গোবিন্দলাল অন্তঃপুরে আসিয়া দেখিলেন যে, ভ্রমর, রোহিণীকে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাল কথা বলিবার ইচ্ছা, কিন্তু পাছে এ দায় সম্বন্ধে ভাল কথা বলিলেও রোহিণীর কান্না আসে, এ জন্য তাহাও বলিতে পারিতেছে না। গোবিন্দলাল আসিলেন দেখিয়া ভ্রমর যেন দায় হইতে উদ্ধার পাইল। শীঘ্রগতি দূরে গিয়া গোবিন্দলালকে ইঙ্গিত করিয়া ডাকিল। গোবিন্দলাল ভ্রমরের কাছে গেলেন, ভ্রমর গোবিন্দলালকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “রোহিণী এখানে কেন?”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “আমি গোপনে উহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিব। তাহার পর উহার কপালে যা থাকে, হবে।”
ভ্র। কি জিজ্ঞেস করিবে?
গো। উহার মনের কথা। আমাকে উহার কাছে একা রাখিতে যাইতে যদি তোমার ভয় হয়, তবে না হয়, আড়াল হইতে শুনিও।
ভোমরা বড় অপ্রতিভ হইল। লজ্জায় অধোমুখী হইয়া, ছুটিয়া সে অঞ্চল হইতে পলাইল। একেবারে পাকশালায় উপস্থিত হইয়া, পিছন হইতে পাচিকার চুল ধরিয়া টানিয়া বলিল, “রাঁধুনি ঠাকুরঝি! রাঁধতে রাঁধতে একটি রূপকথা বল না।”
এ দিকে গোবিন্দলাল, রোহিণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বৃত্তান্ত আমাকে সকল বিশেষ করিয়া বলিবে কি?” বলিবার জন্য রোহিণীর বুক ফাটিয়া যাইতেছিল–কিন্তু যে জাতি জীয়ন্তে জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করিত, রোহিণীও সেই জাতীয়া–আর্যকন্যা। বলিল, “কর্তার কাছে সবিশেষে শুনিয়াছেন ত!”
গো। কর্তা বলেন, তুমি জাল উইল রাখিয়া, আসল উইল চুরি করিতে আসিয়াছিলে। তাই কি?
রো। তা নয়।
গো। তবে কি?
রো। বলিয়া কি হইবে?
গো। তোমার ভাল হইতে পারে।
রো। আপনি বিশ্বাস করিলে ত?
গো। বিশ্বাসযোগ্য কথা হইলে কেন বিশ্বাস করিব না?
রো। বিশ্বাসযোগ্য কথা নহে।
গো। আমার কাছে কি বিশ্বাসযোগ্য, কি অবিশ্বাসযোগ্য, তাহা আমি জানি, তুমি জানিবে কি প্রকারে? আমি অবিশ্বাসযোগ্য কথাতেও কখনও কখনও বিশ্বাস করি।
রোহিণী মনে মনে বলিল, “নহিলে আমি তোমার জন্যে মরিতে বসিব কেন? যাই হৌক, আমি ত মরিতে বসিয়াছি, কিন্তু তোমায় একবার পরীক্ষা করিয়া মরিব।” প্রকাশ্যে বলিল, “সে আপনার মহিমা। কিন্তু আপনাকে এ দুঃখের কাহিনী বলিয়াই বা কি হইবে?”
গো। যদি আমি তোমার কোন উপকার করিতে পারি।
রো। কি উপকার করিবেন?
গোবিন্দলাল ভাবিলেন, “ইহার জোড়া নাই। যাই হউক, এ কাতরা–ইহাকে সহজে পরিত্যাগ করা নহে।” প্রকাশ্যে বলিলেন, “যদি পারি কর্তাকে অনুরোধ করিব। তিনি তোমায় ত্যাগ করিবেন।”
রো। আর যদি আপনি অনুরোধ না করেন, তবে তিনি আমায় কি করিবেন?
গো। শুনিয়াছ ত?
রো। আমার মাথা মুড়াইবেন, ঘোল ঢালিয়া দিবেন, দেশ হইতে বাহির করিয়া দিবেন। ইহার ভাল মন্দ কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।–এ কলঙ্কের পর, দেশ হইতে বাহির করিয়া দিলেই আমার উপকার। আমাকে তাড়াইয়া না দিলে, আমি আপনিই এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইব। আর এ দেশে মুখ দেখাইব কি প্রকারে? ঘোল ঢালা বড় গুরুতর দণ্ড নয়, ধুইলেই ঘোল যাইবে। বাকি এই কেশ–
এই বলিয়া রোহিণী একবার আপনার তরঙ্গক্ষুব্ধ কৃষ্ণতড়াগতুল্য কেশদাম প্রতি দৃষ্টি করিল–বলিতে লাগিল, “এই কেশ–আপনি কাঁচি আনিতে বলুন, আমি বৌ ঠাকরুণের চুলের দড়ি বিনাইবার জন্য ইহার সকলগুলি কাটিয়া দিয়া যাইতেছি।”
গোবিন্দলাল ব্যথিত হইলেন। দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “বুঝেছি রোহিণী। কলঙ্কই তোমার দণ্ড। সে দণ্ড হইতে রক্ষা না হইলে, অন্য দণ্ডে তোমার আপত্তি নাই।”
রোহিণী এবার কাঁদিল। হৃদয়মধ্যে গোবিন্দলালকে শত সহস্র ধন্যবাদ করিতে লাগিল। বলিল, “যদি বুঝিয়াছেন, এ কলঙ্কদণ্ড হইতে কি আমায় রক্ষা করিতে পারিবেন?”
