রোহিণী সকাল সকাল পাককার্য সমাধা করিয়া, ব্রহ্মানন্দকে ভোজন করাইয়া, আপনি অনাহারে শয়নগৃহে দ্বার রুদ্ধ করিয়া গিয়া শয়ন করিল। নিদ্রার জন্য নহে–চিন্তার জন্য।

তুমি দার্শনিক এবং বিজ্ঞানবিদগণের মতামত ক্ষণকাল পরিত্যাগ করিয়া, আমার কাছে একটা মোটা কথা শুন। সুমতি এক দেবকন্যা, এবং কুমতী নামে রাক্ষসী, এই দুই জন সর্বদা মনুষ্যের হৃদয়ক্ষেত্রে বিচরণ করে; এবং সর্বদা পরস্পরের সহিত যুদ্ধ করে। যেমন দুইটা ব্যাঘ্রী, মৃত গাভী লইয়া পরস্পরের যুদ্ধ করে, যেমন দুই শৃগালী, মৃত নরদেহ লইয়া বিবাদ করে, ইহারা জীবন্ত মনুষ্য লইয়া সেইরূপ করে। আজি, এই বিজন শয়নাগারে, রোহিণীকে লইয়া সেই দুই জনে সেইরূপ ঘোর বিবাদ উপস্থিত করিয়াছিল।

সুমতি বলিতেছিল, “এমন লোকেরও সর্বনাশ করিতে আছে?”

কুমতি। উইল ত হরলালকে দিই নাই। সর্বনাশ কই করিয়াছি?

সু। কৃষ্ণকান্তের উইল কৃষ্ণকান্তকে ফিরাইয়া দাও।

কু। বাঃ, যখন কৃষ্ণকান্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে, “এ উইল তুমি কোথায় পাইলে, আর আমাদের দেরাজে আর একখানা জাল উইলই বা কোথা হইতে আসিল,” তখন আমি কি বলিব? কি মজার কথা! কাকাতে আমাতে দুজনে থানায় যেতে বল না কি?

সু। তবে সকল কথা কেন গোবিন্দলালের কাছে খুলিয়া বলিয়া, তাহার পায়ে কাঁদিয়া পড় না? সে দয়ালু অবশ্য তোমাকে রক্ষা করিবে।

কু। সেই কথা। কিন্তু গোবিন্দলালকে অবশ্য সে সকল কথা কৃষ্ণকান্তের কাছে জানাইতে হইবে, নইলে উইলের বদল ভাঙ্গিবে না। কৃষ্ণকান্ত যদি থানায় দেয়, তবে গোবিন্দলাল রাখিবে কি প্রকারে? বরং আর এক পরামর্শ আছে। এখন চুপ করিয়া থাক–আগে কৃষ্ণকান্ত মরুক, তার পর তোমার পরামর্শ মতে গোবিন্দলালের কাছে গিয়া তাঁহার পায়ে জড়াইয়া পড়িব। তখন তাঁহাকে উইল দিব।

সু। তখন বৃথা হইবে। যে উইল কৃষ্ণকান্তের ঘরে পাওয়া যাইবে, তাহাই সত্য বলিয়া গ্রাহ্য হইবে। গোবিন্দলাল সে উইল বাহির করিলে, জালের অপরাধগ্রস্ত হইতে পারে।

কু। তবে চুপ করিয়া থাক–যা হইয়াছে, তা হইয়াছে।

সুতরাং সুমতি চুপ করিল–তাহার পরাজয় হইল। তার পর দুই জনে সন্ধি করিয়া, সখ্যভাবে আর এক কার্যে প্রবৃত্ত হইল। সেই বাপীতীরবিরাজিত, চন্দ্রালোকপ্রতিভাসিত, চম্পকদামবিনির্মিত দেবমূতি আনিয়া, মানস রোহিণীর মানস চক্ষের অগ্রে ধরিল। রোহিণী দেখিতে লাগিল–দেখিতে, দেখিতে, দেখিতে, কাঁদিল। রোহিণী সে রাত্রে ঘুমাইল না।

Leave a Reply