সেই রাত্রের প্রভাতে শয্যাগৃহে মুক্ত বাতায়নপথে দাঁড়াইয়া, গোবিন্দলাল। ঠিক প্রভাত হয় নাই–কিছু বাকি আছে। এখনও গৃহপ্রাঙ্গনস্থ কামিনীকুঞ্জে, কোকিল প্রথম ডাক ডাকে নাই। কিন্তু দোয়েল গীত আরম্ভ করিয়াছে। ঊষার শীতল বাতাস উঠিয়াছে–গোবিন্দলাল বাতায়নপথ মুক্ত করিয়া, সেই উদ্যানস্থিত মল্লিকা গন্ধরাজ কুটজের পরিমলবাহী শীতল প্রভাতবায়ু সেবনজন্য তৎসমীপে দাঁড়াইলেন। অমনি তাঁহার পাশে আসিয়া একটি ক্ষুদ্রশরীরা বালিকা দাঁড়াইল।

গোবিন্দলাল বলিলেন, “আবার তুমি এখানে কেন?”

বালিকা বলিল, “তুমি এখানে কেন?” বলিতে হইবে না যে, এই বালিকা গোবিন্দলালের স্ত্রী।

গোবিন্দ বলিল, “আমি একটু বাতাস খেতে এলেম, তাও কি তোমার সইল না?”

বালিকা বলিল, “সবে কেন? এখনই আবার খাই খাই? ঘরের সামগ্রী খেয়ে মন উঠে না, আবার মাঠে ঘাটে বাতাস খেতে উঁকি মারেন!”

গো। ঘরের সামগ্রী এত কি খাইলাম?

“কেন, এইমাত্র আমার কাছে গালি খাইয়াছ?”

গোবিন্দ। জান না, ভোমরা, গালি খাইলে যদি বাঙ্গালীর ছেলের পেট ভরিত, তাহা হইলে এ দেশের লোক এতদিনে সগোষ্ঠী বদ হজমে মরিয়া যাইত। ও সামগ্রীটি অতি সহজে বাঙ্গালা পেটে জীর্ণ হয়। তুমি আর একবার নথ নাড়ো, ভোমরা, আমি আর একবার দেখি।

গোবিন্দলালের পত্নীর যথার্থ নাম কৃষ্ণমোহিনী, কি কৃষ্ণকামিনী, কি অনঙ্গমঞ্জরী, কি এমনই একটা কি তাঁহার পিতা—মাতা রাখিয়াছিল, তাহা ইতিহাসে লেখে না। অব্যবহারে সে নাম লোপ প্রাপ্ত হইয়াছিল। তাঁহার আদরের নাম “ভ্রমর” বা “ভোমরা।” সার্থকতাবশতঃ সেই নামই প্রচলিত হইয়াছিল। ভোমরা কালো।

ভোমরা নথ নাড়ার পক্ষে বিশেষ আপত্তি জানাইবার জন্য নথ খুলিয়া, একটা হুকে রাখিয়া, গোবিন্দলালের নাক ধরিয়া নাড়িয়া দিল। পরে গোবিন্দলালের মুখপানে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল,—মনে মনে জ্ঞান, যেন বড় একটা কীর্তি করিয়াছি। গোবিন্দলালও তাহার মুখপানে চাহিয়া অতৃপ্তলোচনে দৃষ্টি করিতেছিলেন। সেই সময়ে, সূর্য্যোদয়সূচক প্রথম রশ্মিকিরীট পূর্বগগনে দেখা দিল–তাহার মৃদুল জ্যোতিঃপুঞ্জ ভূমণ্ডলে প্রতিফলিত হইতে লাগিল। নবীনালোক পূর্বদিক্ হইতে আসিয়া পূর্বমুখী ভ্রমরের মুখের উপর পড়িয়াছিল। সেই উজ্জ্বল, পরিষ্কার, কোমল, শ্যামচ্ছবি মুখকান্তির উপর কোমল প্রভাতলোক পড়িয়া তাহার বিস্ফারিত লীলাচঞ্চল চক্ষের উপর জ্বলিল, তাহার স্নিগ্ধোজ্জ্বল গণ্ডে প্রভাসিত হইল। হাসি–চাহনিতে, সেই আলোতে, গোবিন্দলালের আদরে আর প্রভাতের বাতাসে–মিলিয়া গেল।

