» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

নরম বটে নারীর বাহু;

সেই বাহুতেই বন্দি রাহু!

‘সৈন্যগণ! আজ তোমরা যে পবিত্র পুরীর আশ্রয় গ্রহণ করেছ, এর চেয়ে স্মরণীয় নগর ভারতে আর দ্বিতীয় নেই! এ হচ্ছে অযোধ্যাধাম—মহারাজা দিলীপ, রঘু, ভগীরথ, রামচন্দ্রের লীলাভূমি! এরই কীর্তিগাথা উচ্চারণ করে মহাকবি বাল্মীকি আজ অমর হয়েছেন। আমি পাটলিপুত্রের ছেলে, আমার সামনে জাগছে বটে মগধের দিগবিজয়ী চন্দ্রগুপ্তের আদর্শ, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সামনে ছিল পৃথিবীজয়ী রঘুরই আদর্শ। তিনি একদিন অযোধ্যারই সিংহদ্বার দিয়ে বেরিয়েছিলেন বিশ্বজয় করতে। তাঁর অপূর্ব তরবারির অগ্নিজ্বালা দেখে কেবল সমগ্র ভারতই তাঁকে প্রণাম জানায়নি, তাঁর পায়ের তলায় লক্ষ লক্ষ মাথা নত করেছিল অভারতীয় যবনরা পর্যন্ত। তাঁরই পৌত্র শ্রীরামচন্দ্রের বীরত্ব কাহিনি তোমাদের কাছে আর নতুন করে বলবার দরকার নেই। একদিন এই অযোধ্যা ছিল আসমুদ্র হিমাচলের অধিশ্বরী, আজ আমরাও আবার তার পূর্বগৌরব ফিরিয়ে আনতে চাই! সম্রাট রঘুর পদচিহ্নই হবে আমাদের অগ্রগতির সহায়—উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিমের সর্বত্রই পড়বে আমাদের তরবারির ছায়া! অযোধ্যার রঘু করেছিলেন পৃথিবী-বিজয়, অযোধ্যার রামচন্দ্র করেছিলেন ভারত ও লঙ্কা জয়, আর আজ অযোধ্যার সমুদ্রগুপ্তও করতে চায় সমগ্র আর্যাবর্ত জয়! আমরা আদর্শচ্যুত হিন্দু কাপুরুষ বধ করব, স্বদেশের শত্রু যবন বধ করব, অত্যাচারী শক বধ করব,—উত্তপ্ত রক্তবাদলের ধারায় আর্যাবর্তের আহত আত্মার উপর থেকে বহুযুগের সঞ্চিত কলঙ্কের চিহ্ন মুছিয়ে দেব! কিন্তু মনে রেখো ভারতের সন্তানগণ! এ হচ্ছে অতি কঠোর ব্রত। এ ব্রত উদ্যাপন করতে গেলে তোমাদের সকলেই প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হবে—শত্রুর রক্তের সঙ্গে মেশাতে হবে তোমাদের নিজেদের রক্ত। আমি মৃত্যুপণ করেছি, তোমাদেরও করতে হবে মৃত্যপণ। তোমাদের অনেকেই আর দেশে ফিরে আসতে পারবে না, এটা জেনেও তোমরা কি আমার সঙ্গে যাত্রা করতে রাজি আছ?’

আকাশ কাঁপিয়ে বিরাট জনতার মধ্যে দৃপ্ত স্বর জাগল—’মৃত্যুপণ, মৃত্যুপণ! আমরা মৃত্যুপণ করলুম! জয়, মহাবীর সমুদ্রগুপ্তের জয়!’

