গোবিন্দলালের সম্পত্তি তাঁহার ভাগিনেয় শচীকান্ত প্রাপ্ত হইল। শচীকান্ত বয়ঃপ্রাপ্ত।
শচীকান্ত প্রত্যহ সেই ভ্রষ্টশোভ কাননে–যেখানে আগে গোবিন্দলালের প্রমোদোদ্যান ছিল–এখন নিবিড় জঙ্গল–সেইখানে বেড়াইতে আসিত।
শচীকান্ত সেই দুঃখময়ী কাহিনী সবিস্তারে শুনিয়াছিল। প্রত্যহ সেইখানে বেড়াইতে আসিত, এবং সেইখানে বসিয়া সেই কথা ভাবিত। ভাবিয়া ভাবিয়া আবার সেইখানে সে উদ্যান প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিল। আবার বিচিত্র রেলিং প্রস্তুত করিল–পুষ্করিণীতে নামিবার মনোহর কৃষ্ণপ্রস্তরনির্মিত সোপানাবলী গঠিত করিল। আবার কেয়ারি করিয়া মনোহর বৃক্ষশ্রেণী সকল পুঁতিল। কিন্তু আর রঙ্গিল ফুলের গাছ বসাইল না। দেশী গাছের মধ্যে বকুল, কামিনী, বিদেশী গাছের মধ্যে সাইপ্রেস ও উইলো।-প্রমোদভবনের পরিবর্তে একটি মন্দির প্রস্তুত করিল। মন্দিরমধ্যে কোন দেব-দেবী স্থাপন করিল না। বহুল অর্থব্যয় করিয়া ভ্রমরের একটি প্রতিমূর্তি সুবর্ণে গঠিত করিয়া, সেই মন্দিরমধ্যে স্থাপন করিল। স্বর্ণপ্রতিমার পদতলে অক্ষর খোদিত করিয়া লিখিল,
“যে, সুখে দুঃখে দোষে গুণে, ভ্রমরের সমান হইবে, আমি তাহাকে এই স্বর্ণপ্রতিমা দান করিব।”
ভ্রমরের মৃত্যুর বার বৎসর পরে সেই মন্দিরদ্বারে এক সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শচীকান্ত সেইখানেই ছিলেন। সন্ন্যাসী তাঁহাকে বলিলেন, “এই মন্দিরে কি আছে দেখিব।”
শচীকান্ত দ্বার মোচন করিয়া সুবর্ণময়ী ভ্রমরমূর্তি দেখাইলেন। সন্ন্যাসী বলিলেন, “এই ভ্রমর আমার ছিল। আমি গোবিন্দলাল রায়।”
শচীকান্ত বিস্মিত, স্তম্ভিত হইলেন। তাঁহার বাক্যস্ফূর্তি হইল না। কিন্তু পরে বিস্ময় দূর হইল, তিনি গোবিন্দলালের পদধূলি গ্রহণ করিলেন। পরে তাঁহাকে গৃহে লইবার জন্য যত্ন করিলেন। গোবিন্দলাল অস্বীকৃত হইলেন। বলিলেন, “আজ আমার দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাস সম্পূর্ণ হইল। অজ্ঞাতবাস সমাপনপূর্বক তোমাদিগকে আশীর্বাদ করিবার জন্য এখানে আসিয়াছি। এক্ষণে তোমাকে আশীর্বাদ করা হইল। এখন ফিরিয়া যাইব।”
শচীকান্ত যুক্তকরে বলিলেন, “বিষয় আপনার, আপনি ভোগ করুন।”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “বিষয় সম্পত্তির অপেক্ষাও যাহা ধন, যাহা কুবেররও অপ্রাপ্য, তাহা আমি পাইয়াছি। এই ভ্রমরের অপেক্ষাও যাহা মধুর, ভ্রমরের অপেক্ষাও যাহা পবিত্র, তাহা পাইয়াছি। আমি শান্তি পাইয়াছি। বিষয়ে আমার কাজ নাই, তুমিই ইহা ভোগ করিতে থাক।”
শচীকান্ত বিনীতভাবে বলিলেন, “সন্ন্যাসে কি শান্তি পাওয়া যায়?”
গোবিন্দলাল উত্তর করিলেন, “কদাপি না। কেবল অজ্ঞাতবাসের জন্য আমার এ সন্ন্যাসীর পরিচ্ছদ। ভগবৎ-পাদপদ্মে মনঃস্থাপন ভিন্ন শান্তি পাইবার আর উপায় নাই। এখন তিনিই আমার সম্পত্তি–তিনিই আমার ভ্রমর–ভ্রমরাধিক ভ্রমর।”
এই বলিয়া গোবিন্দলাল চলিয়া গেলেন। আর কেহ তাঁহাকে হরিদ্রাগ্রামে দেখিতে পাইল না।