» » বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : দুই

স্বাধীন ডাহোমির সব চেয়ে বড় বিশেষত্ব ছিল, সেখানে দেশরক্ষা করত পুরুষরা নয়, নারীরা! সাধারণভাবে বলা যায়, ডাহোমির রাজাদের ফৌজে সৈনিকের ব্রত পালন করত সশস্ত্র নারীরা।

আগেই বলা হয়েছে, নারী-ফৌজ কিছু নতুন ব্যাপার নয়। এই শ্রেণির রণচণ্ডী নারীদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাম্যাজন’। স্প্যানিয়ার্ডরা দক্ষিণ আমেরিকা আক্রমণ করতে গিয়ে বিভিন্ন নারী বাহিনীর কাছে বারংবার বাধা পেয়েছিল। তাই তারা সেই দেশের ও সেখানকার প্রধান নদীর নাম দিয়েছিল যথাক্রমে ‘অ্যাম্যাজোনিয়া’ এবং ‘অ্যাম্যাজন’। পৃথিবীতে অ্যাম্যাজন আজও বিখ্যাত নদীগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে—তার দৈর্ঘ্য চার হাজার পাঁচশো এক মাইল।

তবে অন্যান্য দেশে পুরুষদের সঙ্গেই নারীরা যুদ্ধে যোগদান করেছে। কিন্তু ডাহোমির প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষের ছায়াও দেখা যায়নি, সেখানে শত্রুদের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করেছে কেবল রণরঙ্গিণীরা। সেখানে অ্যাম্যাজনদের নাম হচ্ছে ‘আহোসি’। সারা পশ্চিম আফ্রিকায় সকলেই আহোসিদের ভয় করে সত্যসত্যই রায়বাঘিনীর মতো।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতে যখন মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবের যুগ, তখনই ডাহোমির নারী সেনাদল গঠিত হয়। প্রথমে রাজা আগাদগা বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সৈন্যসংখ্যা বাড়াবার জন্যে ফৌজে পুরুষদের সঙ্গে নারীদেরও সাহায্য গ্রহণ করেন। দেখা যায়, বীরত্বে ও রণনিপুণতায় নারীরা হচ্ছেন অসামান্য। তখন আইন হল, ডাহোমির প্রত্যেক আইবুড়ো মেয়েকে পনেরো বছর বয়স হলেই ফৌজে যোগ দিতে হবে। বরাবর চলে আসছে সেই নিয়মই।

আন্দাজ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা গেজো সিংহাসন পেয়ে সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসর কাল রাজ্য চালনা করেন। তাঁর আগেও ডাহোমির মেয়ে-সেপাইরা অস্ত্র ধরে শত্রুনিধন করত বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও শৃঙ্খলা ছিল না। রাজা গেজোই সর্বপ্রথমে নারী-বাহিনীকে সুব্যবস্থিত ও অধিকতর শক্তিশালী করে তোলেন এবং তাদের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী দেশের পর দেশ জয় করে নিজের পতাকার তলায় আনেন।

সৈনিকবৃত্তি গ্রহণ করবার পর কুমারীদের কঠোর শিক্ষাদীক্ষার ভিতর দিয়ে প্রস্তুত হতে হত—একটু এদিক-ওদিক হলেই ছিল প্রাণদণ্ডের আশঙ্কা। কিছুকাল সৈনিকজীবন যাপন করবার পরই তারা কেবল তরবারি, তির-ধনুক, বল্লম, বন্দুক ও বেওনেট চালনাতেই সুপটু হয়ে উঠত না, উপরন্তু নিয়মিত ব্যায়ামে তাদের দেহও হয়ে উঠত দস্তুরমতো বলিষ্ঠ ও পেশীবদ্ধ। একবার এই রণরঙ্গিণীদের বিশজন অরণ্যে গিয়ে এক মিনিটের মধ্যে বধ করেছিল সাত-সাতটা হাতি। সেই থেকে নারী-বাহিনীর একটি বিশেষ দল ‘মাতঙ্গ-মর্দিনীর দল’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।