» » বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : তিন

ব্যাপারটা একবার ভালো করে তলিয়ে বুঝবার চেষ্টা করুন।

একটিমাত্র ক্রুদ্ধ হাতির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় পায় দলে ভারী পুরুষ-শিকারিরাও। কিন্তু বনচর হাতির পালের সামনে গিয়ে ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে আস্ফালন করতে গেলে যে কতখানি বুকের পাটার দরকার সেটা অনুমান করতে গেলেও হৃৎকম্প হয়!

পাশ্চাত্য শিকারিদের হাতে থাকে অধিকতর শক্তিশালী আধুনিক বন্দুক এবং যার খোলনলচের ভিতরে থাকে বিশেষভাবে প্রস্তুত হাতিমারা বুলেট। কিন্তু দলবল নিয়ে তার সাহায্যেও হাতি মারতে গিয়ে কতবার কত লোককে যে মরণদশায় পড়তে হয়েছে, গুনে তা বলা যায় না।

মেয়ে-সেপাইরা তেমন বন্দুক চোখেও দেখেনি, এবং সেই বিশজনের প্রত্যেকেরই হাতে যে বন্দুক—অর্থাৎ খেলো বন্দুক ছিল, তাও নয়; অনেকের হাতে ছিল খালি সেকেলে তির-ধনুক ও বল্লম-তরবারি। হাতির পালে কত হাতি ছিল তা প্রকাশ পায়নি, তবে বিশজন মেয়ে যখন মিনিটখানেকের মধ্যে সাত-সাতটা হাতি মেরে ধরাশায়ী করতে পেরেছিল, তখন হস্তীযুথ যে মস্তবড় ছিল সেটুকু বুঝতে দেরি হয় না।

কিন্তু এখানে সপ্তহস্তীবধের চেয়ে আজব কথা হচ্ছে সেই দুর্ধর্ষ বীরাঙ্গনাদের প্রচণ্ড সাহসের কথা। এমন কাহিনি আর কোনওদিন শোনা যায়নি।

ডাহোমির রাজা বিপুল বিস্ময়ে বীরাঙ্গনাদের সাদর অভ্যর্থনা করে বললেন, ‘আজ থেকে তোমাদের উপাধি হবে ‘মাতঙ্গমর্দিনী’!’

তারপর সেই বিশজন মাতঙ্গমর্দিনী নিয়ে গড়া দলে ভরতি করা হতে লাগল নারী-বাহিনীর সেরা সেরা বীরাঙ্গনাকে। যুদ্ধের সময়ে খুব ভেবেচিন্তে কখনও-সখনও ব্যবহার করা হত সেই রায়বাঘিনীর দলকে,—কারণ তাদের প্রাণকে মনে করা হত মহামূল্যবান।

কিন্তু তাদের উপরেও নারীবাহিনীর আর একটা দল ছিল। কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে দক্ষ মেয়ে-সেপাইদের নিয়ে সেই দল গঠিত হত। তাদের প্রত্যেকের আকার হত বলিষ্ঠ ও লম্বাচওড়া এবং কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাদের প্রধান অস্ত্র বেওনেট বা কিরিচ। তাদের পরনে থাকত নীল ও সাদা রঙের জমির ডোরাকাটা আর হাতকাটা জামা এবং হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে পড়া ঘাগরা।

ওই প্রথম ও দ্বিতীয় দলের অর্থাৎ কিরিচধারিণী ও মাতঙ্গমর্দিনীদের পরেও মেয়ে-ফৌজে ছিল আরও দুই দলের পদাতিক সেপাই।

এক, বন্দুকধারিণী দল। এদের গড়নপিটন পাতলা ও দেহ ছিপছিপে। খণ্ডযুদ্ধের সময়ে যখন এই দলকে লেলিয়ে দেওয়া হত, তখন দলের অনেকেই মারা পড়লেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাত না।

