» » ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ : ভারতের প্রথম ছত্রপতি

কিন্তু গ্রিক দিগবিজয়ীকে মগধ রাজ্য জয় না করেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে হল।

কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্য দখল করবার পর আলেকজান্ডার রাজা পুরুকে হারিয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধু অধিকার করলেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী হলেও পুরুকে একজন প্রাদেশিক রাজা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। সুবৃহৎ মগধ রাজ্য অধিকার না করা পর্যন্ত ভারত-বিজেতা রূপে গৌরব অর্জন করা সম্ভব নয় (মগধ বলতে তখন বোঝাত উত্তর ও দক্ষিণ বিহার, বেনারস, কোশল ও অঙ্গ রাজ্য নিয়ে গঠিত বিপুল এক দেশ)।

অতএব আলেকজান্ডার মগধের দিকে সৈন্য চালনা করতে উদ্যত হলেন।

কিন্তু সমস্ত গ্রিক সৈন্য—এমনকী সেনাপতিরাও একেবারে বেঁকে দাঁড়াল—কারণ তারা খবর পেয়েছিল যে, মহাপদ্ম নন্দের অধীনে আছে আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার রথারোহী (তার মানে ষোলো হাজার যোদ্ধা—কারণ প্রত্যেক রথের উপরে থাকত দুইজন করে যোদ্ধা), এবং ছয় হাজার গজারোহী (অর্থাৎ আঠারো হাজার যোদ্ধা—কারণ প্রত্যেক হস্তির উপরে থাকত তিন জন করে যোদ্ধা) সৈনিক।

আলেকজান্ডার বহু চেষ্টার পরেও তাদের মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার করতে না পেরে অবশেষে হতাশ হয়ে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হলেন। গ্রিক ঐতিহাসিকেরই মতে, সে প্রত্যাবর্তন পলায়নেরই নামমাত্র—তাঁর ভারত জয় করা আর হল না।

আলেকজান্ডারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল না বটে, কিন্তু সফল হল চন্দ্রগুপ্তের স্বপ্ন।

তিনি উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে বিপুল এক বাহিনী গঠন করে মহাপদ্ম নন্দকে পরাজিত ও নিহত করে মগধের সিংহাসন অধিকার করলেন (৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। তাঁর অধীনে মগধের সৈন্যবল আরও বেড়ে উঠল—তিরিশ লক্ষ অশ্বারোহী, ছয় লক্ষ পদাতিক, আরোহী সুদ্ধ নয় হাজার রণহস্তী এবং অসংখ্য রথ।

তারপর তিনি সমস্ত গ্রিকদের তাড়িয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ পুনরধিকার করলেন। ভারত বিদেশিদের নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত!

তখন আলেকজান্ডার আর ইহলোকে বিদ্যমান নেই। তাঁর অন্যতম প্রধান সেনাপতি সেলিউকস ফিরে ফিরতি পাঞ্জাব ও সিন্ধু অধিকার করতে এসে বীর্যবন্ত চন্দ্রগুপ্তের কাছে খালি হেরেই গেলেন না, উপরন্তু বাধ্য হয়ে ভারতের বাইরেকার আরও কয়েকটি দেশ ছেড়ে দিয়ে নিজের কন্যাকেও তাঁর হাতে সম্প্রদান করলেন।

মাত্র আঠারো বৎসরের মধ্যে প্রায় অসম্ভবকেও সম্ভব করে চন্দ্রগুপ্ত যে বিরাট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলেন তার একদিকে ছিল বঙ্গোপসাগর এবং অন্যদিকে বইত আরব সাগর। চন্দ্রগুপ্তই ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বা ছত্রপতি।

আর্যাবর্তকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন করে চন্দ্রগুপ্ত মাত্র ছয় বৎসর রাজত্ব করে পুত্র বিন্দুসারের হাতে রাজ্যভার দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করে প্রায়োপবেশনে বা অনশনে প্রাণত্যাগ করেন (২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। কথিত আছে পরে তিনি জৈনধর্ম অবলম্বন করেছিলেন।

সেলিউকসকে হারিয়ে চন্দ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিম দিকে ভারতের সীমা যতদূর বাড়াতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা নিজেদের চূড়ান্ত গৌরবের যুগেও তা পারেনি। বিদেশি ঐতিহাসিকরা বলেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতিদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করা চলে।

যুবরাজ বিন্দুসার যখন সম্রাট হয়ে সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত করেছিলেন দক্ষিণ দিক পর্যন্ত, তখন বোঝা যাচ্ছে তিনিও ছিলেন একজন বড় যোদ্ধা। তাঁর পুত্র মহামতি অশোক শান্তির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পৃথিবীর রাজাদের মধ্যে অতুলনীয় হয়ে আছেন। এঁরাও ছিলেন ছত্রপতি, কিন্তু পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারী হয়ে সবদিক দিয়ে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য হাতে না পেলে তাঁরা এতটা বড় হতে পারতেন না বলেই মনে হয়। কাজেই চন্দ্রগুপ্তের পর আর কোনও মৌর্য রাজার কথা না বললেও চলবে।

ছত্রপতি অশোকের পরেই মৌর্য বংশের প্রাধান্য লুপ্ত হয়। আর একজন ছত্রপতির জন্যে বহু কাল অপেক্ষা করবার পর (১২০ খ্রিস্টাব্দ) সিংহাসনে উপবিষ্ট হলেন কুশান রাজবংশীয় সম্রাট কণিষ্ক। কিন্তু তাঁর কথা এখানে বলব না, কারণ তিনি বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করলেও বিজাতীয় শক ছিলেন।

কণিষ্কের অপঘাত-মৃত্যুর পর (১৬০ খ্রিস্টাব্দ) আরও কিছুকাল পর্যন্ত শক সম্রাটেরা রাজত্ব করেন (২২০ খ্রিস্টাব্দ)। তারপরেই তাঁদের প্রভুত্ব লুপ্ত হয় এবং নেমে আসে ঘনীভূত অন্ধকারের যবনিকা—তা ভেদ করে কিছুই দেখা যায় না। তারপর চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমেই দেখা যায় মগধের সিংহাসনে উপবিষ্ট গুপ্তবংশীয় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তাঁকে প্রাদেশিক রাজা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।