রূপো সরিয়া গেলে নিশাকর সোণাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তোমরা বাবুর কাছে কত দিন আছ?”
সো। এই–যত দিন এখানে এসেছেন তত দিন আছি।
নি। তবে অল্পদিনই? পাও কি?
সো। তিন টাকা মাহিয়ানা, খোরাক পোষাক।
নি। এত অল্প বেতনে তোমাদের মত খানসামার পোষায় কি?
কথাটা শুনিয়া সোণা খানসামা গলিয়া গেল। বলিল, “কি করি, এখানে আর কোথায় চাকরি জোটে?”
নি। চাকরির ভাবনা কি? আমাদের দেশে গেলে তোমাদের লুপে নেয়। পাঁচ, সাত, দশ টাকা অনায়াসেই মাসে পাও।
সো। অনুগ্রহ করিয়া যদি সঙ্গে লইয়া যান।
নি। নিয়ে যাব কি, অমন মুনিবের চাকরি ছাড়বে?
সো। মুনিব মন্দ নয়, কিন্তু মুনিব ঠাকরুণ বড় হারামজাদা।
নি। হাতে হাতে তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। আমার সঙ্গে তোমার যাওয়াই স্থির ত?
সো। স্থির বৈ কি।
নি। তবে যাবার সময় তোমার মুনিবের একটি উপকার করিয়া যাও। কিন্তু বড় সাবধানের কাজ। পারবে কি?
সো। ভাল কাজে হয় ত পারবো না কেন?
নি। তোমার মুনিবের পক্ষে ভাল, মুনিবনীর পক্ষে বড় মন্দ।
সো। তবে এখনই বলুন, বিলম্বে কাজ নাই। তাতে আমি বড় রাজি।
নি। ঠাকরু ণটি আমাকে বলিয়া পাঠাইয়াছেন, চিত্রার বাঁধাঘাটে বসিয়া
থাকিতে রাত্রে আমার সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করিবেন। বুঝেছ? আমিও স্বীকার হইয়াছি। আমার অভিপ্রায় যে, তোমার মুনিবের চোখ ফুটায়ে দিই। তুমি আস্তে আস্তে কথাটি তোমার মুনিবকে জানিয়ে আসিতে পার?
সো। এখনি–ও পাপ মলেই বাঁচি।
নি। এখন নয়, এখন আমি ঘাটে গিয়া বসিয়া থাকি। তুমি সতর্ক থেক। যখন দেখ্,বে, ঠাকরুণটি ঘাটের দিকে চলিলেন, তখনি গিয়া তোমার মুনিবকে বলিয়া দিও।রূপো কিছু জানিতে না পারে। তার পর আমার সঙ্গে জুটো।
“যে আজ্ঞে” বলিয়া সোণা নিশাকরের পায়ের ধূলা গ্রহণ করিল। তখন নিশাকর হেলিতে দুলিতে গজেন্দ্রমনে চিত্রাতীরশোভী সোপানবলীর উপর গিয়া বসিলেন।অন্ধকার নক্ষত্রচ্ছায়াপ্রদীপ্ত চিত্রাবারি নীরবে চলিতেছে। চারি দিকে শৃগালকুক্করাদি বহুবিধ রব করিতেছে। কোথাও দূরবর্তী নৌকার উপর বসিয়া ধীবর উচ্চৈঃস্বরে শ্যামাবিষয় গায়িতেছে। তদ্ভিন্ন সেই বিজন প্রান্তর মধ্যে কোন শব্দ শোনা যাইতেছে না। নিশাকর সেইগীত শুনিতেছেন এবং গোবিন্দলালের বাসগৃহের দ্বিতল কক্ষের বাতায়ননিঃসৃত উজ্জ্বল দীপালোক দর্শন করিতেছেন। এবং মনে মনে ভাবিতেছেন, “আমি কি নৃশংস! একজন স্ত্রীলোকের সর্বনাশ করিবার জন্য কত কৌশল করিতেছি! অথবা নৃশংসতাই বা কি? দুষ্টের দমন অবশ্যই কর্তব্য। যখন বন্ধুর কন্যার জীবনরক্ষার্থ এ কার্য বন্ধুর নিকট স্বীকার করিয়াছি, তখন অবশ্য করিব। কিন্তু আমার মন ইহাতে প্রসন্ন নয়। রোহিণী পাপীয়সী, পাপের দণ্ড দিব; পাপস্রোতের রোধ করিব; ইহাতে অপ্রসাদই বা কেন? বলিতে পারি না, বোধ হয় সোজা পথে গেলে এত ভাবিতাম না। বাঁকা পথে গিয়াছি বলিয়াই এত সঙ্কোচ হইতেছে। আর পাপ পুণ্যের দণ্ড পুরস্কার দিবার আমি কে? আমার পাপ পুণ্যের যিনি দণ্ড পুরস্কার করিবেন, রোহিণীরও তিনি বিচারকর্তা। বলিতে পারি না, হয়ত তিনিই আমাকে এই কার্যে নিয়োজিত করিয়াছেন। কি জানি,
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।”
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে রাত্রি প্রহরাতীত হইল। তখন নিশাকর দেখিলেন, নিঃশব্দ পাদবিক্ষেপে রোহিণী আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। নিশ্চয়কে সুনিশ্চিত করিবার জন্য নিশাকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে গা?”
রোহিণীও নিশ্চয়কে সুনিশ্চিত করিবার জন্য বলিল, “তুমি কে?”
নিশাকর বলিল, “আমি রাসবিহারী।”
রোহিণী বলিল, “আমি রোহিণী।”
নি। এত রাত্রি হলো কেন?
রো। একটু না দেখে শুনে ত আসতে পারি নে। কি জানি কে কোথা দিয়ে দেখতে পাবে। তা তোমার বড় কষ্ট হয়েছে।
নি। কষ্ট হোক না হোক, মনে মনে ভয় হইতেছিল যে, তুমি বুঝি ভুলিয়া গেলে।
রো। আমি যদি ভুলিবার লোক হইতাম, তা হলে, আমার দশা এমন হইবে কেন? এক জনকে ভুলিতে না পারিয়া এদেশে আসিয়াছি; আর আজ তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিয়াছি।
এই কথা বলিতেছিল, এমত সময়ে কে আসিয়া পিছন হইতে রোহিণীর গলা টিপিয়া ধরিল। রোহিণী চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে রে?”
গম্ভীর স্বরে কে উত্তর করিল, “তোমার যম।”
রোহিণী চিনিল যে গোবিন্দলাল। তখন আসন্ন বিপদ বুঝিয়া চারি দিক অন্ধকার দেখিয়া রোহিণী ভীতবিকম্পিতস্বরে বলিল, “ছাড়! ছাড়! আমি মন্দ অভিপ্রায়ে আসি নাই। আমি যে জন্য আসিয়াছি, এই বাবুকে না হয় জিজ্ঞাসা কর।”
এই বলিয়া রোহিণী যেখানে নিশাকর বসিয়াছিল, সেই স্থান অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া দেখাইল। দেখিল, কেহ সেখানে নাই। নিশাকর গোবিন্দলালকে দেখিয়া পলকের মধ্যে কোথায় সরিয়া গিয়াছে। রোহিণী বিস্মিতা হইয়া বলিল, “কৈ, কেহ কোথাও নাই যে!”
গোবিন্দলাল বলিল, “এখানে কেহ কোথাও নাই। আমার সঙ্গে ঘরে এস।”
রোহিণী বিষণ্ণচিত্তে ধীরে ধীরে গোবিন্দলালের সঙ্গে ঘরে ফিরিয়া গেল।