গোবিন্দলাল কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “বলিতে পারি না। আসল কথা শুনিতে পাইলে, বলিতে পারি যে, পারিব কি না।”
রোহিণী বলিল, “কি জানিতে চাহেন, জিজ্ঞাসা করুন।”
গো। তুমি যাহা পোড়াইয়াছ, তাহা কি?
রো। জাল উইল।
গো। কোথায় পাইয়াছিলে?
রো। কর্তার ঘরে, দেরাজে।
গো। জাল উইল সেখানে কি প্রকারে আসিল?
রো। আমিই রাখিয়া গিয়াছিলাম। যে দিন আসল উইল লেখাপড়া হয়, সেই দিন রাত্রে আসিয়া, আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল রাখিয়া গিয়াছিলাম।
গো। কেন, তোমার কি প্রয়োজন?
রো। হরলাল বাবুর অনুরোধে।
গোবিন্দলাল বলিলেন, “তবে কাল রাত্রে আবার কি করিতে আসিয়াছিলে?”
রো। আসল উইল রাখিয়া, জাল উইল চুরি করিবার জন্য।
গো। কেন? জাল উইলে কি ছিল?
রো। বড় বাবুর বার আনা–আপনার এক পাই।
গো। কেন আবার উইল বদলাইতে আসিয়াছিলে? আমি ত কোন অনুরোধ করি নাই।
রোহিণী কাঁদিতে লাগিল। বহু কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া বলিল, “না–অনুরোধ করেন নাই–কিন্তু যাহা আমি ইহজন্মে কখনও পাই নাই–যাহা ইহজন্মে আর কখনও পাইব না–আপনি আমাকে তাহা দিয়াছিলেন।”
গো। কি সে রোহিণী?
রো। সেই বারুণী পুকুরের তীরে, মনে করুন।
গো। কি রোহিণী?
রো। কি? ইহজন্মে আমি বলিতে পারিব না–কি। আর কিছু বলিবেন না। এ রোগের চিকিৎসা নাই–আমার মুক্তি নাই। আমি বিষ পাইলে খাইতাম। কিন্তু সে আপনার বাড়ীতে নহে। আপনি আমার অন্য উপকার করিতে পারেন না–কিন্তু এক উপকার করিতে পারেন,–একবার ছাড়িয়া দিন, কাঁদিয়া আসি। তার পর যদি আমি বাঁচিয়া থাকি, তবে না হয়, আমার মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবেন।
গোবিন্দলাল বুঝিলেন। দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রোহিণীর হৃদয় দেখিতে পাইলেন। বুঝিলেন, যে মন্ত্রে ভ্রমর মুগ্ধ, ভুজঙ্গীও সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়াছে। তাঁহার আহ্লাদ হইল না–রাগও হইল না–সমুদ্রবৎ সে হৃদয়, তাহা উদ্বেলিত করিয়া দয়ার উচ্ছ্বাস উঠিল। বলিলেন, “রোহিণী, মৃত্যুই বোধ হয় তোমার ভাল, কিন্তু মরণে কাজ নাই। সকলেই কাজ করিতে এ সংসারে আসিয়াছি। আপনার আপনার কাজ না করিয়া মরিব কেন?”
গোবিন্দলাল ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। রোহিণী বলিল, “বলুন না?”
গো। তোমাকেও এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে।
রো। কেন?
গো। তুমি আপনিই ত বলিয়াছিলে, তুমি এ দেশ ত্যাগ করিতে চাও।
রো। আমি বলিতেছিলাম লজ্জায়, আপনি বলেন কেন?
গো। তোমার আমায় আর দেখাশুনা না হয়।
রোহিণী দেখিল, গোবিন্দলাল সব বুঝিয়াছেন। মনে মনে বড় অপ্রতিভ হইল–বড় সুখী হইল। তাহার সমস্ত যন্ত্রণা ভুলিয়া গেল। আবার তাহার বাঁচিতে সাধ হইল। আবার তাহার দেশে থাকিতে বাসনা জন্মিল। মনুষ্য বড়ই পরাধীন।
রোহিণী বলিল, “আমি এখনই যাইতে রাজি আছি। কিন্তু কোথায় যাইব?”
গো। কলিকাতায়। সেখানে আমি আমার এক জন বন্ধুকে পত্র দিতেছি। তিনি তোমাকে একখানি বাড়ী কিনিয়া দিবেন, তোমার টাকা লাগিবে না।
রো। আমার খুড়ার কি হইবে?
গো। তিনি তোমার সঙ্গে যাইবেন, নহিলে তোমাকে যাইতে বলিতাম না।
রো। সেখানে দিনপাত করিব কি প্রকারে?
গো। আমার বন্ধু তোমার খুড়ার একটি চাকরি করিয়া দিবেন।
রো। খুড়া দেশত্যাগে সম্মত হইবেন কেন?
গো। তুমি কি তাঁহাকে এই ব্যাপারের পর সম্মত করিতে পারিবে না?
রো। পারিব। কিন্তু আপনার জ্যেষ্ঠতাতকে সম্মত করিবে কে? তিনি আমাকে ছাড়িবেন কেন?
গো। আমি অনুরোধ করিব।
রো। তাহা হইলে আমার কলঙ্কের উপর কলঙ্ক। আপনারও কিছু কলঙ্ক।
গো। সত্য; তোমার জন্য, কর্তার কাছে ভ্রমর অনুরোধ করিবে। তুমি এখন ভ্রমরের অনুসন্ধানে যাও। তাহাকে পাঠাইয়া দিয়া, আপনি এই বাড়ীতেই থাকিও। ডাকিলে যেন পাই।
রোহিণী সজলনয়নে গোবিন্দলালকে দেখিতে দেখিতে ভ্রমরের অনুসন্ধানে গেল। এইরূপে কলঙ্কে, বন্ধনে, রোহিণীর প্রথম প্রণয়সম্ভাষণ হইল।