খ্রিস্টদেবের শিষ্য—যাঁর ধর্মের বড় মন্ত্র হচ্ছে প্রেমের মন্ত্র। এবং এরাই ভারতবাসীদের ও আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ানদের ঘৃণা করে বর্বর বলে। উপরন্তু এদের মতে এশিয়ার বাসিন্দারা নাকি নিষ্ঠুরতায় পৃথিবীতে অতুলনীয়। কিন্তু যেসব অকথ্য নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ইংরেজ-রাজের কাছ থেকে মর্গ্যান সম্মান, উপাধি ও উচ্চপদ লাভ করেছে, সেগুলোকে আমরা কি পরম করুণার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বলে মাথায় তুলে রাখব? মর্গ্যান ওখানে পূর্বকথিত ব্যাপারটিরও চেয়ে ভয়ানক এমন সব পৈশাচিক কাণ্ডের অনুষ্ঠান করেছিল, পাঠকরা সহ্য করতে পারবেন না বলে এখানে সেগুলোর কথা আর বললুম না। তাদের তুলনায় ঢের বেশি ভদ্র ও শান্ত দুটো দৃষ্টান্ত এখানে দিচ্ছি।

অনেক স্পানিয়ার্ডকে ধরে মর্গ্যান পায়ে ও হাতে পেরেক মেরে ক্রুশে বিদ্ধ করে রেখেছিল—সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতের ও পায়ের আঙুলগুলোর ফাঁকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল তৈলাক্ত সলিতা। এবং আরও অনেককে ধরে বেঁধে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে তাদের পাগুলোকে এমন কৌশলে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল যে, যাতে তারা ‘রোস্টে’র মতো ধীরে ধীরে সিদ্ধ হয়। এত জঘন্য অত্যাচার কেবল সামান্য টাকার জন্যেই—যে টাকা পরে বোম্বেটেরা মদ খেয়ে জুয়া খেলে দুদিনেই উড়িয়ে দেবে!

জিব্রালটার শহরে ঐশ্বর্যলাভের দিক থেকে কিছুই সুবিধা করে উঠতে না পেরে মর্গ্যান বুঝলে, এ-যাত্রা কপাল তার ভালো নয়। কিন্তু সেই সময়েই খবর পাওয়া গেল, জিব্রালটারের গভর্নর অনেক ধনরত্ন ও শহরের স্ত্রীলোকদের নিয়ে নদীর মাঝখানে একটা দ্বীপে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। মর্গ্যান অমনি নৌকো ভাসিয়ে সদলবলে তাদের ধরতে ছুটল।

খবর পেয়ে গভর্নর দ্বীপ থেকে পালিয়ে সকলকে নিয়ে একটা পাহাড়ের শিখরে উঠে বসে রইলেন। বোম্বেটেরাও নাছোড়বান্দা—তারাও পিছনে পিছনে ছুটল। তখন বর্ষাকাল। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড়ে যাওয়ার পথে নদীর জল ফুলে উঠেছে। স্রোতের তোড়ই বা কী! নদী সেদিন পৃথিবীকে অনেকগুলো বোম্বেটের পাপভার সইবার দায় থেকে নিষ্কৃতি দিলে—স্রোতের টানে তারা একেবারে সটান পাতালে চলে গেল।

পাহাড়ের তলায় গিয়ে মর্গ্যানের সব আশা ফুরিয়ে গেল। খাড়া পাহাড়ের গা—পাঁচ-সাত হাত উপরেও উঠবার উপায় নেই। একটিমাত্র সরু লিকলিকে পথ টঙে গিয়ে উঠেছে—সে পথে সার বেঁধে পাশাপাশি দুজন যেতে পারে না। টঙ থেকে যদি একজন মাত্র স্পানিয়ার্ডে গুলি চালায়, তাহলে একে একে শত শত বোম্বেটের দেহ হবে পপাতধরণীতলে। তার উপরে বৃষ্টির জলে বোম্বেটেদের সমস্ত বারুদ ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে।

এই সময়ে যদি মাত্র পঞ্চাশজন স্পানিয়ার্ড বুক বেঁধে আক্রমণ করত, তাহলে সেই চার-পাঁচশো বোম্বেটে মনুষ্যসমাজকে আর যন্ত্রণা দেওয়ার সুযোগ পেত না। কিন্তু ঘা খেয়ে খেয়ে স্পানিয়ার্ডরা তখন নেতিয়ে পড়ে সব সাহস থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। তারা আক্রমণ করবে কি, গাছের পাতাটি নড়লেও ‘ওই বোম্বেটে আসছে’ ভেবে আঁতকে পালিয়ে যায়।

কিন্তু মর্গ্যান তা বুঝতে পারেনি। সেই সরু পথে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর ছায়া দেখে সে আর অগ্রসর হতে সাহস করলে না, সমস্ত লোকজন নিয়ে মানেপ্রাণে সেখান থেকে সরে পড়ল।

