» » বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : ছয়

নিজের বস্ত্রাবাসে প্রবেশ করে বেয়ল ক্রুদ্ধস্বরে আবার বললেন, ‘নির্বোধ মূর্খের দল!’

খানিকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম এল না। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাত সাড়ে চারটা।

শয্যায় উঠে বসে নিজের দুটো রিভলভারের কলকবজা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলেন! চোখ তুলে লক্ষ করলেন দেওয়ালে যথাস্থানেই ঝুলছে শক্তিশালী বন্দুকটা—আট-আটটা টোটায় ভরা।

নিজের মনে-মনেই বললেন, ‘হয়তো আউডার্ডের মত ভ্রান্ত নয়।—প্রস্তুত হয়ে থাকো, আহোসিদের কাছে আসতে দাও, তারপর বন্দুক ছুড়ে ভূমিসাৎ করো! একমাত্র আশার কথা এই যে বেশির ভাগ রায়বাঘিনীর হাতেই বন্দুক নেই। ধনুক, বর্শা, তরবারি,—বন্দুকের সামনে ও-সব তো খোকাখুকির খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়! তবে মুশকিলের কথাও আছে। রায়বাঘিনীরা দলে ভারী!’

ধ্রুম, ধ্রুম, ধ্রুম ধ্রুম। আচম্বিতে বন্দুকের পর বন্দুকের গর্জন!

একলাফে শয্যা ছেড়ে বেয়ল বলে উঠলেন, ‘তারা আসছে, তারা আসছে, তারা আসছে!’

তাড়াতাড়ি পটমণ্ডপের বাইরে বেরিয়ে পড়ে বেয়ল মুখ তুলে দেখলেন, পূর্ব-নাট্যশালায় মহিমময়ী উষার শ্বেতপদ্মের মতো শুভ্র আলোর পাপড়ি ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে।

বেয়ল বললেন, ‘জানি, আমি জানি! এই তো আহোসিদের আক্রমণের মাহেন্দ্রক্ষণ!’

বন্দুকের গুড়ুম-গুড়ুম শব্দে জেনারেল টেরিলনেরও ঘুম ভেঙে গেল সচমকে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে একটা বাঁশিতে জোরে ফুঁ দিয়ে করলেন উচ্চ সংকেতধ্বনি!

তৎক্ষণাৎ কোথা থেকে বেজে উঠল রণতূর্য। সঙ্গে সঙ্গে কামানগুলোর মুখে মুখে জাগল আরক্ত আলোকচমক ও গুরু গুরু বাজের ধমক। আউডার্ড ও মুসেট ছুটে যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন—অন্যান্য সৈনিকরাও শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দখল করলে নিজের নিজের জায়গা।

খ্যাঁক খ্যাঁক করে ক্রুদ্ধস্বরে টেরিলন বলে উঠলেন, ‘পাজী জানোয়ারের দল! আমাকে জুতো পরবারও সময় দিলে না!’

অধিকাংশ রণরঙ্গিনীরই সম্বল বল্লম ও তিরধনু বটে, তবে অনেকের হাতে বন্দুকও ছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে বাণের সঙ্গে গরমাগরম বুলেটও ছুটোছুটি করতে লাগল ঘৃণিত ইউরোপীয়দের শ্বেত অঙ্গ ছিদ্রময় করবার জন্যে।

কাটা গাছের গুঁড়ি ও বালিভরা থলের আড়ালে আত্মগোপন করে বেয়লও বন্দুক তুলে বুলেট-বৃষ্টি করতে লাগলেন।

এক জায়গায় সুযোগ পেয়ে একদল রায়বাঘিনী ফরাসি ফৌজের মাঝখানে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করলে, ফরাসিদের প্রচণ্ড অগ্নি-বৃষ্টিকে তারা একটুও আমলে আনলে না।

ব্যাপার ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠল। বার্তাবহ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে নতুন বিপদের খবর জানালে।

টেরিলন চিৎকার করে বললেন, ‘হা ভগবান! আহোসিরা আমাদের একটা কামান কেড়ে নিয়েছে! আমাদের একজন সৈনিকেরও মাথা কাটা গিয়েছে!’

বেয়ল বললেন, ‘নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছিল। যেমন কর্ম তেমনি ফল!’

