» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

অষ্টম পরিচ্ছেদ

একতা, একতা, একতা!

একতার জোরে মানুষের কাছে

হারে যে দানব-দেবতা।

তারপর এক বৎসর কেটে গেছে।

এই এক বৎসর ধরে সমুদ্রগুপ্তের রক্তপতাকা দেখা দিয়েছে আর্যাবর্তের অর্থাৎ উত্তর ভারতের দেশে দেশে।

আগেই বলেছি উত্তর ভারত ভাগ করে নিয়েছিল ছোট ছোট হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভৃতি ভারতীয় রাজারা এবং শক, হুন ও গ্রিক প্রভৃতি যবনরা। খাঁটি ভারতীয় রাজাদের মধ্যে বীরত্বের অভাব ছিল, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু বৃহত্তর শত্রুর আবির্ভাব হলে একা একা লড়বার ক্ষমতা না থাকলেও তাঁরা একত্রে দলবদ্ধ হতে জানতেন না।

এই বিপজ্জনক স্বভাবটা হচ্ছে একেবারেই ভারতের নিজস্ব। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এই কুস্বভাবের জন্যে ভারতবর্ষ বার বার বিদেশি শত্রুর করতলগত হয়েছে। এ স্বভাব না থাকলে ভারতবর্ষের শিয়রে আজও যে ব্রিটিশ সিংহের গর্জন শোনা যেত না, একথা জোর করে বলা যায়।

ইউরোপের ধরা হচ্ছে স্বতন্ত্র। এই কয়েক শত বৎসর আগেও ইউরোপের বিভিন্ন জাতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে একত্রে দাঁড়িয়ে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছিল বারংবার।

কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত ভারতের ইতিহাসেও একটা ব্যাপার অনেকবার দেখা গিয়েছে। শত শত বৎসর অন্তত দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারতবর্ষের ক্রন্দন যখন গগনভেদী হয়ে উঠেছে, তখন এখানে অবতারের মতো আবির্ভূত হয়েছেন এক-একজন মহামানব। যেমন চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষবর্ধন। এঁরা প্রত্যেকেই আপন আপন ব্যক্তিত্বের অপূর্ব মহিমায় ভারতবাসীদের প্রাণে এনেছেন বিচিত্র প্রেরণা, এবং জোর করে একতাহীন রাজাদের দমন করে সমগ্র আর্যাবর্তকে ঐক্যসূত্রে বেঁধে বিদেশি শত্রুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ভারতের ধর্মকাব্যে অমর হয়ে আছে। এ যুদ্ধ কবে হয়েছিল এবং এর ঐতিহাসিক ভিত্তি কতটুকু সেকথা কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না। কিন্তু এ যুদ্ধের ইতিহাস যে ভারতের সত্যিকার স্বভাবের ইতিহাস সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। সমগ্র আর্যাবর্ত যেন আত্মহত্যা করবার জন্যেই বদ্ধপরিকর হয়ে কয়েকদিনব্যাপী এক মহাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিল। ভীম, অর্জুন, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ প্রভৃতি যোদ্ধা যতই বীরত্ব প্রকাশ করে থাকুন, তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন তুচ্ছ কারণে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ নয়, তা হচ্ছে ভারতের পক্ষে লজ্জাকর। কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যদি ঐতিহাসিক হয় তবে বলতে হবে যে তার ফলে ভারতের ক্ষাত্রবীর্য একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল বলেই সেই সুযোগে হয়তো পারসি ও গ্রিক প্রভৃতি যবনরা ভরসা করে পঞ্চনদের তীরে প্রথম আগমন করতে পেরেছিল।

কিন্তু একতা-মন্ত্রের যে কত গুণ, ভারতবর্ষ নিজেও একবার সে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল। সে হচ্ছে ষষ্ঠ শতাব্দীর কথা। পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের উপরে ভেঙে পড়ে হুন-যবনদের প্রবল বন্যা। এই হুনদের চেহারা ছিল যেমন রাক্ষসের মতো তাদের প্রকৃতিও ছিল তেমনই ভয়ানক এবং সংখ্যাতেও তারা ছিল অগণ্য। এই হুনদের অন্যতম নেতা আটিলার নাম শুনলে আজও ইউরোপ শিউরে ওঠে। ঐতিহাসিক গিবন তাদের চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন—’সাধারণ মনুষ্যজাতির সঙ্গে হুনদের চেহারা মেলে না। তাদের দুই কাঁধ খুব চওড়া, নাক খাঁদা, কুৎকুতে কালো চোখ একেবারে কোটরগত, দাড়ি-গোঁফ গজায় না।’

