ঐতিহাসিক সমগ্র
বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : চার
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ।
কোটোনৌ হচ্ছে ফরাসিদের দ্বারা অধিকৃত একটি দুর্গ-নগর। সেই নগরে থানা দিয়ে বসেছেন ডাহোমির শাসনকর্তারূপে নির্বাচিত জিন বেয়ল।
ডাহোমির নূতন অধিপতি বেহানজিন ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমাদের স্বর্গীয় রাজাকে—আমার পূর্বপুরুষকে ফরাসি কুক্কুর বেয়ল কুহকমন্ত্রে বধ করেছে! প্রতিশোধ, আমি প্রতিশোধ চাই!’
রায়ে রায় দিয়ে নান্সিকা তীব্রস্বরে বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতে গেলে প্রথমেই করতে হবে বেয়লের মুণ্ডপাত! তারপর আমাদের স্বদেশ থেকে দূর করে খেদিয়ে দিতে হবে ফরাসি দস্যুদের!’
রাজা বললেন, ‘উত্তম। যা ভালো বোঝো তাই করো। তোমার সুবুদ্ধির উপর আমার বিশ্বাস আছে।’
হাতজোড় করে নান্সিকা বললে, ‘প্রভু, যদি আমার উপরে ভূতপূর্ব মহারাজের এই বিশ্বাস থাকত, তাহলে ব্যাপারটা আজ এতদূর পর্যন্ত গড়াত না।’
রাজা বললেন, ‘ও কথা এখন যেতে দাও নান্সিকা! অতীতের ভুল আর শোধরাবার উপায় নেই। বর্তমান সমস্যার সমাধান করো। তোমার অধীনে তো নারী-সেনাদল প্রস্তুত হয়ে আছে—’মাতঙ্গিনীযূথ যথা মত্ত মধু-কালে’! সেই আহোসিদের নিয়ে বেরিয়ে পড় গৌরবপূর্ণ জয়যাত্রায়!’
নান্সিকা বললে, ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ! এই আমি আপনার আদেশ পালন করতে চললুম!’
সেই অসিকার্মুকধারিণী বলিষ্ঠযৌবনা বীরাঙ্গনা বীরদর্পে পৃথিবীর উপরে সজোরে পদক্ষেপ করতে করতে মনে মনে বললে, ‘কেবল দেশের জন্যে নয় মহারাজ, কেবল আপনার জন্যেও নয়—সেই সঙ্গে নিজের জন্যেও আজ আমি প্রতিহিংসাব্রত উদ্যাপন করতে যাব! সেদিনকার অপমান কি আমি জীবনে ভুলতে পারব? আমি ডাহোমির সেনানায়িকা নান্সিকা, সকলের সামনে আমার হাতে বেড়ি, পায়ে বেড়ি আর পিঠে কোড়ার বাড়ির পর কোড়ার বাড়ি! শয়তান বেয়ল আর দেশের শত্রু ফরাসি দস্যুরা, ওরাই দায়ী এর জন্যে! ওদের যমালয়ে পাঠাতে না পারলে জীবন থাকতে আমার শান্তি নেই!’
ডিমি-ডিমি-ডিমি-ডিমি বাজতে লাগল কাড়া-নাকাড়া, আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে উড়তে লাগল বর্ণরঞ্জিত পতাকার পর পতাকা, দিকে দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল নাগরিকদের হুংকৃত কণ্ঠের ঘন ঘন জয়োল্লাস এবং নারী-সেনাদের তালে তালে দর্পিত পাদপ্রহারে থর-থর কম্পিত পৃথিবী যেন আর্তনাদ করতে লাগল সশব্দে!
