ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে
নবম পরিচ্ছেদ
সুন্দরী সে, সুন্দরী!
চরণ-কমল সন্ধানে তার
মধুপ ওঠে গুঞ্জরি!
বাতাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছে শত শত মঙ্গলশঙ্খের সুগম্ভীর আনন্দকল্লোল, জনতার অশ্রান্ত ঐকতানে ঘনঘন বেজে উঠেছে অনাহত জয়গীতিকা, পথে পথে ঝরে পড়ছে লাজাঞ্জলির পর লাজাঞ্জলি!
বিজয়ী বীর সুদূরের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছেন স্বদেশে, প্রাচীন অযোধ্যা তাঁকে অভিনন্দন দেওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠেছে।
প্রাসাদ-তোরণে অপেক্ষা করছিলেন রাজমাতা মহারানি কুমারদেবী, রাজগুরু বসুবন্ধু ও রাজবান্ধবী পদ্মাবতী।
প্রণত সমুদ্রগুপ্তকে সানন্দে আশীর্বাদ করে কুমারদেবী বললেন, ‘বাছা, তোমার মতো বীর পুত্র পেয়ে আমার গর্বের আর সীমা নেই। এইবারে মগধের সিংহাসন গ্রহণ করে মায়ের জীবন সার্থক করো।’
সমুদ্রগুপ্ত মায়ের একখানি হাত আদর করে নিজের বুকের উপরে টেনে নিয়ে বললেন, ‘সময় হয়নি মা, এখনও সময় হয়নি। প্রতিজ্ঞা করেছি, সমস্ত ভারত যতদিন না আমাকে সম্রাট বলে মানবে, ততদিন মগধের মুকুট দাবি করব না। কেবল উত্তর ভারত নিয়ে আমি খুশি হতে পারব না—আগে দক্ষিণ ভারত জয় করি, তারপর করব মুকুটধারণ।’
বসুবন্ধু বললেন, ‘বৎস, সন্ন্যাসীকে করে গেছ তুমি রাজপ্রতিনিধি। কিন্তু আমার সন্ন্যাস যে এ ঐশ্বর্য আর সইতে পারছে না, তার আর্তনাদ যে নিশিদিন আমি শুনতে পাচ্ছি! আমাকে মুক্তি দাও বৎস, মুক্তি দাও!’
সমুদ্রগুপ্ত হেসে বললেন, ‘মুক্তি! শিষ্যের স্নেহের রাজ্যে গুরুর মুক্তি যে কোনওদিনই নেই প্রভু! ঐশ্বর্যের মধ্যেও যে সন্ন্যাস নির্লিপ্ত থাকতে পারে, তার চেয়ে গৌরব আছে আর কার? হে রাজতপস্বী, শিষ্যের মুখ চেয়ে আরও কিছুদিন রাজ্যপীড়া ভোগ করুন।’
পদ্মাবতী ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘কী সংবাদ, পদ্মা? মাতৃদেবীর আর্তনাদ শুনলুম। এইবারে তোমারও আর্তনাদ শুনতে হবে নাকি?’
পদ্মাবতী বললেন, ‘হ্যাঁ চন্দ্রপ্রকাশ! আমার কাছেও এক আর্তনাদ এসেছে, দূর-দুরান্তর থেকে!’
‘দূর-দূরান্তর থেকে। জীবন্মৃত ভারতের অসাড় চরণে মহাসমুদ্রের মাথা কোটা আর্তনাদ আমার মতো তুমিও কি শুনতে পেয়েছ পদ্মা?’
‘অত বেশি শোনবার শক্তি ভগবান আমাকে দেননি!’
‘তবে?’
‘আমার কাছে এসেছে এক নারীর আর্তনাদ!’
‘পদ্মা, তোমার কথা শুনে আমি বিস্মিত হচ্ছি!’
‘মালব-রাজকন্যা দত্তাদেবীর নাম শুনেছ?’