প্রকাণ্ড প্রাসাদ। প্রভাত সূর্যের প্রখর কিরণে প্রাসাদের অমল শুভ্রতা জ্বলছে যেন জ্বল জ্বল করে। অলিন্দের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন সমুদ্রগুপ্ত—পরনে তাঁর যোদ্ধার বেশ, হস্তে তাঁর মুক্ত কৃপাণ।

প্রাসাদের সামনেই মস্ত একটি ফর্দা জায়গা পরিপূর্ণ করে যে বিপুল জনতার সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে কত হাজার লোক আছে আন্দাজে তা বলা অসম্ভব। তার মধ্যে অশ্বারোহী আছে, গজারোহী আছে, রথারোহী আছে, পদাতিক আছে, সে জনতার মধ্যে সুসজ্জিত সৈনিক ছাড়া আর কারুর স্থান হয়নি।

তিনমাস ধরে প্রাণপণ চেষ্টায় সমুদ্রগুপ্ত এই বৃহৎ বাহিনী সংগ্রহ করেছেন এবং আজ তাঁর সৈন্য পরিদর্শনের দিন।

এতক্ষণ ধরে তিনি জ্বলন্ত ভাষায় সৈন্যদের উত্তেজিত করেছিলেন, এখন তাদের মুখে মৃত্যুপণের কথা শুনে সমুদ্রগুপ্তের ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল প্রসন্ন হাসি।

তিনি আবার উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘সৈন্যগণ, তোমরা আমার সাধুবাদ গ্রহণ করো। দিগ্বিজয় করবে তোমরাই, আমি কেবল তোমাদের পথপ্রদর্শক মাত্র। তোমাদের সাজসজ্জা, নিয়মানুবর্তিতা দেখে আমি অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছি, আর তোমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা শুনে বুঝতে পারছি, আমার আদর্শ তোমরা গ্রহণ করতে পেরেছ। আর এক সপ্তাহ পরেই তোমাদের সঙ্গে হবে আমার যাত্রা শুরু। আজ আমার আর কোনও বক্তব্য নেই। তোমরা এখন সৈন্যাবাসে ফিরে যাও।’

হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিকদের মধ্যে জাগ্রত হল গতির চাঞ্চল্য। শোনা গেল সেনাপতিদের উচ্চ আদেশবাণী।…দলে দলে বিভক্ত হয়ে শ্রেণিবদ্ধ সৈন্যরা ফিরে চলল সেনাবাসের দিকে—শত শত পতাকাদণ্ডে, রথচূড়ার এবং হাজার হজার বর্শায় শূন্য হয়ে উঠল কণ্টকিত!

সমুদ্রগুপ্ত গর্ব-প্রফুল্ল দৃষ্টিতে তাঁর সযত্নে সংগৃহীত বাহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তারা সকলে যখন অদৃশ্য হল, তিনি তখন ধীরে ধীরে অলিন্দ ছেড়ে প্রাসাদের ভিতর প্রবেশ করলেন এবং পোশাক ছাড়বার জন্যে গেলেন নিজের ঘরের ভিতর।

ঘরে ঢুকে দেখলেন, গবাক্ষের কাছে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে পদ্মাবতী। শুধোলেন, ‘পদ্মা, তুমি এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন?’

সে কথার জবাব না দিয়ে পদ্মা প্রশ্ন করল, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, তুমি এঘর থেকে কখন বেরিয়ে গিয়েছ?’

‘সূর্যোদয়ের আগে। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

‘তাহলে তুমি যাওয়ার পরে এ ঘরে অন্য কেউ ঢুকেছিল।’

‘আশ্চর্য কী, ভৃত্যরা!’

‘ভৃত্য নয় চন্দ্রপ্রকাশ, ভৃত্য নয়। ভৃত্যরা উদ্যানের ভিতর থেকে গবাক্ষপথ দিয়ে কাদামাখা পায়ে ঘরের ভিতরে ঢোকে না। এই দেখো—’

সমুদ্রগুপ্ত বিস্মিত চোখে দেখলেন, গবাক্ষের কাছ থেকে একসার কর্দমাক্ত পদচিহ্ন বরাবর তাঁর শয্যার কাছ পর্যন্ত চলে গিয়েছে এবং আর একসার পদচিহ্ন আবার ফিরে এসেছে গবাক্ষের কাছে।

‘দেখছ চন্দ্রপ্রকাশ? গবাক্ষ দিয়ে কেউ ঘরের ভিতরে ঢুকে আবার গবাক্ষপথেই উদ্যানের ভিতরে ফিরে গিয়েছে! কাল রাতে বৃষ্টি পড়েছিল বলেই সে তার কর্দমাক্ত পদচিহ্ন গোপন করতে পারেনি! কিন্তু কে সে?’