ফৌজের পুরোভাগ থেকে মাথার উপরে শূন্যে শাণিত বিদ্যুদচিকন তরবারি আস্ফালন করতে করতে নান্সিকা উচ্চ, দৃপ্ত স্বরে বার বার বলে চলল—’আগে চল, আগে চল আগে চল! শত্রুসংহার করতে হবে, শত্রুসংহার! তোমার শত্রু, আমার শত্রু, রাজার শত্রু, দেশের শত্রু! হয় মারব, নয় মরব, হার স্বীকার করব না! আগে চল, শত্রুসংহার কর—মার আর মর।’
লামা জলাভূমি—হঠাৎ দেখলে মনে হয় দূরবিস্তৃত বিশাল হ্রদ বুকে তার নীলিমা মাখিয়ে দেয় আকাশের প্রতিচ্ছায়া।
তারই পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে নান্সিকার রক্তলোচনা বিভীষণা সঙ্গিনীরা বন্দি করে আনলে একদল ফরাসিকে।
রাজা বেহানজিনের উৎসাহের সীমা রইল না। লামা হ্রদের তটে দাঁড়িয়েই তিনি প্রকাশ্যভাবে পররাজ্যলোভী ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলেন।
ইউরোপে যখন এই খবর গিয়ে পৌঁছোল তখন সকলের ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল ব্যঙ্গহাসির রেখা। কোথায় কোটি কোটি মানুষের বৃহৎ বাসভূমি, সভ্যতায় শীর্ষস্থানীয় ও শক্তিসামর্থ্যের জন্যে সুপ্রসিদ্ধ ফ্রান্স, আর কোথায় অসভ্য কৃষ্ণাঙ্গের জন্মভূমি আফ্রিকার অজানা এক প্রান্তে অবস্থিত মাত্র দশ লক্ষ প্রায়নগ্ন বর্বর মনুষ্যের বন্য স্বদেশ—ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র ডাহোমি! পর্বতের পদতলে নগণ্য নুড়ি, মত্তহস্তীর চলনপথে তুচ্ছ উই, বনস্পতির ছায়ার তলায় ক্ষুদ্র তৃণ। অ্যাঁ! হাউই বলে কিনা—’তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই!’ শ্বেতাঙ্গ সেনাপতির একটিমাত্র ইঙ্গিতে লক্ষ লক্ষ সৈনিক ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে কেবল পায়ের বুটজুতোর চাপেই ডাহোমিকে এখনই সমতল পৃথিবীর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে আসতে পারে!
সুতরাং ফ্রান্সের টনক নড়ল না।
কিন্তু নান্সিকার যুক্তি হচ্ছে, ছোট্ট বিছাকে ঘাঁটালে সেও পাগলা হাতিকে কামড়ে দিতে ইতস্তত করে না এবং ধুমসো হাতি তখন বিষের জ্বালায় ছটফটিয়ে দৌড় মারতে বাধ্য হয়! অতএব—আগে চল, আগে চল! হয় শত্রুবধ, নয় মৃত্যু! অতএব—থামল না ডিমি-ডিমি দামামা-ধ্বনি, আনত হল না দর্পিত ধ্বজপতাকা, স্তব্ধ হল না ক্ষুদ্র ডাহোমির রুদ্র জয়নাদ!
শূন্যে ঝকঝকে তরবারি তুলে, মাথার উপরে শাণিত বল্লম উঁচিয়ে শরাসনে তীক্ষ্ণমুখ বাণযোজন করে সেই মূর্তিমতী চামুণ্ডাবাহিনী বনে বনে খুঁজে বেড়াতে লাগল কোথায় আত্মগোপন করে আছে ফরাসি দস্যুদল!
বনে-মাঠে যখন-তখন যেখানে-সেখানে খণ্ডযুদ্ধের পর খণ্ডযুদ্ধ। ফরাসি পুরুষপুঙ্গবরা অবলা নারীদের দেখে প্রথমে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতে চায় না, কিন্তু তারপরেই মারাত্মক অস্ত্রাঘাতে এক-মুহূর্তের অবহেলার ফলে চিরনিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়ে!
তারপর ডেনহাম হ্রদের ধারে সাদায়-কালোয়—সাদা-চামড়া পুরুষ এবং কালো-চামড়া মেয়ের মধ্যে হাতাহাতি হানাহানি হল বারবার। বন্দুকগর্জন, কোদণ্ডটংকার, তরবারির ঝনঝনানি, নরনারীর মিলিত কণ্ঠের ভৈরব তর্জন, আহতদের করুণ কাতরানি এবং মরণোন্মুখের অন্তিম চিৎকার কান্তার-প্রান্তর ও আকাশ-বাতাসকে যেন সচকিত করে তুললে!