‘মালব-রাজ্য জয় করেছি বটে, কিন্তু রাজকন্যাকে চিনি না।’
‘দত্তাদেবী যাচ্ছিলেন তীর্থ ভ্রমণে। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে কোশলরাজ মহেন্দ্র পথে তাঁকে বন্দি করেন। কিন্তু দত্তাদেবীকে নিয়ে তিনি নিজের রাজধানীতে ফেরবার আগেই অরণ্য প্রদেশের রাজা ব্যাঘ্ররাজ তাঁর কাছ থেকে দত্তাদেবীকে আবার ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।’
‘ব্যাঘ্ররাজ? হ্যাঁ, তার নাম আমি জানি। বিষম নিষ্ঠুর, প্রবল পরাক্রান্ত এই বন্য রাজা। এর রাজধর্ম হচ্ছে দস্যুতার অত্যাচার। পদ্মা, মালব-রাজকন্যার ভবিষ্যৎ ভেবে আমার দুঃখ হচ্ছে।’
‘কেবল দুঃখিত হলেই তো চলবে না চন্দ্রপ্রকাশ! দত্তাদেবী যে সাহায্য চেয়ে তোমার কাছেই দূত পাঠিয়েছেন।’
‘আমার কাছে! আমি কী করব? আমার চোখের সামনে এখন জেগে আছে খালি মহাভারতের বিরাট মূর্তি। তুচ্ছ এক নারীর আবেদন শোনবার সময় এখন নেই।’
কুমারদেবী বললেন, ‘বাছা, আর্য ভারতবর্ষে বীরের বাহুই চিরদিন নারীর ধর্মরক্ষা করে এসেছে, তুমি কি এ আদর্শ মানো না?’
‘মানি, না মানি। কিন্তু বৃহত্তর কর্তব্য পালন না করে—’
পদ্মাবতী বাধা দিয়ে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, দত্তাদেবীর আবেদন শুনলে তোমার কর্তব্যপালনে কোনওই বাধা হবে না। তুমি তো দাক্ষিণাত্যে যেতে চাও? তাহলে অরণ্যপ্রদেশ পড়বে তোমার যাত্রাপথেই। ব্যাঘ্ররাজকে দমন না করে তুমি তো অগ্রসর হতে পারবে না!’
সমুদ্রগুপ্ত হেসে বললেন, ‘পদ্মা, আমার মুখ বন্ধ করবার জন্যে তুমি যে দেখছি, সমস্ত যুক্তিই স্থির করে রেখেছ। বেশ, আমি তোমাদের কথাই শুনব! দত্তাদেবীর দূতকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
অবিলম্বে দূত এসে অভিবাদন করলে।
সমুদ্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দত্তাদেবী এখন কোথায়?’
‘অরণ্য প্রদেশের এক গিরি দুর্গে তিনি বন্দিনী।’
‘কোন পথে শীঘ্র সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতে পারব?’
‘দক্ষিণ কোশলের মহানদীর উপত্যকার ভিতর দিয়ে।’
‘তাহলে আগে আমাকে কোশল রাজ্যও জয় করতে হবে। কিন্তু দূত, ততদিন দত্তাদেবী আমার জন্যে অপেক্ষা করতে পারবেন কি?’
‘মহারাজ, দুরাত্মা ব্যাঘ্ররাজ রাজকন্যাকে বিবাহ করবার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাজকন্যা তার কাছে দুই মাস সময় প্রার্থনা করেছেন, সেও রাজি হয়েছে।’
‘কোশলরাজ মহেন্দ্র আর ব্যাঘ্ররাজ দুজনেই যখন দত্তাদেবীর জন্যে লালায়িত, তখন বোধ হচ্ছে তোমাদের রাজকন্যা খুবই সুন্দরী?’
‘অসীম সুন্দরী মহারাজ, সাক্ষাৎ তিলোত্তমা! যেমন রূপ, তেমনই গুণ!’
‘আচ্ছা, যাও দূত! দত্তাদেবীকে জানিও, দুই মাসের মধ্যেই সমুদ্রগুপ্ত সসৈন্যে ব্যাঘ্ররাজের দর্পচূর্ণ করবে।’
দূত চলে গেল। পদ্মাবতী কাছে এসে দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসতে হাসতে চুপি চুপি বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ শুনলে তো?’
‘কী?’
‘দত্তাদেবী হচ্ছেন সাক্ষাৎ তিলোত্তমা।’
‘হুঁ।’
‘দত্তাদেবী কুমারী।’
‘হুঁ।’
‘তুমিও কুমার।’
‘পদ্মা, তুমি কী বলতে চাও?’
‘হয়তো শীঘ্রই তোমাদের বিবাহের ভোজে আমাদের নিমন্ত্রণ হবে।’
‘পদ্মা!’
কিন্তু পদ্মা আর দাঁড়াল না, চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে পালিয়ে গেল।