ঐতিহাসিক সমগ্র
বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : আট
নিজের পটগৃহে বসে বেয়ল লোকমুখে ফরাসিপক্ষের হতাহতের খবরাখবর নিলেন।
ফরাসিদের পঁচাত্তর জন সৈনিক মৃত্যুমুখে পড়েছে। আহতদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মৃতদের মধ্যে ছিলেন বাক্যবাগীশ কাপ্তেন আউডার্ডও। প্রত্যাবর্তনের সময়ে বীরাঙ্গনাদের একটা অব্যর্থ বাণ এ-জীবনের মতো তাঁর মুখর মুখ মৌন করে দিয়ে গেছে!
আচমকা তাঁবুর একটা ছায়াময় প্রান্ত থেকে গর্জিত কণ্ঠস্বরে শোনা গেল—’ওরে ফরাসি শূকর, আজ আর আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই।’
সবিস্ময়ে বেয়ল কয়েক পদ পিছিয়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়াল ক্রোধভীষণা, দীপ্তনয়না নান্সিকা স্বয়ং। ধনুকে যোজন করেছে সে এক শাণিত তির। একান্ত অভাবিত দৃশ্য।
বেয়ল লাফ মেরে একটা রিভলভার হস্তগত করলেন, কিন্তু সেটা ব্যবহার করবার আগেই নান্সিকার নিক্ষিপ্ত তির এসে তাঁর স্কন্ধদেশ বিদীর্ণ করলে, মাটির উপরে পড়ে গেল রিভলভারটা।
হিংস্র জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নান্সিকা ক্ষিপ্রহস্তে চকচকে ছোরা তুলে তাঁকে আঘাত করতে গেল, কিন্তু বিদ্যুৎবেগে পাশ কাটিয়ে বেয়ল সে চোট সামলে নিয়ে একলাফে গিয়ে পড়লেন নান্সিকার উপরে—ধাক্কার চোটে তার হাত থেকে ছোরাখানা মাটির উপরে পড়ে গেল ঝনঝন শব্দে। পরমুহূর্তে গৃহতলে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন দুজনেই—নীচে বেয়ল, উপরে নান্সিকা।
হাঁটু দিয়ে নান্সিকা এত জোরে বেয়লের তলপেটে আঘাত করলে যে তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়তে পড়তে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিলেন।
তারপর চোখের নিমেষে মাটির উপর থেকে একরাশ ধুলো তুলে নিয়ে তিনি ছুড়ে মারলেন নান্সিকার চোখে। মুহূর্তের জন্যে নান্সিকা অন্ধ!
সেই অবসরে শত্রুর হাত ছাড়িয়ে বেয়ল টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের তরবারিখানা টেনে নিলেন, কিন্তু ততক্ষণে নান্সিকাও চকিতে আবার তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরবারিসুদ্ধ হাত সজোরে চেপে ধরলে। এবং কী আশ্চর্য শক্তির অধিকারিণী এই বীরনারী, তার প্রবল হাতের চাপে বেয়লের শিথিল মুষ্টি থেকে খসে পড়ল তরবারিখানা।
নান্সিকা যেই হেঁট হয়ে তরবারি কুড়িয়ে নিতে গেল, বেয়ল দিলেন তাকে এক প্রচণ্ড ঠেলা। পরমুহূর্তেই নিজের কোমরবন্ধ থেকে বার করে ফেললেন দ্বিতীয় একটা রিভলভার।
চরম আঘাত হানবার জন্যে নান্সিকা তরবারি খুলে তেড়ে এল তিরবেগে।
বেয়লের রিভলভার গর্জন করলে একবার, দুবার।
নান্সিকার দেহ হল ভূতলশায়ী।
বাহির থেকে ফরাসি সৈনিকরা তিরবেগে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করল—সকলের পিছনে পিছনে টেরিলন।
হাঁপাতে হাঁপাতে ম্লান হাসি হেসে বেয়ল বললেন, ‘আজ আমি মূর্তিমতী মৃত্যুর কবলে গিয়ে পড়েছিলুম।’ তারপর বিবশ হয়ে বসে পড়লেন।