ঐতিহাসিক সমগ্র
ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ : ছত্রপতির স্বপ্নভঙ্গ
শিবাজী যে সাম্রাজ্যের প্রাথমিক কাজ শেষ করে গিয়েছিলেন তাঁর বংশধরেরা যদি তার মর্যাদা রক্ষা করতে পারতেন, তাহলে কোথায় থাকত মোগল ও ইংরেজের প্রতাপ—আজ হয়তো ভারতের নীলাকাশের তলায় বাতাসের তালে তালে সগৌরবে উড়ত শিবাজী পরিকল্পিত গৈরিক পতাকা!
কিন্তু তা হয়নি। শিবাজীর দুই পুত্র—শম্ভুজী ও রাজারাম—সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা পিতার প্রতিভা থেকে বঞ্চিত হয়ে কেবল সম্পত্তিরই উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন! তাঁরা ছিলেন শিবাজীর অযোগ্য সন্তান।
গুপ্তবংশীয় প্রথম চন্দ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী হয়ে সমুদ্রগুপ্ত পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত রাজ্যকে পরিণত করেছিলেন এক বিরাট সাম্রাজ্যে। তেমন যুদ্ধপ্রতিভা, বুদ্ধি ও শক্তি শিবাজীর উত্তরাধিকারীদের কারুর ছিল না, তাই ছত্রপতি শিবাজীর প্রসাদে অমন এক সুপরিচালিত ও সুবৃহৎ রাজ্য ও বিপুল বাহিনী হাতে পেয়েও চারিদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ছাড়া তাঁরা আর কিছুই করতে পারেননি। শম্ভুজী তো মোগলের হাতে বন্দি হয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে নিষ্কৃতিলাভ করেননি।
তারপর রাজ্যচালনার ভার পড়ে পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রীদের উপরে। তাঁরা তখন সুযোগ পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন। তাঁদের মনীষা, কূটনীতি ও সামরিক শক্তি শিবাজীর সৃষ্ট রাজ্যকে ক্রমেই আকার বাড়িয়ে ভারতের মধ্যে প্রধান করে তুললে।
তারপর ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া বালাজীর অধীনে মারাঠিদের গৌরব উঠল উন্নতির চরম শিখরে—পেশোয়া বালাজী রাও তাঁর সেনাপতি সদাশিব রাওয়ের সাহায্যে দিল্লি অধিকার করলেন এবং বাদশাহ দ্বিতীয় সাজাহানকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে ঘোষণা করলেন—অতঃপর সম্রাট উপাধিতে ভূষিত হলেন আলি গহর বা দ্বিতীয় শা আলম।
সারা ভারতে জাগ্রত হল অভাবিত বিস্ময়। হিন্দুর কবলগত রাজধানী দিল্লি। সকলে ভাবতে লাগল—আজও নামমাত্র সার হয়ে বাদশাহ বিদ্যমান আছেন বটে, কিন্তু যে প্রবল শক্তি সম্রাটকে সিংহাসনে ওঠাতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সে স্বয়ং প্রভু হয়ে দাঁড়াবে।
ভারতীয় জনসাধারণ স্বপ্নে দেখতে লাগল, আবার এক নূতন হিন্দু ছত্রপতির ছবি।
কিন্তু সে দিবাস্বপ্ন ভেঙে যেতে বিলম্ব হল না। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে আহাম্মদ শা আবদালি শেষ বারের মতো ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রে মারাঠিদের শোচনীয় ভাবে পরাজিত করলেন।
কিন্তু এটা সম্ভবপর হত না যদি পেশোয়া বালাজী রাও স্বয়ং সশরীরে রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন। তাঁর অবর্তমানে প্রধান প্রধান সেনাপতিরা সাংঘাতিক আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে যুদ্ধজয়ের যে কোনও আশাকেই নির্মূল করে দিয়েছিল।
হিন্দুদের সেদিনকার দুর্ভাগ্য স্মরণ করলে মন শিউরে না উঠে পারে না।
কেবল যে বাইশ হাজার স্ত্রী-পুরুষ (মারাঠিদের শিবিরে বহু নারীও ছিল) আফগানদের হাতে বন্দি হল তা নয়, যুদ্ধক্ষেত্র পরিণত হল বিরাট এক মারাঠি শবস্থানে। আঠাশ হাজার মারাঠির মৃতদেহে পানিপথের রণক্ষেত্র পূর্ণ হয়ে গেল। তার উপরে শিবিরে শিবিরেও পাওয়া গেল কত হাজার মৃতদেহ তার সংখ্যা কেউ জানে না। পানিপথ শহরেও আশ্রয় নিতে গিয়ে এক দিনেই মারা পড়ে প্রায় নয় হাজার মারাঠি। বিজেতাদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে যেসব রাস্তা ও জঙ্গল দিয়ে মারাঠিরা পলায়ন করেছিল সেসবও ছেয়ে গেল শবদেহে শবদেহে।
প্রধান সেনাপতি সদাশিব রাও পরাজিত হয়ে রণক্ষেত্রে বারংবার মৃত্যুকে স্মরণ করেও যখন মৃত্যুকে লাভ করলেন না, তখন তাঁর মনে এই দুর্ভাবনাই প্রবল হয়ে উঠেছিল, অতঃপর কেমন করে পুনায় ফিরে পেশোয়াকে তিনি মুখ দেখাবেন!
কিন্তু তাঁর বহুমূল্য পরিচ্ছদ ও রত্নভূষণের দিকে আকৃষ্ট হয়ে একদল আফগান তেড়ে এসে গর্জন করে বললে, ‘এই কাফের, যদি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাস, তাহলে এখনই আত্মসমর্পণ কর!’
কিন্তু পরাজিত সদাশিব নিজের প্রাণ বাঁচাতে চান না, তিনি আত্মসমর্পণ করলেন না। আহত অবস্থায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেই শত্রুদলের মধ্যে অসিহস্তে সিংহবিক্রমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং একাই তিন-চারজন শত্রুর প্রাণবধ করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন।
মারাঠার প্রত্যেক পরিবার থেকে কেউ না কেউ পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
কিন্তু তখনও মারাঠিদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
ছত্রপতি শিবাজীর সঞ্জীবক আদর্শ তখনও জাতির মধ্যে একনায়কত্বের আশা লুপ্ত হতে দেয়নি। কয়েক বৎসর যেতে না যেতেই মারাঠিরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারা আবার ভারতের রাজধানী দিল্লি আক্রমণ ও অধিকার করলে এবং আবার নির্বাসিত বাদশাহ শা আলমকে সঙ্গে করে এনে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল (১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে)।
কিন্তু সে হচ্ছে নেববার আগে প্রদীপের শিখা জ্বলজ্বল করে ওঠার মতো। ব্রিটিশ সিংহ তখন পলাশির যুদ্ধ জিতে শক্তিসঞ্চয় করে প্রবল হয়ে উঠেছে। কিছুদিন যেতে না যেতেই যোদ্ধা ও রাজনৈতিক লর্ড ওয়েলেসলি আবার মারাঠিদের রণক্ষেত্রে অনায়াসে পরাস্ত করে তাদের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ধূলিস্যাৎ করে দিলেন।
তারপর বহুদিন আমাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ব্রিটিশ সিংহ অবশেষে শ্বেতদ্বীপে নিজের ডেরায় পালিয়ে গিয়েছে। ভারত এখন স্বাধীন।
আজ প্রজাতন্ত্রের জয়জয়কার। কেউ আর এখানে ছত্রপতি হতে চায় না, কারণ একনায়কত্বের যুগ বিগত।