তেড়ে এল এক ঝাঁক চোখা চোখা বাণ, চটপট সেখান থেকে চম্পট দিলেন টেরিলন! বেয়ল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন।

রায়বাঘিনীদের আর একটা দল ধেয়ে এল—ফরাসিদের কামানগুলো করলে প্রচণ্ড অগ্নিবৃষ্টি।

হতাহত হয়ে একটা দল ভেঙে যায়—কিন্তু তুরন্ত তেড়ে আসে নতুন আর একটা দলের শত শত বীরাঙ্গনা! তাদের মরণভয় নেই—তারা মরতে মরতেও মারতে চাইবে!

দৌড়োতে দৌড়োতে মুসেট ডাকলেন, ‘গভর্নর বেয়ল! গভর্নর—’ কথা আর শেষ হল না—শোনা গেল ধনুকের টংকার শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে তরুণ মুসেটের দেহ পপাত ধরণীতল! একটা বাণ তাঁর কণ্ঠে এবং আর একটা বাণ বিদ্ধ হয়েছে তাঁর চক্ষে!

জন ছয় নারী-যোদ্ধা খনখনে গলায় চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বল্লম উঁচিয়ে ফরাসি ব্যুহের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরিয়ার মতো।

বেয়ল বন্দুকের কুঁদোর চোটে একজনের মাথা চুরমার করে দিলেন, গুলি করে মেরে ফেললেন আর একজনকে এবং তৃতীয় তরুণীকে ধরাশায়ী করলেন বেওনেটের খোঁচায়। চতুর্থ ও পঞ্চম জন মারা পড়ল অন্যান্য সৈনিকের কবলে। ষষ্ঠজনও পালিয়ে যেতে যেতে মরণাহত হয়ে মাটির উপরে আছড়ে পড়ল।

আপাতত এই পর্যন্ত।

বেহানজিনের দ্বারা প্রেরিত প্রথম দলের আক্রমণ ব্যর্থ।

বেয়ল বললেন, ‘হে ভগবান, আবার যদি আক্রমণ হয় তাহলে আমাদের আর রক্ষা নেই!’ মাথার ঘাম মুছতে মুছতে ভীরু চোখ বুলোতে লাগলেন এদিকে-ওদিকে। শিবিরের উপরে বারুদের ধোঁয়া জমে আছে মেঘের মতো।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বেয়ল চারদিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। মাঠ ছেয়ে আছে নারী-সৈনিকদের শত-শত আড়ষ্ট মৃতদেহে। ফরাসি সৈনিকদের দেহও দেখা যাচ্ছে এখানে-ওখানে। সেই মর্মন্তুদ রক্তরঞ্জিত দৃশ্যের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তিনি মনে মনে বললেন,—আহোসিরা যে খেলাঘরের সেপাই নয়, আশা করি টেরিলন এতক্ষণে তা দস্তুরমতো সমঝে নিয়েছে!

হ্যাঁ, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। যে কামানটা আহোসিরা কেড়ে নিয়েছিল, সেটা আবার দখল করবার জন্যে টেরিলন পাঠিয়েছিলেন চল্লিশ জন ফরাসি সৈনিক। কামানটা পুনরধিকার করে তারা ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু পিছনে মাঠের উপরে রেখে এসেছে আঠারো জন সঙ্গীর মৃতদেহ।

টেরিলন ও আউডার্ড এতক্ষণ পরে বেয়লের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

বেয়ল বললেন, ‘এইবারে সমগ্র নারী-বাহিনী আমাদের আক্রমণ করতে আসবে। এই দ্বিতীয় আক্রমণ ঠেকাতে না পারলেই সর্বনাশ!’

টেরিলন বললেন, ‘আমাদের কামানগুলো প্রস্তুত হয়েই আছে। দ্বিতীয় দলের সৈন্যসংখ্যা কত হতে পারে?’

‘অন্তত তিন হাজার।’

‘কিন্তু কামানের বিরুদ্ধে ধনুকের তির কী করতে পারে?’

বেয়ল বললেন, ‘ও প্রশ্নের উত্তরে মুসেট কী বলে শোনো না!’

টেরিলন বললেন, ‘মুসেটের মৃত্যু নিয়ে কি তুমি কৌতুক করতে চাও?’

বেয়ল জবাব দেবার সময় পেলেন না। কারণ দূর থেকে রক্ষীর উচ্চকণ্ঠে ভয়াল ধ্বনি জাগল—’আহোসিরা আসছে! আহোসিরা আসছে!’