এই সময়ে সুপ্তোত্থিতা চাকরাণী মহলে একটা গোলযোগ উপস্থিত হইল। তৎপরে ঘর ঝাঁটান, জল ছাড়ান, বাসন মাজা, ইত্যাদির একটা সপ্ সপ্ ছপ্ ছপ্ ঝন্ ঝন্ খন্ খন্ শব্দ হইতেছিল, অকস্মাৎ সে শব্দ বন্ধ হইয়া, “ও মা, কি হবে!” “কি সর্বনাশ!” “কি আস্পর্ধা!”

“কি সাহস!” মাঝে মাঝে হাসি টিট্কাদরি ইত্যাদি গোলযোগ উপস্থিত হইল। শুনিয়া ভ্রমর বাহিরে আসিল।

চাকরাণী সম্প্রদায় ভ্রমরকে বড় মানিত না, তাহার কতকগুলি কারণ ছইল। একে ভ্রমর ছেলে মানুষ, তাতে ভ্রমর স্বয়ং গৃহিণী নহেন, তাঁহার শাশুড়ী ননদ ছিল, তার পর আবার ভ্রমর নিজে হাসিতে যত পটু, শাসনে তত পটু ছিলেন না। ভ্রমরকে দেখিয়া চাকরাণীর দল বড় গোলযোগ বাড়াইল–

নং ১–আর শুনেছ কি বৌ ঠাকরুণ?

নং ২–এমন সর্বনেশে কথা কেহ কখনও শুনে নাই।

নং ৩–কি সাহস! মাগীকে ঝাঁটাপেটা করে আস্য‍বো এখন।

নং ৪–শুধু ঝাঁটা–বৌ ঠাকরুন–বল, আমি তার নাক কেটে নিয়ে আসি।

নং ৫–কার পেটে কি আছে মা–তা কেমন করে জান্‌বো মা–

ভ্রমরা হাসিয়া বলিল, “আগে বল না কি হয়েছে, তার পর যার মনে যা থাকে করিস।” তখনই আবার পূর্ববৎ গোলযোগ আরম্ভ হইল।

নং ১ বলিল–শোন নি! পাড়াশুদ্ধ গোলমাল হয়ে গেল যে–

নং ২ বলিল–বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!

নং ৩–মাগীর ঝাঁটা দিয়ে বিষ ঝাড়িয়া দিই।

নং ৪–কি বলবো বৌ ঠাকরুণ, বামন হয়ে চাঁদে হাত!

নং ৫–ভিজে বেরালকে চিন‍‍তে জোগায় না।–গলায় দড়ি! গলায় দড়ি!

ভ্রমর বলিলেন, “তোদের।”

চাকরাণীরা তখন একবাক্যে বলিতে লাগিল, “আমাদের কি দোষ! আমরা কি করলাম! তা জানি গো জানি। যে যেখানে যা করবে, দোষ হবে আমাদের! আমাদের আর উপায় নাই বলিয়া গতর খাটিয়ে খেতে এসেছি।” এই বক্তৃতা সমাপন করিয়া, দুই এক জন চক্ষে অঞ্চল দিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। এক জনের মৃত পুত্রের শোক উছলিয়া উঠিল। ভ্রমর কাতর হইলেন–কিন্তু হাসিও সম্বরণ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, “তোদের গলায় দড়ি এই জন্য যে, এখনও তোরা বলিতে পারিলি না যে, কথাটা কি। কি হয়েছে?”

তখন আবার চারি দিক হইতে চারি পাঁচ রকমের গলা ছুটিল। বহু কষ্টে, ভ্রমর, সেই অনন্ত বক্তৃতাপরম্পরা হইতে এই ভাবার্থ সঙ্কলন করিলেন যে, গত রাত্রে কর্তা মহাশয়ের শয়নকক্ষে একটা চুরি হইয়াছে। কেহ বলিল, চুরি নহে, ডাকাতি, কেহ বলিল, সিঁদ, কেহ বলিল, না, কেবল চারি পাঁচ চোর আসিয়া লক্ষ টাকার কোম্পানির কাগজ লইয়া গিয়াছে।

ভ্রমর বলিল, “তার পর? কোন মাগীর নাক কাটিতে চাহিতেছিলি?”