জিব্রালটার নগরে ফিরে এসে পাঁচ হপ্তা ধরে নারকীয় কাণ্ড করবার পর বোম্বেটেরা বিষম এক দুঃসংবাদ পেলে। স্পানিয়ার্ডদের তিনখানা বড় বড় যুদ্ধজাহাজ মারাকেবো বন্দরে এসে হাজির হয়েছে। সবচেয়ে বড় জাহাজখানায় কামান আছে চল্লিশটা, তার চেয়ে কিছু ছোট জাহাজে তিরিশটা, সবচেয়ে ছোট জাহাজে চব্বিশটা। মর্গ্যানের সবচেয়ে বড় জাহাজেও চোদ্দোটার বেশি কামান নেই।

বোম্বেটেদের ফেরবার পথ হচ্ছে মারাকেবো বন্দরের ভিতর দিয়েই। তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! আর বুঝি রক্ষা নেই—পাপের প্রায়শ্চিত্ত হওয়ার সময় এসেছে!

কিন্তু সত্যিকার নেতার আসল গুণ হচ্ছে, দারুণ বিপদেও হাল না ছাড়া! এ গুণ মর্গ্যানেরও ছিল। সে বুক ফুলিয়ে বললে, ‘কুছ পরোয়া নেই! আসুক ওরা,—আমরাও লড়াই করব!’

স্পানিয়ার্ড নৌবাহিনীর অ্যাডমিরালের এক চিঠি এল :

‘বোম্বেটে সরদার মর্গ্যান, আমাদের মহারাজের রাজত্বে এসে তুমি যেসব ভীষণ উৎপাত করছ, তা আমি শুনেছি। অতঃপর তুমি যদি আমার কাছে বিনাবাক্যব্যয়ে আত্মসমর্পণ করো আর লুটের সমস্ত মাল ও বন্দিদের ফিরিয়ে দাও, তাহলে আমি স্বীকার করছি, তোমাদের সকলকেই ছেড়ে দেব। আর আমাদের কথা যদি না শোনো, তাহলে এও প্রতিজ্ঞা করছি যে, তোমাদের প্রত্যেককেই আমি বধ না করে ছাড়ব না!’

বোম্বেটেদের পরামর্শসভা বসল। মর্গ্যানের কথার উত্তরে সকলেই একবাক্যে বললে, ‘সরদার, জান কবুল! এত বিপদ সয়ে আমরা যে লুটের মাল পেয়েছি আর তা ফিরিয়ে দেব না! যতক্ষণ আমাদের শেষ রক্তবিন্দু থাকবে ততক্ষণ আমরা আত্মসমর্পণ করব না!’

তবু যদি ভালোয় ভালোয় এই বিপদ চুকে যায়, সেই আশায় মর্গ্যান অ্যাডমিরালের কাছে তিনটি প্রস্তাব করে পাঠালে : প্রথমত, আমরা আর মারকেবো শহরের কোনও অনিষ্ট করব না বা বাসিন্দাদের কাছ থেকে কোনও অর্থ দাবি করব না। দ্বিতীয়ত, বন্দিদের আমরা স্বাধীনতা দেব। তৃতীয়ত, কেবল জিব্রালটারের বাসিন্দারা আমাদের যে অর্থ দেবে বলে স্বীকার করেছে, তা না পাওয়া পর্যন্ত এখানকার চারজন প্রধান ব্যক্তি জামিনদার রূপে আমাদের সঙ্গে থাকবে।

অ্যাডমিরাল জবাবে বলে পাঠালেন : ‘তোমাদের আর দুদিন সময় দিলুম। এর মধ্যে যদি আত্মসমর্পণ না করো, তাহলে তোমাদের কারুকে আমি ক্ষমা করব না।’

মর্গ্যান খাপ্পা হয়ে বললে, ‘সাজো তবে সবাই রণসাজে! নিজের জোরে আমরা এই ফাঁদ ছিঁড়ে বেরিয়ে যাব। দেখি, আমাদের কে রুখতে পারে!’

তখনই তারা সর্বাগ্রে একখানা অগ্নিপোত নির্বাণে নিযুক্ত হল। অগ্নিপোত কাকে বলে এদেশের অনেকেই বোধহয় তা জানেন না। সেকালে জলযুদ্ধে প্রায়ই এই অগ্নিপোত ব্যবহৃত হত। এই অগ্নিপোতের ভিতরে সহজে জ্বলে ওঠে এমন সব জিনিস ভালো করে ঠেসে দেওয়া হত। তার বাইরেটা হত সাধারণ জাহাজের মতোই—কাজেই শত্রুপক্ষ তাকে সন্দেহ করতে পারত না। তারপর সেই অগ্নিপোতখানার ভিতরে আগুন লাগিয়ে শত্রুদের নৌবাহিনীর মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হত। শত্রুদের জাহাজগুলোর কাছে সে যখন যেত, তার সর্বাঙ্গ অগ্নিময় এবং সেই আগুন শত্রুদের জাহাজও অগ্নিময় করে তুলত। আজকালকার যুদ্ধজাহাজ হয় শীঘ্রগামী ও লৌহময়, তাই অগ্নিপোতের ব্যবহার এখন উঠে গেছে।

