» » ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ : হিন্দুযুগের শেষ ছত্রপতি

তাঁর নাম হর্ষবর্ধন—তাঁর নিজের স্বাক্ষর আজও বিদ্যামান আছে। তা দেখলে জানা যায়, নিজেকে তিনি ‘মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষ’ বলে পরিচিত করতেন। হর্ষবর্ধনের আগে তাঁর বড়ভাই থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তারপরেই তিনি খবর পান যে তাঁর ভগ্নীপতি রাজা গ্রহবর্মণ মৌখারি মালবরাজের হস্তে নিহত হয়েছেন এবং তাঁর সহোদরা রাজ্যশ্রীকেও তিনি বন্দিনী করেছেন। রাজ্যবর্ধন তৎক্ষণাৎ যুদ্ধযাত্রা করে মালবরাজকে পরাজিত ও নিহত করলেন বটে, কিন্তু তারপরেই তিনি নিজেও মধ্যবঙ্গের অধিপতি শশাঙ্কের হস্তে মারা পড়লেন এবং সেই অবসরে রাজ্যশ্রী কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হলেন।

রাজ্যবর্ধনের ছোটভাই হর্ষবর্ধন তখন নানাদিকে খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে দেশে ফিরে আসেন এবং অবশেষে থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন ছয় শত ছয় খ্রিস্টাব্দে। বুদ্ধিমতী ভগ্নী রাজ্যশ্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে হর্ষবর্ধন রাজ্যচালনা করতে থাকেন।

কিন্তু থানেশ্বরের সংকীর্ণ চতুঃসীমার মধ্যে হর্ষবর্ধনের চিত্ত আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাইল না, তাঁর মানসচক্ষে তখন জাগতে লাগল একই ছত্রের ছায়ায় সারা আর্যাবর্তকে এনে ছত্রপতি হওয়ার সমুজ্জ্বল স্বপ্ন। এই সময়ে তাঁর ফৌজে ছিল পাঁচ হাজার গজারোহী, বিশ হাজার অশ্বারোহী এবং পঞ্চাশ হাজার পদাতিক সৈন্য। চিরাচরিত রীতি না মেনে ফৌজ থেকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে তিনি রথারোহী সেনাদের বাদ দিয়েছিলেন।

যুদ্ধের পর যুদ্ধ জিতে এবং দেশের পর দেশ হস্তগত করে অবশেষে হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তরাপথের উপরে উড়িয়ে দিলেন বিজয় পতাকা। তাঁর সৈন্যসংখ্যাও যথেষ্ট বেড়ে উঠল। তারপর তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হলেন—ভারতবর্ষে আর কোনও বিক্রমশালী রাজার অস্তিত্ব তাঁর পক্ষে অসহনীয়। দাক্ষিণাত্যের সর্বপ্রধান নরপতি ছিলেন চালুক্যবংশের দ্বিতীয় পুলকেসিন। তিনি আগে থাকতেই সাবধান হয়ে আটঘাট বেঁধে বসেছিলেন, সে বাধা এড়িয়ে দক্ষিণ দিকে আর এগুতে না পেরে হর্ষবর্ধন বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন (৬২০ খ্রিস্টাব্দে)।

তারপর তাঁর শেষ যুদ্ধ হচ্ছে গাঞ্জামের বিরুদ্ধে। সাঁইত্রিশ বৎসর ধরে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে অবশেষে হর্ষবর্ধন তরবারি কোশবদ্ধ করলেন। তারপর সম্রাট অশোকের অনুকরণে শান্তির মন্ত্র পাঠ করতে করতে তাঁর বাকি জীবনের কয়েকটা বছর কেটে গেল।

সমুদ্রগুপ্তের মতো হর্ষবর্ধনও ছিলেন যোদ্ধা হয়েও উচ্চশ্রেণির কবি। সমুদ্রগুপ্তের কোনও রচনা আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু হর্ষবর্ধনের ‘নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ নামে তিনখানি নাটকীয় রচনা আজও সংস্কৃত সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে আছে। কবি বাণ ছিলেন তাঁর সভাকবি।

কিন্তু শান্তির মন্ত্র পাঠ করেও হত্যাকারীর কবল থেকে হর্ষবর্ধন আত্মরক্ষা করতে পারেননি। তিনি নিহত হন ৬৪৬ কি ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে।

হর্ষবর্ধনের প্রায় দেড় শতাব্দীর পর বঙ্গবীর ধর্মপাল বিপুল সাম্রাজ্য গঠন করে ছত্রপতি রূপে সুদীর্ঘ চৌষট্টি বৎসর কাল রাজদণ্ড ধারণ করেছিলেন বটে, কিন্তু ধর্মে তিনি হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন বৌদ্ধ এবং সেইজন্যেই তাঁর কাহিনি এখানে বলা হল না। তবু প্রসঙ্গসূত্রে বলতে পারি, বাংলার এই বীর সন্তানের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তরে দিল্লি ও পাঞ্জাবের জলন্ধর এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য গিরিশ্রেণির উপত্যকা পর্যন্ত। ধর্মপাল ও তাঁর বংশধররা সাড়ে চার শতাব্দী ধরে রাজ্যচালনা করে বঙ্গদেশকে ভারতের অন্যতম প্রধান দেশ বলে পরিচিত করেছিলেন, এ তথ্যও উল্লেখযোগ্য।

পালবংশের পর আর কোনও স্বদেশি ও হিন্দু রাজবংশ আর্যাবর্তের উপরে একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করতে পারেনি।

নামে আর্যাবর্ত, কিন্তু সেখানে আর্যদের প্রভুত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল—কেবল বিতাড়িত শক ও হুনের দল রাজস্থানে আশ্রয় নিয়ে, হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের চন্দ্র ও সূর্যবংশীয় রাজপুত বলে প্রচার করে বহুকাল পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করেছিল।

আর্যাবর্তের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মধুলোভী বোলতার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আরব, তুর্কি, পারসি, আফগান ও মোগল প্রভৃতি। মোগলেরা ও আফগানদের অনেকেই হিন্দুদের বুকে বসে ভারতকেই স্বদেশ বলে গ্রহণ করলে, কিন্তু তারপর ইউরোপ থেকে যারা আসতে আরম্ভ করলে তাদের বিদেশি লুণ্ঠনকারী দস্যু ভিন্ন আর কিছুই বলা যায় না।

প্রথমে এল পোর্তুগিজরা, তারপর ওলন্দাজরা, তারপর ফরাসি। কিন্তু সর্বশেষে ইংরেজরা ছলে-বলে-কৌশলে সর্বগ্রাস করে গোটা ভারতবর্ষকে বিরাট এক গোলামখানায় পরিণত করলে।

কিন্তু সেটা কি সম্ভবপর হত? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হচ্ছে, না। কেন, এইবারে তাই বলছি।

ঔরঙ্গজিবের রাজত্বকালে যখন মোগলদের গৌরবসূর্য নিস্তেজ হওয়ার কোনও লক্ষণই প্রকাশ পায়নি, যখন দুর্ধর্ষ আফগান ও রাজপুতদেরও অনেকেই মোগলের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, সেই সময়েই সপ্তদশ শতাব্দীর উত্তরার্ধে দাক্ষিণাত্যের আর-একজন হিন্দু বীর ভারতের অনেক অংশকে স্বাধিকারে এনে নিজেকে ছত্রপতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরলোকগমনের পর আর কেউ এই মহান অবদানের গৌরব রক্ষা করতে পারেনি। বিধর্মীর অধীন ভারতবর্ষে তখন আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যকে কেউ আর আলাদা করে দেখত না।