» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বাহু কারুর শক্ত হলেই

বীর-বাহু তো বলব না।

বীরত্ব দেয় আত্মা কেবল,—

এ নয় আমার কল্পনা।

মহারানি কুমারদেবী ফিরে গেলেন তাঁর পিতৃরাজ্যে বৈশালীতে।

চন্দ্রপ্রকাশ ধরলেন অযোধ্যার পথ। সঙ্গে তাঁর এক হাজার লিচ্ছবি সৈন্য।

পাটলিপুত্রের নাগরিকেরা দলে দলে এসে তাঁর পথ জুড়ে দাঁড়াল। সাশ্রুনেত্রে তারা আবেদন জানালে—’যুবরাজ, আমাদের ত্যাগ করে কোথায় চললে তুমি? সিংহাসন গ্রহণ না করো, আমাদেরও তোমার নির্বাসনের সঙ্গী করে নাও।’

জনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন বসুবন্ধু—তাঁর প্রশান্ত মুখ স্নিগ্ধ হাসির আভায় সুমধুর। তাঁকে দেখেই চন্দ্রপ্রকাশ ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে তাঁর পদধূলি গ্রহণ করলেন।

বসুবন্ধু দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘বৎস, মগধের সিংহাসনকে রাজ্যলোভে তুমি যে রক্তাক্ত করে তুললে না, এজন্যে আমার আনন্দের সীমা নেই। মানুষের তরবারি বড় নয়, বড় হচ্ছে মানুষের আত্মাই! আসল যোদ্ধা বলি আমি তাঁকেই, আত্মার শক্তিতে যিনি দিগ্বিজয় করতে পারেন।’

চন্দ্রপ্রকাশ বিনীতভাবে বললেন, ‘গুরুদেব, আমাকে ক্ষমা করবেন। বুদ্ধদেব আত্মার শক্তিতেই দিগবিজয় করেছিলেন, তাঁর হাতে ছিল না বটে তরবারি। কিন্তু আপনি কি বলতে চান, আত্মার শক্তি না থাকলে কেউ তরবারি ধারণ করতে পারে? অর্জুন যখন সশস্ত্র হয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছিলেন তখন কি তাঁর আত্মা ছিল দুর্বল? বাহু তো বীরেরও আছে ভীরুরও আছে—কিন্তু সত্যিকার তরবারি চালনা করে কে? বাহু, না আত্মা?…না গুরুদেব, আমি সিংহাসন ত্যাগ করলুম বটে, কিন্তু তরবারি ত্যাগ করিনি! এখন এই তরবারিই আমার একমাত্র সম্বল। এই তরবারি হাতে করেই এখন আমি জীবনের গহনবনে নিজের পথ কেটে নিতে চাই!’

বসুবন্ধু বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘বৎস, তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারলুম না।’

চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘প্রভু, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পিতা আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন—’পাটলিপুত্রের সিংহাসন পেয়ে তোমার প্রথম কর্তব্য হবে, দিগবিজয়ীর ধর্ম পালন করা, স্বাধীন ভারতে আবার আর্য আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা!’

‘কিন্তু চন্দ্রপ্রকাশ, পাটলিপুত্রের সিংহাসন তো তুমি গ্রহণ করোনি?’

‘গ্রহণ করিনি মায়ের আদেশে, গুরুদেব! কিন্তু পিতা বলেছেন আমাকে কাপুরুষ সংহার, যবন দমন করতে, ফিরিয়ে আনতে স্বাধীন ভারতে আবার ক্ষাত্র যুগকে! তাই আমি চলেছি আজ পিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করতে!’

হঠাং পিছন থেকে নারীকণ্ঠে শোনা গেল, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, চন্দ্রপ্রকাশ! তোমার পিতা শক্তিমান মহারাজা হয়েও যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করতে পারেননি, রাজ্যহারা সহায়হীন তুমি কেমন করে তা সফল করবে?’