বোম্বেটেরা সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে বড় বড় নৌকোয় চড়ে বসল, অগ্নিপোতখানাকে সঙ্গে নিলে, তারপর মারাকেবো বন্দরের দিকে তারা অগ্রসর হল, অগ্নিপোতখানা যেতে লাগল আগে আগে।

তারা সন্ধ্যার সময়ে বন্দরে গিয়ে স্পানিয়ার্ড নৌবাহিনীকে দেখতে পেলে। এগুলো প্রকাণ্ড জাহাজই বটে, এদের সঙ্গে সাধারণভাবে লড়াই করবার সাধ্য তাদের ছিল না।

দুই পক্ষই পরস্পরকে দেখতে পেয়ে পরস্পরের দিকে অগ্রসর হল।

বোম্বেটেদের অগ্নিপোত দেখে স্পানিয়ার্ডরা তার সাংঘাতিক স্বরূপ আন্দাজ করতে পারলে না। তারা ভাবলে, একখানা অতিসাহসী বোম্বেটে জাহাজ একলাই তাদের আক্রমণ করতে আসছে। অতিসাহসের মজাটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে তারা বিপুল উৎসাহে তাকে আক্রমণ করবার জন্যে বেগে তেড়ে এল।

কিন্তু তার কাছে এসেই তাদের চক্ষুস্থির! এ যে অগ্নিপোত, এর ভিতরে যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে এবং সে আগুন হুহু করে বেড়ে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তে!

স্পানিয়ার্ডদের জাহাজ তিনখানা পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করল—কিন্তু তখন পালাবারও সময় নেই। অগ্নিপোত একেবারে সব চেয়ে বড় শত্রুজাহাজের পাশে গিয়ে লাগল—তখন তার ভিতরকার অগ্নি ঠিক যেন অসংখ্য জ্বলন্ত রক্তদানবের মতো মহাশূন্যে বাহু তুলে তাথৈ তাথৈ তাণ্ডবনৃত্য করছে! মাঝে মাঝে তার গর্ভস্থ বারুদ বিস্ফোরণের ভৈরবধ্বনি,—কান কালা হয়ে যায়!

দেখতে দেখতে স্পানিয়ার্ডদের অতিকায় জাহাজখানাও অগ্নিপোতের মতোই অগ্নিময় হয়ে উঠল! এবং দেখতে দেখতে তার একাংশ আগুনে পুড়ে জীর্ণ হয়ে সমুদ্রগর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল!

স্পানিয়ার্ডদের দ্বিতীয় জাহাজখানা ভয়ে আর সেখানে দাঁড়াল না, তাড়াতাড়ি বন্দরের নিরাপদ অংশে ঢুকে পড়ে একেবারে কেল্লার তলায় গিয়ে উপস্থিত হল। পাছে সেখানা বোম্বেটেদের হাতে গিয়ে পড়ে, সেই ভয়ে স্পানিয়ার্ডরা নিজেরাই তাকে জলের ভিতরে ডুবিয়ে দিলে।

বোম্বেটেরা তৃতীয় জাহাজখানাকে পালাতেও দিলে না। তারা চারিদিক থেকে প্রবল বেগে তাকে আক্রমণ করলে। এমন দুর্জয় নৌবাহিনীর এই কল্পনাতীত পরিণাম দেখে স্পানিয়ার্ডরা তখন ভয়ে ও বিস্ময়ে এত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে যে, বোম্বেটেদের সঙ্গে তারা মাথা ঠিক রেখে লড়তেও পারলে না। অল্পক্ষণ যুদ্ধের পরেই তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।

কাপ্তেন মর্গ্যানের এই বিচিত্র ও অপূর্ব জয়কাহিনি যখন ইংল্যাণ্ডে গিয়ে পৌঁছোল, তখন সেখানেও তার নামে ধন্য ধন্য রব উঠল। আর ওয়েস্ট ইণ্ডিজে বোম্বেটে মহলে তার নাম হল যেন উপাস্য দেবতার নাম! কথায় বলে, ঢাল নেই—খাঁড়া নেই, নিধিরাম সরদার! কিন্তু ঢাল-খাঁড়া না থাকলেও কেবল উপস্থিত বুদ্ধিবলে যে কী অসাধ্য সাধন করা যায়, নিধিরাম তা জানলে আজ তাকে ঠাট্টার পাত্র হতে হত না। কেবল বুদ্ধিবলেই কাপ্তেন মর্গ্যান আজ বিনা জাহাজে জলযুদ্ধ-বিজয়ী নাম কিনলে!