আর এক, ধনুকধারিণীর দল। এই দলের মেয়েরা ছিল ফৌজের মধ্যে সবচেয়ে অল্পবয়সি ও দেখতে রূপসি। হাতাহাতি লড়বার জন্যে তারা ছোরা সঙ্গে রাখত।

এই শেষোক্ত দুই দলের সৈনিকরা অন্যান্য জামা-কাপড়ের বদলে কোমরে পরত কেবল কৌপীন এবং অন্যান্য অলংকারের বদলে বাম হাতে রাখত খালি হাতির দাঁতের বালা।

আড়াই শত বৎসরের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে মেয়ে-সেপাইরা রণকৌশলের হাড়হদ্দ বিশেষ ভাবেই রপ্ত করে ফেলেছিল। তাদের প্রধান একটি ফিকির ছিল, অতর্কিতে শত্রুদের আক্রমণ।

মেয়ে-ফৌজে সৈন্যসংখ্যা ছিল আট হাজার এবং এই নারীবাহিনীর পরিচালিকা ছিল, নান্সিকা।

কবি মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় নান্সিকা হচ্ছে—

‘বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা!’

হ্যাঁ, যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অপূর্ব তার গুণপনা, তেমনি ভয়াল তার বীরপনা। প্রকাশ, তার সঙ্গে হাতাহাতি সংঘর্ষে প্রাণদান করতে হয়েছে পাঁচশত শত্রু-যোদ্ধাকে! অমোঘ তার অস্ত্রধারণের শক্তি এবং অভ্রান্ত তার সৈন্যচালনার দক্ষতা!

যে পুরুষ-কবি সর্বপ্রথমে নারীকে অবলা বলে বর্ণনা করেছিলেন, নান্সিকাকে স্বচক্ষে দেখলে তিনি সভয়ে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হতেন। প্রত্যেক অঙ্গভঙ্গে নান্সিকার দেহতটে যখন উচ্ছ্বসিত হতে থাকত বলিষ্ঠ যৌবনের ভরাট জোয়ার, তখন তার দুই চক্ষে ঠিকরে উঠে বীর্যবত্তার তীব্র বিদ্যুৎ, শত্রুর চিত্তে জাগিয়ে তুলত আসন্ন অশনিপাতের আশঙ্কা!

এই নান্সিকার সঙ্গে ইউরোপ থেকে আগত ফরাসি দস্যুদের ভীষণ শত্রুতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

কারণটা খুলে বলা দরকার।

বরাবরই দেখা গিয়েছে ইউরোপীয় দস্যুরা প্রথমে সওদাগরের বা পরিব্রাজকের বা ধর্মপ্রচারকের ছদ্মবেশ ধারণ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে গিয়ে অতি নিরীহের মতো ধরনা দিয়েছে, তারপর সময় বুঝে ধীরে ধীরে নানা অছিলায় গোপনে শক্তিসঞ্চয় করে হঠাৎ একদিন নিজমূর্তি ধরে রক্তধারায় মাটি ভাসিয়ে এবং দিকে দিকে মৃত্যু ছড়িয়ে সর্বগ্রাস করে বসেছে।

শ্বেতাঙ্গরা এই ভাবে ভারতবর্ষে এসে শিকড় গেড়ে বসেছিল। আফ্রিকাতেও তারা গোড়ার দিকে সেই চালই চালে এবং অন্ধিসন্ধি বুঝে নেয়। কিন্তু ভারতের তুলনায় আফ্রিকা ছিল প্রায় অরক্ষিত, কারণ আগ্নেয়াস্ত্রকে কতক্ষণ ও কতটুকু বাধা দিতে পারে তরবারি, বল্লম ও তিরধনু! দেখতে দেখতে নানাদেশী শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকার উপরে ক্ষুধিত রাক্ষসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নানা অংশ ছিনিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলে।

