ঐতিহাসিক সমগ্র
বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : সাত
বেয়ল বললেন, ‘এবারে ওরা সহজে ছাড়বে না, মরণ-কামড় দেবার চেষ্টা করবে!’
আবার শুরু হয়ে গেল কামান-বন্দুকের বজ্র-হুংকার! কিন্তু নারী-ফৌজের অগ্রগতি বন্ধ হল না—সারির পর সারি বন্যা-তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল ফরাসি-ব্যুহের উপরে। ফরাসিদের অগ্নিবৃষ্টির তোড়ে হতাহত শত্রুরা যেখানে-সেখানে পঙক্তির মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি করে, সেখানেই নতুন নতুন রণরঙ্গিণী আবির্ভূত হয়ে ফাঁক ভরিয়ে তোলে। নিক্ষিপ্ত বল্লম ও তিরের আঘাতেও ফরাসি সৈনিকরা রক্তাক্ত পৃথিবীর উপরে লুটিয়ে পড়ে। শত শত সঙ্গিনীর মৃত্যুও আহোসিদের সেই ভয়াবহ অগ্রগতি রুদ্ধ করতে পারলে না—তাদের কাছে মৃত্যু যেন ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য নয়! যত লোক মরে, তত যেন বাড়ে বীরবালাদের মরণানন্দ!
বেয়ল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ওরা উন্মাদিনী, ওরা হার মানতে জানে না!’
আচম্বিতে জেনারেল টেরিলন মাটির উপরে আছাড় খেয়ে পড়লেন, তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ হয়েছে তাঁর ঊরুদেশ। একহাতে বাণটাকে ক্ষতস্থান থেকে টেনে বার করতে করতে নিজের ধূমায়িত রিভলভার তুলে তিনি সমানে গুলি চালাতে লাগলেন।
সামনেকার অংশের খানিকটা বিচ্ছিন্ন করতে পেরে বীরাঙ্গনারা ব্যূহের গভীরতম অংশে ঢুকে পড়বার জন্যে আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে লাগল। যত আক্রমণ ব্যর্থ হয়, তত তাদের জেদ বেড়ে ওঠে—যেন হাজার জন প্রাণ দিলেও তারা আক্রমণ করতে ছাড়বে না। কিন্তু অসম্ভব সম্ভব হল না, ফরাসি কামানগুলো অজস্র অগ্নিময় গোলা নিক্ষেপ করে তাদের ঠেকিয়ে রাখলে শেষ পর্যন্ত। অসংখ্য নারী-সৈনিকের মৃতদেহ স্তূপীকৃত হয়ে উঠল রণক্ষেত্রে।
তারপর আচম্বিতে! দূর থেকে রাজা বেহানজিনের রণশিঙা বেজে উঠে আজকের মতো যুদ্ধে সমাপ্তিঘোষণা করলে। একমুহূর্তে, একসঙ্গে প্রত্যেক নারী-সৈনিক ফিরে দাঁড়িয়ে রণক্ষেত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল দুঃস্বপ্নের মতো।
রাজার আদেশ অমোঘ!
বেয়ল বললেন, ‘রাজার হুকুম না পেলে ওরা এখনও আমাদের ছাড়ত না।’
তিরটা উপড়ে ফেলে ক্ষতস্থানে ‘ব্যান্ডেজ’ বাঁধতে বাঁধতে টেরিলন বললেন, ‘তবু ওরা আমাদের কখনওই হারাতে পারত না।’
বেয়ল মুখে মত জাহির করলেন না, কিন্তু মনে মনে বললেন, উদ্ধত! নির্বুদ্ধির ঢেঁকি!
রক্তগঙ্গা বয়ে-যাওয়া মৃত্যুভীষণ রণক্ষেত্রের দিকে তিনি দৃষ্টিপাত করলেন। আন্দাজি হিসাবে তাঁর মনে হল ওখানে পড়ে আছে অন্তত একহাজার বীরাঙ্গনার শবদেহ।
তিনি পা চালাতে চালাতে বললেন, ‘টেরিলন, খানিকটা মদ না হলে আমার আর চলবে না। আমি নিজের তাঁবুতে যাচ্ছি।’
টেরিলন বললেন, ‘আমিও শীঘ্রই তোমার কাছে গিয়ে বিজয়োৎসবে যোগদান করব।’