চন্দ্রপ্রকাশ পিছন ফিরে দেখলেন, ইতিমধ্যে পদ্মাবতী কখন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু হেসে বললেন, ‘পদ্মা, এইমাত্র গুরুদেব বলছিলেন আত্মার শক্তিতে দিগবিজয় করবার জন্যে। সেই আত্মার শক্তি আমার আছে বলেই মনে করি। হতে পারি আমি সহায়সম্পদহীন—’

চন্দ্রপ্রকাশকে বাধা দিয়ে জনতার বহু কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘না, না, যুবরাজ! আমরা আপনার সহায় হব—আমরা সঙ্গে যাব!’

চন্দ্রপ্রকাশ উচ্চৈস্বরে বললেন, ‘বন্ধুগণ, একি তোমাদের মনের কথা?’

‘মনের কথা যুবরাজ, মনের কথা! আমরা আপনি ছাড়া আর কারুকে মানব না! আপনার জন্যে আমরা প্রাণ দিতে পারি।’

চন্দ্রপ্রকাশ মাথা নেড়ে বললেন, ‘কেবল প্রাণ নয় বন্ধুগণ, কেবল প্রাণ নয়! প্রাণের চেয়ে বড় হচ্ছে মানুষের আত্মা—দেশের কাজে, জাতির কাজে সেই আত্মাকে তোমরা দান করতে পারবে?’

‘যুবরাজ, আমাদের আত্মা, আমাদের ইহকাল, আমাদের পরকাল সমস্তই আমরা দান করব!’

গম্ভীরস্বরে চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘তাহলে সমুজ্জ্বল এই ভারতের ভবিষ্যৎ! বন্ধুগণ, বুঝতে পারছি আমাদের মধ্যে যে প্রাণশক্তি আছে, পাটলিপুত্রের ক্ষুদ্র সিংহাসন তা ধারণ করতে পারবে না—এর জন্যে দরকার মহাভারতের মহাসিংহাসন! গুরুদেব, তাহলে এখন আমাকে বিদায় দিন!’

বসুবন্ধু উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, কোনও কাজ করবার আগে ভেবে দেখা উচিত!’

চন্দ্রপ্রকাশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘আর আমি ভাবনার ধার ধারি না গুরুদেব! বাড়িতে যখন আগুন লাগে তখন কেউ মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসে না—তখন চাই কাজ! ভারত জুড়ে আজ আগুন লেগেছে—যবনের অত্যাচারের আগুনে ভারতের মন্দির, মঠ, তপোবন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, শত শত কাপুরুষ রাজা অধর্মের আগুন জ্বেলে ভারতের নিজস্ব সমস্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। এখন নেভাতে হবে সেই প্রচণ্ড আগুন! কিন্তু নদীর জলে নয়—চোখের জলেও নয়, সে ভারতব্যাপী আগুন নিভবে কেবল রক্তসাগরের ভীষণ বন্যায়।’

বসুবন্ধু আহত কণ্ঠে বললেন, ‘রক্তসাগরের বন্যায়? আমার প্রেমের শিক্ষা সব ভুলে গেলে চন্দ্রপ্রকাশ?’

‘ভুলিনি গুরুদেব, ভুলিনি! যে আকাশে থাকে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, সেখানেই দেখা দেয় উল্কা আর ধূমকেতু! কিন্তু উল্কাকে পেয়ে আকাশ কি চাঁদের মুখ ভুলে যেতে পারে? ভারতব্যাপী রক্তসাগরে মরব বলে আমরা ডুব দেব না, সাঁতার কেটে উঠব আবার শ্যামল তীরে!…বন্ধুগণ!’

হাজার হাজার কণ্ঠ সাড়া দিলে—’যুবরাজ!’

‘এখন কিন্তু রক্ত চাই, কেবল রক্ত! কেবল অত্যাচারী, কাপুরুষের, যবনের রক্ত নয়—আমাদেরও বুকের রক্ত! তবেই আমরা পাব পুরোনো প্রাণের বদলে নতুন প্রাণ—তবেই আমরা দেখব জীর্ণতার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন সৃষ্টি! ধরো তরবারি, গাও মৃত্যু-গান, ডাকো কল্কি অবতারকে—যুগে যুগে যিনি অধর্মের কবল থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেন!’

