হন্তারক নরদানব
কালোদেড়ে কালগ্রাসে
কালোদেড়ের রোমশ, মদমত্ত ও অমানুষিক দেহ তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে মেনার্ডের ‘রেঞ্জার’ নামক জাহাজের উপরে লাফিয়ে পড়ল এবং তার পিছনে পিছনে অনুসরণ করলে অন্যান্য বোম্বেটেরাও!
হু হুংকারে শোনা গেল তার হিংস্র কণ্ঠে—সংহার! সংহার! হা রে রে রে! শুরু হোক প্রলয়কাণ্ড!
আচম্বিতে পাটাতনের দরজা ঠেলে কৃপাণ তুলে মেনার্ড ও তার সৈন্যদের আবির্ভাব! ব্যাপারটা এতটা অভাবিত যে বোম্বেটেরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত! কিন্তু পলকের মধ্যে নিজেদের হতভম্ব ভাব সামলে নিয়ে তারা সবেগে আক্রমণ করলে—লেগে গেল হাতাহাতি লড়াই! খড়্গে খড়্গে হত্যা-ঝঞ্ঝনা! আগ্নেয়াস্ত্রের ধ্রুম-ধ্রাম! যোদ্ধাদের গর্বিত বাক্যাড়ম্বর!
তারপরেই অন্য জাহাজ থেকেও মেনার্ডের আরও সৈন্য এসে যুদ্ধে যোগদান করে বোম্বেটেদের অবস্থা করে তুললে শোচনীয়। জাহাজের নীচে জলস্রোত, জাহাজের উপরে রক্তস্রোত!
কালোদেড়ে তখনও ভয় পেলে না—তার একহাতে তরবারি, আর-একহাতে পিস্তল! মৃতদের পায়ে মাড়িয়ে এবং জীবিতদের ঠেলে সে যেন প্রলয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে একেবারে মেনার্ডের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিংহগর্জনে বলে উঠল, আরে রে ঘৃণ্য জীব! নরকে যাবার সময় তোকেও আমি ছেড়ে যাব না। বৃহৎ তার রক্তস্নাত কৃপাণ, তাকে ঠেকাতে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল মেনার্ডের তরবারি! আর রক্ষা নেই! উন্মত্তের মতো অট্টহাসি হেসে ও দীপ্ত নেত্ৰে অগ্নিবর্ষণ করে কালোদেড়ের ভীমবাহু আবার তুললে তার সাংঘাতিক অস্ত্ৰ—কিন্তু পরমুহুর্তে একজন নৌসৈন্য ছুটে এসে বন্দুকের কুঁদে দিয়ে তার মাথার উপরে করলে প্রচণ্ড আঘাত!
পাটাতনের উপরে ধড়াম করে আছড়ে পড়ল বোম্বেটে সর্দার। মুহুর্তের মধ্যে চারিদিক থেকে তাকে ছেঁকে ধরলে নৌসৈন্যের দল এবং তরবারি, ছোরা ও বন্দুকের কুদো দিয়ে সবাই অশ্রান্ত ও নিষ্ঠুর ভাবে বিরাট দেহের উপরে করতে লাগল প্রবল আঘাতের পর আঘাত!
কিন্তু কী অসাধারণ তার সহ্যক্ষমতা ও প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি, সেইসব মারাত্মক আঘাতের পরেও সে কাবু হতে চাইলে না, উল্টে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসল এবং তার শেষ পিস্তল তুলে লক্ষ্য স্থির করলে মেনার্ডের দিকে। ওই পর্যন্ত! তার জীবনীশক্তি তখন একেবারে ফুরিয়ে এসেছে, পিস্তল ছোড়বার আগেই সে আবার ধপাস করে পড়ে গেল এবং তার সর্বাঙ্গে জাগল অন্তিম শিহরণ সুদীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে সে প্রাণত্যাগ করলে।
তার কালো দাড়ি তখন রক্তরাঙা, সর্বাঙ্গও রক্তভীষণ। গুণে দেখা গেল, তার দেহের পঁচিশ জায়গায় রয়েছে পঁচিশটা প্রাণনাশক আঘাতের চিহ্ন!
যুবক যোদ্ধা মেনার্ড নিহত বোম্বেটে-সর্দারের প্রকাণ্ড মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন বিস্ময়প্রশংসাপূর্ণ নেত্রে। তাকে অভিভূত করে ফেলেছে তার বন্য সাহস!
কিন্তু অভিভূত হলেও মেনার্ড নিজের প্রতিজ্ঞা ভুললেন না। একজন সৈনিককে ডেকে বললেন, বোম্বেটে-সর্দারের মুণ্ডটা কেটে জাহাজের গায়ে ঝুলিয়ে দাও।
বলা বাহুল্য, সর্দারের পতনের পর হতাশ হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল বাকি বোম্বেটেরাও।
এই ভয়ঙ্কর বোম্বেটে দলকে দমন করে লেফটেনাণ্ট মেনার্ড ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।