» » বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : পাঁচ

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ। দুর্গ-নগরী কোটোনৌ।

তার চতুর্দিকে ধূ-ধূ-ধূ তেপান্তর। এবং তেপান্তরের পর দুরধিগম্য কান্তার—বাহির থেকে তার ভিতরে প্রবেশ করা এবং ভিতর থেকে তার বাহিরে বেরিয়ে আসা দুইই সমান কষ্টসাধ্য।

কিন্তু বনচর জীবেরা বনের গোপন পথ জানে। রণরঙ্গিণী রমণীরা হচ্ছে বনরাজ্যের অন্তঃপুরচারিণী—অবহেলায় এড়িয়ে চলতে জানে যে-কোনও আরণ্য বাধাবন্ধ।

দুর্গের অদূরেই মাঠের উপরে পড়েছে সৈনিকদের ছাউনি। সেখানে এক তাঁবুর ভিতরে বসে ফরাসিদের দ্বারা প্রেরিত শাসনকর্তা আমাদের পূর্বপরিচিত বেয়ল, জেনারেল টেরিলন ও আরও দুইজন পদস্থ সেনানী মদ্যপান করতে করতে আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন।

টেরিলনের চেহারা যেন তালপাতার সেপাই! মেজাজ তাঁর এমনই কঠিন যে ভাঙলেও মচকাতে চায় না। ফৌজের সৈনিকদের কাছে তিনি ছিলেন চোখের বালির মতো দুঃসহ। তিনি তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আরে ছোঃ। অস্ত্র ধরলে কী হবে, ওরা তো স্ত্রীলোক—তুচ্ছ স্ত্রীলোক ছাড়া আর কিছুই নয়!’

বেয়ল নারী-যোদ্ধাদের কেরামত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন,—বললেন, ‘কিন্তু তারা বিভীষণা, সাংঘাতিক!’

—’তাহলে আমার সঙ্গে আরও দ্বিগুণ সৈন্য পাঠানো হল না কেন?’

এইবার আলোচনায় যোগ দিলেন কাপ্তেন আউডার্ড, এতক্ষণ তিনি একমনে বসে বসে চুমুকের পর চুমুকে খালি করছিলেন মদের গেলাসের পর গেলাস। অধার্মিক ও কর্কশ প্রকৃতির লোক। খুনোখুনির সুযোগ পেলেই খুশি। লম্বাচওড়া রোমশ দৈত্যের মতো চেহারা। তিনি বড়াই করে বললেন, ‘জেনারেল, কী হবে আরও সৈন্যে? স্ত্রীলোকগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে আমি প্রস্তুত! আর যাই-ই হোক, পুরুষের মতো তারাও তো মরতে বাধ্য?’

চেয়ারের পিছনদিকে হেলে পড়ে বেয়ল ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠলেন। বললেন, ‘আউডার্ড, তুমি সাহসী বটে। কিন্তু তুমি তো কখনও রায়বাঘিনীদের সঙ্গে লড়াই করনি! দেখো, কালই তুমি তাদের হাতে পঞ্চত্বলাভ করবে। জেনারেল, তোমাকেও তারা মারবে। আর মুসেট, তুমিও বাঁচবে না!’

শেষোক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন লেফটেনান্ট চার্লস মুসেট। তিনি হাঁ-না কিছুই না বলে ব্রান্ডির গেলাসে চুমুক দিতে লাগলেন মৌনমুখে। বোধ হয় এসব কথা তাঁর মনে হচ্ছিল বাজে বকবকানি!

নিজের শেষ গেলাসটা খালি করে উঠে দাঁড়ালেন জেনারেল! তারপর টলতে টলতে তাঁবুর এককোণে গিয়ে বিছানার উপরে ধপাস করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললেন, ‘এখন থ্রো কর এ-সব কথা। রাত হয়েছে, আমি শ্রান্ত।’

কিন্তু বেয়লের মুখে বন্ধ হল না কথার তোড়। তিনি বললেন, ‘ঘুমনো হচ্ছে বোকামি। আহোসিরা আক্রমণ করবে দুপুর রাত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যেই।’

আউডার্ড ব্যঙ্গভরে বললে, ‘কিন্তু তাদের আদর করবার জন্যে আমরা তো তৈরি হয়েই আছি! কী বল হে মুসেট, তাই কিনা?’ বলেই তাঁকে এক গুঁতো মারলেন।

কিন্তু গুঁতো খেয়েও মুসেটের রা ফুটল না। নেশাটা বোধ করি বড়ই জমে উঠেছিল।

উত্তেজিত কণ্ঠে ক্ষিপ্তের মতো বেয়ল বললেন, ‘শোনো, শোনো, তোমরা বুঝতে পারছ না কেন? রায়বাঘিনীরা দিনের খটখটে আলোয় লড়াই করে না। সূর্যোদয়ের পূর্ব-মুহূর্তেই তারা করে আক্রমণ।’

কেবা শোনে কার কথা। ‘নির্বোধ! মূর্খ!’ বলে বেয়ল হতাশ হয়ে গজরাতে গজরাতে ফিরে গেলেন নিজের তাঁবুতে।

কিন্তু তখনও পর্যন্ত তিনিও জানতেন না যে, ডাহোমির রাজা বেহানজিন সেই দিনই—অর্থাৎ মার্চ মাসের চার তারিখেই—ফরাসিদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পর কোটোনৌ দুর্গ-নগরী অধিকার বা অবরোধ করবার আদেশ দিয়েছেন!