ভ্রমর রুগ্নশয্যাশায়িনী শুনিয়া ভ্রমরের পিতা ভ্রমরকে দেখিতে আসিলেন। ভ্রমরের পিতার পরিচয় সবিশেষ দিই নাই–এখন দিব। তাঁহার পিতা মাধবীনাথ সরকারের বয়স একচত্বারিংশৎ বৎসর। তিনি দেখিতে বড় সুপুরুষ। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে লোকমধ্যে বড় মতভেদ ছিল। অনেকে তাঁহার বিশেষ প্রশংসা করিত–অনেকে বলিত, তাঁহার মত দুষ্ট লোক আর নাই। তিনি যে চতুর, তাহা সকলেই স্বীকার করিত–এবং যে তাঁহার প্রশংসা করিত, সেও তাঁহাকে ভয় করিত।
মাধবীনাথ কন্যার দশা দেখিয়া, অনেক রোদন করিলেন। দেখিলেন–সেই শ্যামা সুন্দরী, যাহার সর্ববয়ব সুললিত গঠন ছিল– এক্ষণে বিশুষ্কবদন, শীর্ণশরীর, প্রকটকণ্ঠাস্থি, নিমগ্ননয়নেন্দীবর। ভ্রমরও অনেক কাঁদিল। শেষ উভয়ে রোদন সংবরণ করিলে পর ভ্রমর বলিল, “বাবা, আমার বোধ হয় দিন নাই। আমায় কিছু ধর্ম কর্ম করাও। আমি ছেলে মানুষ হলে কি হয়, আমার ত দিন ফুরাল। দিন ফুরাল ত আর বিলম্ব করিব কেন? আমার অনেক টাকা আছে, আমি ব্রত নিয়ম করিব। কে এ সকল করাইবে? বাবা, তুমি আমার ব্যবস্থা কর।”
মাধবীনাথ কোন উত্তর করিলেন না–যন্ত্রণা সহ্য হইলে তিনি বহির্বটীতে আসিলেন। বহির্বটীতে অনেকক্ষণ বসিয়া রোদন করিলেন। কেবল রোদন নহে–সেই মর্মভেদী দুঃখ মাধবীনাথের হৃদয়ে ঘোরতর ক্রোধে পরিণত হইল। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, “যে আমার কন্যার উপর এ অত্যাচার করিয়াছে–তাহার উপর তেমনই অত্যাচার করে, এমন কি জগতে কেহ নাই?” ভাবিতে ভাবিতে মাধবীনাথের হৃদয় কাতরতার পরিবর্তে প্রদীপ্ত ক্রোধে পরিব্যাপ্ত হইল। মাধবীনাথ তখন রক্তোৎফুল্ললোচনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “যে আমার ভ্রমরের এমন সর্বনাশ করিয়াছে–আমি তাহার এমনই সর্বনাশ করিব।”
তখন মাধবীনাথ কতক সুস্থির হইয়া অন্তঃপুরে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। কন্যার কাছে গিয়া বলিলেন, “মা, তুমি ব্রত নিয়ম করিবার কথা বলিতেছিলে, আমি সেই কথাই ভাবিতেছিলাম। এখন তোমার শরীর বড় রুগ্ন; ব্রত নিয়ম করিতে গেলে অনেক উপবাস করিতে হয়; এখন তুমি উপবাস সহ্য করিতে পারিবে না। একটু শরীর সারুক———”
ভ্র। এ শরীর কি আর সারিবে?
মা। সারিবে মা–কি হইয়াছে? তোমার একটু এখানে চিকিৎসা হইতেছে না–কেমন করিয়াই বা হইবে? শ্বশুর নাই, শাশুড়ী নাই, কেহ কাছে নাই–কে চিকিৎসা করাইবে? তুমি এখন আমার সঙ্গে চল। আমি তোমাকে বাড়ী রাখিয়া চিকিৎসা করাইব। আমি এখন দুই দিন এখানে থাকিব–তাহার পরে তোমাকে সঙ্গে লইয়া রাজগ্রামে যাইব।
রাজগ্রামে ভ্রমরের পিত্রালয়।
কন্যার নিকট হইতে বিদায় লইয়া মাধবীনাথ কন্যার কার্য কারকবর্গের নিকট গেলেন। দেওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, বাবুর কোন পত্রাদি আসিয়া থাকে?” দেওয়ানজী উত্তর করিল, “কিছু না।”
মা। তিনি এখন কোথায় আছেন?
দে। তাঁহার কোন সংবাদই আমরা কেহ বলিতে পারি না। তিনি কোন সংবাদই পাঠান না।
মা। কাহার কাছে এ সংবাদ পাইতে পারিব?
দে। তাহা জানিলে ত আমরা সংবাদ লইতাম। কাশীতে মা ঠাকুরাণীর কাছে সংবাদ জানিতে লোক পাঠাইয়াছিলাম–কিন্তু সেখানেও কোন সংবাদ আইসে না। বাবুর এক্ষণে অজ্ঞাতবাস।