🕮

এই আখ্যায়িকা আরম্ভের কিছুপর্বে ভ্রমরের একটি পুত্র হইয়া সূতিকাগারেই নষ্ট হয়। ভ্রমর আজি কক্ষান্তরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া, সেই সাত দিনের ছেলের জন্য কাঁদিতে বসিল। মেঝের উপর পড়িয়া, ধূলায় লুটাইয়া অশমিত নিশ্বাসে পুত্রের জন্য কাঁদিতে লাগিল। “আমার ননীর পুত্তলী, আমার কাঙ্গালের সোণা, আজ তুমি কোথায়? আজি তুই থাকিলে আমায় কার সাধ্য ত্যাগ করে? আমার মায়া কাটাইলেন, তোর মায়া কে কাটাইত? আমি কুরূপা কুৎসিতা, তোকে কে কুৎসিত বলিত? তোর চেয়ে কে সুন্দর? একবার দেখা দে বাপ–এই বিপদের সময় একবার কি দেখা দিতে পারিস না–মরিলে কি আর দেখা দেয় না?———”

ভ্রমর তখন যুক্তকরে, মনে মনে উর্ধ্বমুখে, অথচ অস্ফুট বাক্যে দেবতাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “কেহ আমাকে বলিয়া দাও–আমার কি দোষে, এই সতের বৎসর মাত্র বয়সে এমন অসম্ভব দুর্দশা ঘটিল; আমার পুত্র মরিয়াছে–আমার স্বামী ত্যাগ করিল–আমার সতের বৎসর মাত্র বয়স, আমি এই বয়সে স্বামীর ভালবাসা বিনা আর কিছু ভালবাসি নাই–আমার ইহলোকে আর কিছু কামনা নাই–আর কিছু কামনা করিতে শিখি নাই–আমি আজি এই সতের বৎসর বয়সে তাহাতে নিরাশ হইলাম কেন?”

ভ্রমর কাঁদিয়া কাটিয়া সিদ্ধান্ত করিল–দেবতারা নিতান্ত নিষ্ঠুর। যখন দেবতা নিষ্ঠুর, তখন মনুষ্য আর কি করিবে–কেবল কাঁদিবে। ভ্রমর কেবল কাঁদিতে লাগিল।

এদিকে গোবিন্দলাল, ভ্রমরের নিকট হইতে বিদায় হইয়া ধীরে ধীরে বহির্বটীতে আসিলেন। আমরা সত্য কথা বলিব–গোবিন্দলাল চক্ষের জল মুছিতে মুছিতে আসিলেন। বালিকার অতি সরল যে প্রীতি, অকৃত্রিম, উদ্বেলিত, কথায় কথায় ব্যক্ত, যাহার প্রবাহ দিনরাত্রি ছুটিতেছে–ভ্রমরের কাছে সেই অমূল্য প্রীতি পাইয়া গোবিন্দলাল সুখী হইয়াছিলেন, গোবিন্দলালের এখন তাহা মনে পড়িল। মনে পড়িল যে, যাহা ত্যাগ করিলেন, তাহা আর পৃথিবীতে পাইবেন না। ভাবিলেন, যাহা করিয়াছি, তাহা আর এখন ফিরে না–এখন ত যাই। এখন যাত্রা করিয়াছি, এখন যাই। বুঝি আর ফেরা হইবে না। যাহা হউক, যাত্রা করিয়াছি, এখন যাই।

সেই সময়ে যদি গোবিন্দলাল দুই পা ফিরিয়া গিয়া, ভ্রমরের রুদ্ধ দ্বার ঠেলিয়া একবার বলিতেন–“ভ্রমর, আমি আবার আসিতেছি,” তবে সকল মিটিত। গোবিন্দলালের অনেক বার সে ইচ্ছা হইয়াছিল। ইচ্ছা হইলেও তাহা করিলেন না। ইচ্ছা হইলেও একটু লজ্জা করিল। ভাবিলেন, এত তাড়াতাড়ি কি? যখন মনে করিব, তখন ফিরিব। ভ্রমরের কাছে গোবিন্দলাল অপরাধী। আবার ভ্রমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে সাহস হইল না। যাহা হয় একটা স্থির করিবার বুদ্ধি হইল না। যে পথে যাইতেছেন, সেই পথে চলিলেন। তিনি চিন্তাকে বর্জন করিয়া–বহির্বটীতে আসিয়া সজ্জিত অশ্বে আরোহণপূর্বক কশাঘাত করিলেন। পথে যাইতে যাইতে রোহিণীর রূপরাশি হৃদয়মধ্যে ফুটিয়া উঠিল।

Leave a Reply