» » ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ : দাক্ষিণাত্যে ছত্রপতির আত্মপ্রকাশ

তাঁর নাম শিবাজী। তাঁর প্রতিজ্ঞা ও জীবন-ব্রত ছিল স্বাধীন হিন্দু ভারতবর্ষের পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধার করা।

ঔরঙ্গজিব শিবাজীকে বশীভূত করবার জন্যে নিজের শ্রেষ্ঠ সেনাধ্যক্ষদের প্রেরণ করেছিলেন—কিন্তু কেহই তাঁকে বাগে আনতে পারেননি। এমনকী ভারতবিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ দিলির খাঁকে পর্যন্ত তাঁর হাতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল। শিবাজীকে বন্দি করে স্বয়ং ঔরঙ্গজিবও তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি।

শিবাজীকে একসঙ্গে শক্তিশালী মোগল সাম্রাজ্য, বিজাপুর, পোর্তুগিজ ও ইংরেজ প্রভৃতির সঙ্গে একা লড়তে হয়েছিল, তবু তিনি শেষ পর্যন্ত দুই শত চল্লিশটি দুর্গ দখল করে এবং বিরাট ভূখণ্ড জুড়ে প্রকাণ্ড এক রাজ্য গঠন করতে ও সাত কোটি টাকা বার্ষিক আয়ের অধিকারী হতে পেরেছিলেন—তার উপরে ছিল তাঁর দ্বারা সঞ্চিত বিপুল অর্থ।

শিবাজীর রাজ্য বিস্তৃত ছিল উত্তর দিকে ধমরপুর থেকে দক্ষিণে বোম্বাই প্রদেশের গঙ্গাবর্তী নদীতট পর্যন্ত। পূর্ব দিকে তার সীমার মধ্যে গণ্য হত ভাগলানা, নাসিক ও পুনা প্রদেশ, সমগ্র সাতারা ও কোলহাপুর প্রদেশের অধিকাংশ। শেষের দিকে তিনি পশ্চিম কর্ণাটকের বেলগম থেকে মাদ্রাজের তুঙ্গভদ্রা নদীতীরবর্তী দেশ পর্যন্ত নিজের অধীনে আনতে পেরেছিলেন। মাত্র বাহান্ন বৎসর কয়েক মাস বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু (কারুর কারুর মতে বিষ খাইয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়) না হলে তিনি যে আরও কত দেশ নিজের দখলে আনতে পারতেন সেটা আজ কল্পনাও করা যায় না।

তাঁর ফৌজে ছিল পঁচাশি হাজার অশ্বারোহী ও এক লক্ষ পদাতিক সৈন্য। এবং তাঁর কামানের সংখ্যা ছিল দুই শত। অষ্টপ্রধান বা আটজন মন্ত্রীর (এঁদের মধ্যে মুখ্যপ্রধানকে পেশোয়া বলে ডাকা হত) সাহায্যে তিনি শাসনকার্য চালনা করতেন।

শিবাজী উপলব্ধি করলেন যথানিয়ম অনুসারে অভিষেক না হলে এবং মুকুট না পরলে কেউ তাঁকে মহারাজা বলে মানতে চাইবে না।

শিবাজীকে পেয়ে হিন্দুদের মনেও আশা জেগেছিল যে আবার হিন্দু গৌরবের পুনরুত্থান হবে এবং তারা লাভ করবে স্বরাজ ও নতুন ছত্রপতি।

ছত্রপতি উপাধি ও রাজমুকুট ধারণ করে শিবাজী গুরু রামদাসস্বামী ও মাতা জিজাবাইয়ের চরণে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। পতি পরিত্যক্তা জিজাবাইয়ের সেদিন কী আনন্দ, মৃত্যুর মাত্র বারো দিন আগে তিনি দেখে যেতে পারলেন যে, তাঁর আদরের পুত্র কত শতাব্দীর পর অধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ভারতের প্রথম দিগবিজয়ী ও ছত্রপতি।

অভিষেক মহোৎসবে শিবাজী মুক্তহস্তে অর্থব্যয় করেছিলেন। সারা ভারতের নানা দেশ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে যেসব ব্রাহ্মণ পত্নী ও সন্তানসন্ততি নিয়ে রায়গড়ের উৎসবক্ষেত্রে এসে হাজির হন, তাঁদের মোট সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার। চার মাস ধরে তাঁরা নূতন হিন্দু-ছত্রপতির আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন। সবসুদ্ধ নিমন্ত্রিতের সংখ্যা হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ! অভিষেকের জন্যে খরচ হয়ে গিয়েছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা—এ যুগের হিসাবে তখনকার পঞ্চাশ লক্ষের মূল্য কী অসামান্য হয়ে উঠবে তা অনুমান করতে গেলে বিস্ময়ে হৃদয় পূর্ণ হয়ে যায়।

বহুশতাব্দীব্যাপী ঘৃণ্য অধীনতার অভিশাপ বহন করে সারা ভারতবর্ষ যখন প্রায় জীবন্মৃত হয়ে পড়েছিল, সেই সময়েই সর্বপ্রথমে ছত্রপতি শিবাজী আত্মপ্রকাশ করেন ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের অগ্রদূতের মতো। সমগ্র ভারতের দেশে দেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে জপমন্ত্রের মতো। আধুনিক যুগেও কেউ তাঁকে ভোলেনি।

সুদূর বঙ্গদেশও তাঁকে নিতান্ত আপন বলে মনে করেছে, তাই ‘স্বদেশি’ আন্দোলনের সময়েও তাঁর কাছে প্রেরণা লাভ করে মহাকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্মরণ করে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন—

‘মারাঠির সাথে আজি হে বাঙালি, এক কণ্ঠে বলো

‘জয়তু শিবাজী!

মারাঠির সাথে আজি যে বাঙালি, একসঙ্গে চলো

মহোৎসবে সাজি।

আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পুরব

দক্ষিণে ও বামে

একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব

এক পুণ্য নামে।’