রোহিণীর নিশ্বাস প্রশ্বাস বহিতে লাগিলে, গোবিন্দলাল তাহাকে ঔষধ পান করাইলেন। ঔষধ বলকারক–ক্রমে রোহিণীর বলসঞ্চার হইতে লাগিল। রোহিণী চাহিয়া দেখিল–সজ্জিত রম্য গৃহমধ্যে মন্দ মন্দ শীতল পবন বাতায়নপথে পরিভ্রমণ করিতছে–এক দিকে স্ফটিকাধারে স্নিগ্ধ প্রদীপ জ্বলিতেছে–আর এক দিকে হৃদয়াধারের জীবনপ্রদীপ জ্বলিতেছে। এদিকে রোহিণী, গোবিন্দলাল-হস্ত-প্রদত্ত মৃতসঞ্জীবনী সুরা পান করিয়া, মৃতসঞ্জীবিতা হইতে লাগিল–আর এক দিকে তাঁহার মৃতসঞ্জীবনী কথা শ্রবণপথে পান করিয়া মৃতসঞ্জীবিতা হইতে লাগিল। প্রথমে নিশ্বাস, পরে চৈতন্য, পরে দৃষ্টি, পরে স্মৃতি, শেষে বাক্য স্ফুরিত হইতে লাগিল। রোহিণী বলিল, “আমি মরিয়াছিলাম, আমাকে কে বাঁচাইল?”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “যেই বাঁচাক, তুমি যে রক্ষা পাইয়াছ এই যথেষ্ট।”

রোহিণী বলিল, “আমাকে কেন বাঁচাইলেন? আপনার সঙ্গে আমার এমন কি শত্রুতা যে মরণেও আপনি প্রতিবাদী?”

গো। তুমি মরিবে কেন?

রো। মরিবারও কি আমার অধিকার নাই?

গো। পাপে কাহারও অধিকার নাই। আত্মহত্যা পাপ।

রো। আমি পাপ পুণ্য জানি না–আমাকে কেহ শিখায় নাই। আমি পাপ পুণ্য মানি না– কোন্ পাপে আমার এই দণ্ড? পাপ না করিয়াও যদি এই দুঃখ, তবে পাপ করিলেই বা ইহার বেশী কি হইবে? আমি মরিব। এবার না হয়, তোমার চক্ষে পড়িয়াছিলাম বলিয়া তুমি রক্ষা করিয়াছ। ফিরে বার, যাহাতে তোমার চক্ষে না পড়ি, সে যত্ন করিব।

গোবিন্দলাল বড় কাতর হইলেন; বলিলেন, “তুমি কেন মরিবে?”

“চিরকাল ধরিয়া, দণ্ডে, দণ্ডে, পলে পলে, রাত্রিদিন মরার অপেক্ষা, একেবারে মরা ভাল।”

গো। কিসের এত যন্ত্রণা?

রো। রাত্রি দিন দারুণ তৃষা, হৃদয় পুড়িতেছে–সম্মুখেই শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না। আশাও নাই।

গোবিন্দলাল তখন বলিলেন যে, “আর এ সব কথায় কাজ নাই–চল তোমাকে গৃহে রাখিয়া আসি।”

রোহিণী বলিল, “না, আমি একাই যাইব।”

গোবিন্দলাল বুঝিলেন, আপত্তিটা কি। গোবিন্দলাল আর কিছু বলিলেন না। রোহিণী একাই গেল।

তখন গোবিন্দলাল, সেই বিজন কক্ষমধ্যে সহসা ভূপতিত হইয়া ধূল্যবলুণ্ঠিত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। মাটিতে মুখ লুকাইয়া, দরবিগলিত লোচনে ডাকিতে লাগিলেন, “হা নাথ! নাথ! তুমি আমায় এ বিপদে রক্ষা কর!–তুমি বল না দিলে, কাহার বলে আমি এ বিপদ হইতে উদ্ধার পাইব?–আমি মরিব–ভ্রমর মরিবে। তুমি এই চিত্তে বিরাজ করিও–আমি তোমার বলে আত্মজয় করিব।”

Leave a Reply