সমুদ্রগুপ্ত হাস্য করে বললেন, ‘চোর এসেছিল পদ্মা! কিন্তু এ ঘরে ধনরত্ন না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছে।…উদ্যানে ও কে ভ্রমণ করছে? কবি হরিসেন? পদ্মা, এই নাও আমার তরবারি আর ধনুক-বাণ, কবির সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি।’

‘কিন্তু চন্দ্রপ্রকাশ, এই সাহসী চোরের কথা এত সহজে তুমি উড়িয়ে দিও না—’

‘পদ্মা, ও-জন্যে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। যাদের চোর ধরা ব্যবসা তাদের খবর দাও’—বলতে বলতে সমুদ্রগুপ্ত ঘরের ভিতর থেকে অদৃশ্য হলেন।

উদ্যানের ভিতরে গিয়ে সমুদ্রগুপ্ত দেখলেন, হরিসেন একটি লতাকুঞ্জের ছায়ায় মর্মর-বেদির উপরে বসে আছেন।

তাঁকে দেখে হরিসেন সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠতেই সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘বসো কবি, বসো। আমি এসেছি তোমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ কাব্যচর্চা করতে।’

হরিসেন বললেন, ‘রাজকুমার, আমার কবিতা আজ পলাতকা!’

‘পলাতকা কেন?’

‘যুদ্ধের দামামা শুনে আমার কবিতা আজ ভয় পেয়েছে!’

‘কবিতা ভয় পেয়েছে যুদ্ধের দামামা শুনে? ভুল কবি, ভুল। কবিতা কি কেবল কোমলা? তার বুকে কি বজ্রের আগুন বাস করে না? ক্রৌঞ্চ পাখির মৃত্যু-ব্যথায় বাল্মীকির যে কবিতা হয়েছিল কেঁদে সারা, বীরবর রামচন্দ্রের সঙ্গে সেও কি শত শত যুদ্ধযাত্রা করে অস্ত্র ঝনঝনার ছন্দে ছন্দে নৃত্য করতে পারেনি? হরিসেন, বন্ধু! যোদ্ধারা কেবল অস্ত্র ধরতে পারে, কিন্তু দেশ জাগাবার মন্ত্র শোনাবে তোমরাই। দেশ না জাগলে অস্ত্র ধরে কোনও লাভ নেই। শোনো কবি, তুমি প্রস্তুত হও,—আমার সঙ্গে তুমিও যাবে দিগ্বিজয়ে!’

বিস্ময়ে অভিভূত স্বরে হরিসেন বললেন, ‘আমিও যাব দিগ্বিজয়ে! রাজকুমার, লেখনী চালনা করে আমি কি শত্রু বধ করতে পারি?’

‘তরবারি চালনা করে মানুষ মারা যায় বটে, কিন্তু লেখনী চালনা করে তোমরা মানুষকে অমর করতে পারো! বাল্মীকির কাব্যই আজও রামচন্দ্রকে জীবন্ত করে রেখেছে। বন্ধু, আমি চাই তুমিও আমার দিগবিজয় স্বচক্ষে দেখে বর্ণনা করো। যদি সফল হই তোমার কাব্যের প্রসাদে আমিও অমর হয়ে থাকব যুগ-যুগান্ত পর্যন্ত! কবি,—’

হঠাৎ পিছনে এক আর্তনাদ উঠল, সমুদ্রগুপ্ত ও হরিসেন দুজনেই সচমকে ফিরে দেখলেন, একটা মনুষ্য-মূর্তি উদ্যান-পথে পড়ে বিষম যন্ত্রণায় ছটফট করছে!

সমুদ্রগুপ্ত তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই সে মূর্তি নিস্পন্দ!

হরিসেন বললেন, ‘রাজকুমার, এর বুকে বিঁধে রয়েছে একটা তির!’

সমুদ্রগুপ্ত ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমার উদ্যানে নরহত্যা। কে এ কাজ করলে?’

‘আমি করেছি চন্দ্রপ্রকাশ, তোমারই ধনুকে বাণ জুড়ে আমি একে হত্যা করেছি!’ সমুদ্রগুপ্ত বিপুল বিস্ময়ে দেখলেন, একটা গাছের আড়াল থেকে ধনুক-হাতে বেরিয়ে এল পদ্মাবতী!