ফরাসিদের সেনাধ্যক্ষরা স্তম্ভিত! গ্রিক পুরাণ-কাহিনিতে তাঁরা পড়েছেন কি শুনেছেন যে, স্মরণাতীত কাল পূর্বে কোনও এক সময়ে নাকি রণরঙ্গিণী নারী-বাহিনীর সঙ্গে গ্রিক বীরপুরুষদের তুমুল সংগ্রাম করতে হয়েছিল এবং গ্রিসের পার্থেনন দেবমন্দিরের শিলাপটের উপরে সেই পৌরাণিক যুদ্ধে নিযুক্ত নর-নারীর উৎকীর্ণ মূর্তিচিত্র অনেকে স্বচেক্ষ দর্শনও করেছেন।
সে তো কবির কাল্পনিক কাহিনি মাত্র, আর সেই রণরঙ্গিণী নারীরাও শ্বেতাঙ্গিনী!
কিন্তু এই আসন্ন বিংশ শতাব্দীর মুখে বর্বর আফ্রিকায়—যেখানে কালো কালো ভূতের মতো পুরুষগুলো শ্বেতাঙ্গদের দূরে দেখলেও ভেড়ার পালের মতো ভয়ে ছুটে পালায় কিংবা কাছে এলে গোলামের মতো জুতোর তলায় লুটিয়ে পড়ে, সেখানকার অর্ধোলঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গিনীরা কিনা শ্বেতপুরুষের মুণ্ডচ্ছেদ করবার জন্যে দূর থেকে হুংকার তুলে খাঁড়া নিয়ে ধেয়ে আসে!
এই কল্পনাতীত দৃশ্যের কথা ভেবে শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধারা বিপুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাঁদের চাঙ্গা করে তুলে অদূরে জাগে শত শত কামিনীকণ্ঠে খলখল অট্টহাস্যরোল এবং তারও উপরে গলা তুলে উদ্দীপিত স্বরে সচিৎকারে কে বলে ওঠে—’আগে চল, আগে চল! শত্রু মার, শত্রু মার!’ তারপর চোখের পলক পড়তে না পড়তে জঙ্গলের অন্তরাল থেকে সহসা বেরিয়ে হন্যে হয়ে অস্ত্র আস্ফালন করতে করতে ছুটে আসে সারি সারি বীরনারীর দল! পর মুহূর্তেই ধুন্ধুমার, হুহুংকার ধনুষ্টংকার ও তরবারির ঝনৎকার!
কুসুমকোমলা বলে কথিত রমণীদের এমন সংহার-মূর্তি ফরাসিরা আর কখনও দেখেনি!
কিন্তু ফরাসিরা মার খেয়ে মার হজম করতে বাধ্য হল তখনকার মতো।
সেই দুর্দমনীয় নারী-বাহিনী পিছু হটতে জানে না, বীরবিক্রমে এগিয়ে আসে আর এগিয়ে আসে!
বীরাঙ্গনারা মারতে মারতে ছুটে চলে, মরতে মরতে মারণ-অস্ত্র চালায়! মৃত্যুভয় ভুলে যারা রক্তস্নান করে এবং হাসতে হাসতে প্রাণ-কাড়াকাড়ি খেলায় মাতে, কে লড়াই করবে তাদের সঙ্গে?
এই অদ্ভুত সংবাদ সাগর পার হয়ে পৌঁছোল গিয়ে ফ্রান্সের বড় কর্তার কাছে। তাঁরাও প্রথমটা হতবাক হয়ে গেলেন মহাবিস্ময়ে!
সকলে দারুণ মর্মপীড়ায় কাহিল হয়ে পড়লেন। একদল অরণ্যচারিণী নগণ্য কৃষ্ণাঙ্গীর প্রতাপে কীর্তিমান ফ্রান্সের শ্বেত পুরুষত্ব নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে, এ কথা শুনলে ইউরোপের অন্যান্য দেশ টিটকিরি দিতে ও হাসাহাসি করতে বাকি রাখবে না!
অবিলম্বে এর একটা বিহিত করা চাই।
উপরওয়ালাদের হুকুমে তখনই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। তার কয়েক মাস পরে যথাসময়ে ডাহোমির দিকে পাঠানো হল দলে দলে নতুন সৈন্য, বড় বড় কামান এবং ভারে ভারে রসদ।
প্রধান সেনাপতি হয়ে গেলেন জেনারেল সিবাস্টিয়ান টেরিলন। তিনি আড্ডা গেড়ে বসলেন দুর্গ-নগরী কোটোনৌয়ের উপকণ্ঠে।