পশ্চিম আফ্রিকার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরাসি দস্যুরা। ছলে-বলে-কৌশলে অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়ে অবশেষে তাদের শনির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ডাহোমির উপরে।

ডাহোমি তখনও স্বাধীন। তার সিংহাসনে আসীন রাজা গেলেল।

বেয়ল হচ্ছেন ফরাসিদের এক পদস্থ কর্মচারী। একদিন তিনি এলেন রাজা গেলেলের কাছে—মুখে তাঁর শান্তিদূতের মুখোশ।

রাজা তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন হাসিমুখে। বলা বাহুল্য, বেয়লের মুখে মিষ্টি মিষ্টি বুলির অভাব হল না। সরল রাজা ভুলে গেলেন কথার ছলে।

নান্সিকা ছিল নারী-বাহিনীর অন্যতম পরিচালিকা। অতিশয় বুদ্ধিমতী বলে তার সুনাম ছিল যথেষ্ট। সে দেখনহাসি বেয়লের মিষ্ট কথায় তুষ্ট হল না—ফন্দিবাজ ফরাসিদের স্বরূপ চিনে ফেলেছিল তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। বেয়লের ফন্দি ব্যর্থ করবার জন্যে নান্সিকা নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু সে কিছুই করতে পারলে না—ক্রমে ক্রমে রাজা হয়ে পড়লেন বেয়লের হাতের কলের পুতুলের মতো। বেয়ল যা বলেন, রাজা তাইতেই সায় দেন।

নান্সিকা তখন দেশের শত্রুকে বধ করবার জন্যে গোপন চক্রান্তে প্রবৃত্ত হল।

খবরটা রাজার কানে উঠল। খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধুর বিরুদ্ধে চক্রান্ত! বন্দি করো নান্সিকাকে! লাগাও পিঠে সপাসপ কোড়ার বাড়ি! বেয়ল যতদিন আমার রাজধানীতে থাকবেন, ততদিন তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিও না।’

তাই হল। বেত্রদণ্ডের পরে নান্সিকা হল বন্দিনী।

তারপরেই কিন্তু নান্সিকা রাজার মনে যে সন্দেহের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেল, ক্রমে তা হল নির্জলা সত্যে পরিণত। একটু একটু করে রাজার চোখ ফুটতে লাগল বটে, কিন্তু তিনি কোনও-কিছু করবার আগেই নিজের কাজ ফতে করে বেয়ল বিদায় নিয়ে ফিরে গেলেন।

নান্সিকা আবার কারাগারের বাইরে এসে দাঁড়াল।

তারপর কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ একদিন হৃৎপীড়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজা পড়লেন মৃত্যুমুখে।

প্রজারা হাহাকার করতে লাগল—হায়, হায়, এ যে বিনামেঘে বজ্রাঘাত।

নান্সিকা সুযোগ বুঝে দিকে দিকে রটিয়ে দিলে—’এ হচ্ছে দেশের শত্রু ফরাসিদের কারসাজি। এমন ভাবে মানুষ মারা পড়ে না। দুষ্ট বেয়লের বশীকরণ-মন্ত্রে বশ হয়েই রাজা মারা পড়েছে—কুহকী ফরাসিদের দেশ থেকে এখনি তাড়াও।’

অরণ্যরাজ্য ডাহোমির নিরক্ষর সব প্রজা—রাজনীতি, কূটনীতি প্রভৃতি অতশত কিছুই বোঝে না, নান্সিকার কথাই তারা ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিলে। ফরাসিদের উপরে সকলে খড়গহস্ত হয়ে উঠল।

নূতন রাজা হয়ে ডাহোমির সিংহাসনে বসলেন বেহানজিন। নান্সিকা ছিল তাঁর প্রিয়পাত্রী। তিনি বললেন, ‘নান্সিকা! আজ থেকে তুমি হলে আমার সমস্ত নারী-বাহিনীর অধিনায়িকা। যাও, শত্রুজয় করে ফিরে এস।’