‘পদ্মা!’

‘বিস্মিত হচ্ছ কেন চন্দ্রপ্রকাশ! তুমি কি ভুলে গিয়েছ ধনুর্বিদ্যা শিখেছি আমি তোমার কাছ থেকেই?’

‘ভুলিনি। এও জানি তোমার লক্ষ্য অব্যর্থ। কিন্তু তুমি লক্ষ করতে কেবল গাছের ফুল আর ফলকে। তোমার বাণে কোনওদিন একটা পাখি পর্যন্ত মরেনি, আর আজ তুমি করলে কিনা নরহত্যা!’

‘এজন্যে আমি দুঃখিত বটে, কিন্তু কী করব বলো চন্দ্রপ্রকাশ? তোমার শয়নগৃহের গবাক্ষ থেকে দেখতে পেলুম, এই লোকটা চোরের মতো পা টিপে টিপে একখানা শাণিত ছোরা নিয়ে তোমার পিছনে পিছনে আসছে। তখনই তোমার ধনুকবাণ নিয়ে আমিও বাইরে বেরিয়ে এলুম। তারপর যখন তোমাকে লক্ষ করে লোকটা অস্ত্র তুললে, আমাকেও বাধ্য হয়েই বাণ ত্যাগ করতে হল!’

‘গুপ্তঘাতক! তাহলে এরই পদচিহ্ন দেখেছি আমার ঘরে! পদ্মা—পদ্মা, তুমিই আমার জীবন রক্ষা করলে! তখন এ কথা—’

সমুদ্রগুপ্তের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল, প্রাসাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে সৈনিক বেশধারী এক পুরুষ বেগে দৌড়ে আসছে, তার সর্বাঙ্গ ধূলি-ধূসরিত!

সমুদ্রগুপ্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘মগধ সেনানী মহানন্দ?’

মহানন্দ কাছে এসে জানু পেতে বসে পড়ে বললে, ‘জয় মগধের মহারাজা সমুদ্রগুপ্তের জয়! তাহলে আমি ঠিক সময়েই আসতে পেরেছি।’

‘মহানন্দ, মগধের মহারাজা হচ্ছেন আমার দাদা।’

‘কচ এখন পরলোকে। মন্ত্রীরা তাঁকে হত্যা করেছেন।’

‘হত্যা করেছেন!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! একে তো কচের অত্যাচারে এরই মধ্যে রাজ্যময় হাহাকার উঠেছিল, তার উপরে মন্ত্রীরা চরের মুখে খবর পান যে আপনাকে হত্যা করবার জন্যে কচ এক গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছেন। তাই শুনে মন্ত্রীরা ক্রুদ্ধ হয়ে কচকে হত্যা করে আপনাকে সাবধান করবার জন্যে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন!’

‘ওইদিকে চেয়ে দেখো মহানন্দ, সেই ঘাতক এখন নিজেই নিহত! আমার বান্ধবী পদ্মাবতী ওর কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন। এদিকে এগিয়ে এসো বান্ধবী, তোমাকে একবার ভালো করে দেখি! বন্ধু হরিসেন, নারীও কি তোমার কবিতার মতো কোমলা নয়? দেখো দরকার হলে কোমলা নারীও বজ্রের মতো কঠিন হতে পারে কিনা!’

পদ্মাবতী লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, তোমার ধনুক ফিরিয়ে নাও।’

মহানন্দ বললে, ‘মহারাজ, মগধের সিংহাসন খালি। এখন আপনাকে যে পাটলিপুত্রে প্রত্যাগমন করতে হবে!’

সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘অসম্ভব! তুমি কি শোনোনি, মহানন্দ, স্বর্গীয় পিতৃদেবের মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, আর্যাবর্ত জুড়ে স্বাধীন ভারত-সাম্রাজ্য স্থাপন না করে পাটলিপুত্রে আর ফিরে আসব না?’

‘তাহলে রাজ্যচালনা করবে কে?’

‘আমার মাতা মহারানি কুমারদেবী, আর আমার গুরুদেব বসুবন্ধু।’