ভারতে আটিলার ব্রত নিয়ে এসেছিল মিহিরগুল। লক্ষ লক্ষ সঙ্গী নিয়ে নগ্ন তরবারি খুলে সে সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়ে প্রলয়নৃত্য করে বেড়িয়েছিল। রক্তসাগরে ভেসে, গ্রাম-নগর পুড়িয়ে দিয়ে, নারীর উপর অত্যাচার করে ভারতবর্ষকে সে যেন এক মহাশ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছিল। সেই সময়ে মধ্য ভারতের এক রাজা যশোধর্মণ বুঝলেন, এখনও ভারতবাসীরা যদি একতার মর্ম গ্রহণ করতে না পারে, তাহলে আর আর্যাবর্তের রক্ষা নেই।

যশোধর্মণের যুক্তি শুনে ভারতের অন্যান্য রাজারা সেই প্রথম হিংসা ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে একতাবদ্ধ হলেন। তার সুফল ফলতেও দেরি লাগল না। আনুমানিক ৫২৮ খ্রিস্টাব্দে একতাবদ্ধ রাজাদের নিয়ে যশোধর্মণ এমনভাবে মিহিরগুলকে আক্রমণ ও পরাজিত করলেন যে হুনদের বিষদাঁত একেবারেই ভেঙে গেল।

কিন্তু ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্যের কথা যে যশোধর্মণের আদর্শ এখানে দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারেনি। এমনই মাটির গুণ।

শক ও হুণ প্রভৃতি যবনরা ছিল ভারতবর্ষের পক্ষে অভিশাপের মতো। মহাভারতের মহাবীর শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত বারবার তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শ্রান্ত হয়ে শেষটা পশ্চিম ভারতের শেষ প্রান্তে সমুদ্রের ধারে পালিয়ে গিয়ে দ্বারকানগর বসিয়ে নিরাপদ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

সমুদ্রগুপ্তের যুগে যবনরা বোধহয় খুব বেশি প্রবল বা একতাবদ্ধ ছিল না। তারাও নানা স্থানে আলাদা আলাদা ছোট-বড় রাজ্য স্থাপন করে বাস করত।

উত্তর ভারতের এই সমস্ত একতাহীন হিন্দু, বৌদ্ধ ও যবন রাজা সমুদ্রগুপ্তের ভীষণ আক্রমণে মহাঝড়ে বনস্পতির মতো ধরাতলশায়ী হল। সমুদ্রগুপ্ত তাদের কারুকেই ক্ষমা করলেন না, নিজের সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য সকলের রাজ্যই একে একে নিলেন। অশোকস্তম্ভের গায়ে সমুদ্রগুপ্তের নিকটে পরাজিত প্রধান প্রধান নয়জন উত্তর ভারতীয় রাজার নাম খোদাই আছে বটে, কিন্তু একজন ছাড়া আর কারুর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ওই একজনের নাম হচ্ছে গণপতি নাগ, তাঁর রাজধানী ছিল পদ্মাবতী নগরে। সে স্থান এখন মহারাজা সিন্ধিয়ার রাজ্যের অন্তর্গত।

আজকের দিনে এক রাজা যদি শখ করে অন্যের রাজ্য কেড়ে নেন, তাহলে তাঁর নিন্দার সীমা থাকে না। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের যুগ ছিল প্রবলের যুগ, দুর্বলকে দমন করাই ছিল যেন তখন প্রবলের প্রধান কর্তব্য। সুতরাং আজকের মাপকাঠিতে সমুদ্রগুপ্তকে বিচার করা সঙ্গত হবে না। হিটলার ও মুসোলিনি আজ আবার যেই পুরাতন যুগধর্মকেই পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, দুর্বলের উপরে প্রভুত্ব করবার ইচ্ছাটা হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক ও চিরন্তন ইচ্ছা।

উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত দেশ জয় করে সমুদ্রগুপ্ত আবার অযোধ্যায় ফিরে এলেন। কিন্তু তখনও তাঁর দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা শান্ত হয়নি, কারণ তখনও দক্ষিণ ভারত রয়েছে তাঁর নাগালের বাইরে এবং পিতার কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সমগ্র ভারতের উপরে তুলবেন তাঁর গৌরবময় পতাকা।