নং ১–রোহিণী ঠাকরুণের–আর কার?

নং ২–সেই আবাগীই ত সর্বনাশের গোড়া।

নং ৩–সেই না কি ডাকাতের দল সঙ্গে করিয়া নিয়ে এসেছিল।

নং ৪–যেমন কর্ম তেমনি ফল।

নং ৫–এখন মরুন জেল খেটে।

ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিল, “রোহিণী যে চুরি করিতে আসিয়াছিল, তোরা কেমন করে জানলি?”

“কেন, সে যে ধরা পড়েছে। কাছারির গারদে কয়েদ আছে।”

ভ্রমর যাহা শুনিলেন, তাহা গিয়া গোবিন্দলালকে বলিলেন। গোবিন্দলাল ভাবিয়া ঘাড় নাড়িলেন।

ভ্র। ঘাড় নাড়িলে যে?

গো। আমার বিশ্বাস হইল না যে, রোহিণী চুরি করিতে আসিয়াছিল। তোমার বিশ্বাস হয়?

ভোমরা বলিল, “না।”

গো। কেন তোমার বিশ্বাস হয় না, আমায় বল দেখি? লোকে ত বলিতেছে।

ভ্র। তোমার কেন বিশ্বাস হয় না, আমায় বল দেখি?

গো। তা সময়ান্তরে বলিব। তোমার বিশ্বাস হইতেছে না কেন, আগে বল।

ভ্র। তুমি আগে বল।

গোবিন্দলাল হাসিল, “তুমি আগে।”

ভ্র। কেন আগে বলিব?

গো। আমার শুনিতে সাধ হইতেছে।

ভ্র। সত্য বলিব?

গো। সত্য বল।

ভ্রমর বলি বলি করিয়া বলিতে পারিল না। লজ্জাবনতমুখী হইয়া নীরবে রহিল।

গোবিন্দলাল বুঝিলেন। আগেই বুঝিয়াছিলেন। আগেই বুঝিয়াছিলেন বলিয়া এত পীড়াপীড়ি করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন। রোহিণী যে নিরপরাধিনী, ভ্রমরের তাহা দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল। আপনার অস্তিত্বে যত দূর বিশ্বাস, ভ্রমর উহার নির্দোষিতায় তত দূর বিশ্বাসঘাতী। কিন্তু সে বিশ্বাসের অন্য কোনই কারণ ছিল না–কেবল গোবিন্দলাল বলিয়াছেন যে, “সে নির্দোষী, আমার এইরূপ বিশ্বাস।” গোবিন্দলালের বিশ্বাসেই ভ্রমরের বিশ্বাস। গোবিন্দলাল তাহা বুঝিয়াছিলেন। ভ্রমরকে চিনিতেন। তাই সে কালো এত ভালবাসিতেন।

হাসিয়া গোবিন্দলাল বলিলেন, “আমি বলিব, কেন তুমি রোহিণীর দিকে?”

ভ্র। কেন?

গো। সে তোমায় কালো না বলিয়া উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে।

ভ্রমর কোপকুটিল কটাক্ষ করিয়া বলিল, “যাও।”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “যাই।” এই বলিয়া গোবিন্দলাল চলিলেন।

ভ্রমর তাঁহার বসন ধরিল–“কোথা যাও?”

গো। কোথা যাই বল দেখি?

ভ্র। এবার বলিব?

গো। বল দেখি?

ভ্র। রোহিণীকে বাঁচাইতে।

“তাই।” বলিয়া গোবিন্দলাল ভোমরার মুখচুম্বন করিলেন। পরদুঃখকাতরের হৃদয় পরদুঃখকাতরে বুঝিল–তাই গোবিন্দলাল ভ্রমরের মুখচুম্বন করিলেন।

Leave a Reply