» » ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ : সূর্যোদয়ের ছত্রপতি

নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের পর সমুজ্জ্বল সূর্যোদয়! প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর রাজদণ্ড ধারণ করলেন তাঁরই পুত্র সমুদ্রগুপ্ত—ইংরেজ ঐতিহাসিক যাঁর নাম দিয়েছেন ‘ভারতীয় নেপোলিয়ন’।

সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর পতাকার সামনে মস্তক নত করতে বাধ্য হয়। আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতে রাজত্ব করতেন তখন প্রধান নয়জন মহারাজা। সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের প্রত্যেককেই পরাজিত করেন এবং তার ফলে তাঁর রাজ্য পরিণত হয় সাম্রাজ্যে—সম্রাট অশোকের পর এত বড় সাম্রাজ্যের অধিকারী হননি আর কোনও ভারতীয় নরপতি—তার পশ্চিম দিকে ছিল আরব সাগর এবং পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর।

কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত তবু তরবারি কোশবদ্ধ করলেন না, সসৈন্যে যাত্রা করলেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। তারপর দেশের পর দেশ জয় করে দাক্ষিণাত্য উজাড় করে কল্পনাতীত ধনরত্ন নিয়ে আবার দেশে ফিরে এলেন এবং দিগবিজয়ী রূপে পৌরাণিক অশ্বমেধ যজ্ঞের পুনরানুষ্ঠান করলেন। সমগ্র ভারতবর্ষের উপরে নিজের জয়পতাকা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁকে দুই বৎসরের মধ্যে দুই থেকে তিন হাজার মাইল অতি দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়। সম্ভবত সমগ্র ভারতে যুদ্ধজয়ী হয়ে সমুদ্রগুপ্ত স্বদেশে ফিরে আসেন তিন শত পঞ্চাশ খ্রিস্টাব্দে এবং আর্যাবর্তের পৌরাণিক সম্রাটদের মতো ছত্রপতি রূপে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন।

সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি বলেছেন, তিনি গানে এবং বাজনায় এবং কবিতা রচনায় সুনিপুণ ছিলেন। উপরন্তু তাঁর ছন্দসম্বন্ধীয় রচনাও আছে অনেকগুলি। তাঁর একটি দুর্লভ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায় তাতে দেখি, সমুদ্রগুপ্তের পরনে হাত-কাটা ও হাঁটুর উপর পর্যন্ত বিস্তৃত পোশাক। অনেকটা একেলে চেয়ারের মতন আসনে উপবিষ্ট হয়ে তিনি বীণাবাদনে নিযুক্ত। বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে শাস্ত্র, সংগীত ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করে তিনি প্রভূত আনন্দ লাভ করতেন। বেশ বোঝা যায়, যুদ্ধের সঙ্গে কাব্য ও ললিতকলার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন এক প্রতিভাধর পুরুষ। এমন সর্বোত্তম প্রতিভার অধিকারী দিগবিজয়ী পৃথিবীর আর কোনও দেশে দেখা যায়নি।

সমুদ্রগুপ্তের পরলোক গমনের পর তাঁর পুত্র গুপ্তবংশীয় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নামে সিংহাসনে বসে বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন এবং তিনিই হচ্ছেন চলতি ভারতীয় কথা ও কাহিনিতে প্রসিদ্ধ রাজা বিক্রমাদিত্য। তিনিও ছিলেন যোদ্ধা, ভারত থেকে শক প্রভুত্ব একেবারে বিলুপ্ত করে দেন। কিন্তু ছত্রপতির সম্মান লাভ করবার যোগ্য হলেও তাঁর বা গুপ্তবংশীয় আর কোনও সম্রাটের কীর্তি নিয়ে এখানে আলোচনা করব না, কারণ বিন্দুসার ও অশোকের মতো তাঁরাও সমুদ্রগুপ্তের দ্বারা সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিলেন।

প্রায় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত আর্যাবর্তে গুপ্তবংশের প্রভুত্ব বজায় থাকে। ওই সময়েই রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ভারত কাব্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যে এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্য নানা ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হয়েছিল। তারপরেই এখানে উপদ্রব আরম্ভ করে বিভীষণ ও নৃশংস হুন অত্যাচারীর দল। ভারত তখন আবার ছোট-বড় নানা রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সেখানে আর কেহই ছত্রপতি উপাধি অর্জন করবার অধিকারী হননি। তারপর সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুখেই দেখতে পাই আর একজন এমন বীরপুরুষকে, যিনি আর্যাবর্তের উপরে আপন বিজয়পতাকা উত্তোলন করে আবার ছত্রপতি আখ্যালাভের যোগ্য হতে পেরেছিলেন।