জনতার ভিতর থেকে কোশমুক্ত হয়ে হাজার হাজার তরবারি শূন্যে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিল তীব্র বিদ্যুৎ-মালা! হাজার হাজার কণ্ঠ বলে উঠল—’আমরা মারব—আমরা মরব। জয়, যুবরাজ চন্দ্রপ্রকাশের জয়!’

দৃপ্তকণ্ঠে চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘না—না বন্ধু, আজ থেকে আমি আর চন্দ্রপ্রকাশ নই। আজ এইখানে দাঁড়িয়ে আমার স্বর্গীয় পিতার নাম নিয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ভারতের পূর্ব-সমুদ্র থেকে পশ্চিম-সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত নতুন এক স্বাধীন আর্যাবর্ত গড়ে তুলব! এ প্রতিজ্ঞা যাতে সর্বক্ষণ মনে থাকে, সেইজন্যে আমি নাম গ্রহণ করলুম—সমুদ্রগুপ্ত!’

জনতা বিপুল উৎসাহে বলে উঠলেন—’জয়, সমুদ্রগুপ্তের জয়!’

সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘শোনো বন্ধুগণ! আপাতত তোমরা নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যাও, আমিও যাত্রা করি পবিত্র অযোধ্যাধামে। একদিন এই অযোধ্যা ছিল মহাক্ষত্রিয় সূর্যবংশের রাজা শ্রীরামচন্দ্রের রাজধানী। বহুযুগ পরে আবার অযোধ্যার গৌরব ফিরিয়ে আনবার জন্যে যথাসময়ে আমি তোমাদের আহ্বান করব। …প্রণাম গুরুদেব! বিদায় পদ্মা!’

সমুদ্রগুপ্ত তাঁর ঘোড়ার উপর চড়ে বসলেন। পদ্মাবতী ঘোড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল—তার দুই চোখ করছে ছলছল।

সমুদ্রগুপ্ত একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী পদ্মা, তোমার মুখ অমন ম্লান কেন? চলেছি পিতৃব্রত উদ্যাপন করতে, তুমি কি হাসি মুখে আমাকে বিদায় দেবে না?’

ভাঙা ভাঙা গলায় পদ্মাবতী বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ—’

‘আর চন্দ্রপ্রকাশ নই পদ্মা, সমুদ্রগুপ্ত!’

‘না চন্দ্রপ্রকাশ, না! যে নাম ধরে তুমি রক্তসাগরে সাঁতার কাটতে চাও, সে নামে আমি তোমাকে ডাকতে পারব না। আমার কাছে চিরদিন তুমি চন্দ্রপ্রকাশই থাকবে!’

‘বেশ, তাই ভালো পদ্মা! এখন পথ আমাকে ডাক দিয়েছে, আর সময় নেই। তুমি কী বলতে চাও, বলো।’

‘চন্দ্রপ্রকাশ, এতদিন তোমার সঙ্গে লেখাপড়া শিখেছি, গল্প-খেলা করেছি, গান গেয়েছি, বাঁশি বাজিয়েছি। আর আজ তুমি একেবারেই আমাকে ফেলে চলে যাবে?’

‘ভয় নেই পদ্মা, ভয় নেই! কর্তব্য শেষ করে আবার আমি ফিরে আসব, আবার বাঁশি বাজাব, আবার গান শুনব। বিদায়—’ সমুদ্রগুপ্ত ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন। তাঁর পিছনে পিছনে ছুটল এক হাজার লিচ্ছবি সওয়ার!

ঘোড়ার পায়ের ধুলো যখন দূরে মিলিয়ে গেল, পদ্মাবতীও তখনও শূন্যদৃষ্টিতে পথের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ পরে তার দুই চোখ উপছে অশ্রু ঝরতে লাগল।

বসুবন্ধু এগিয়ে এসে মমতাভরে মেয়ের মাথার উপরে হাত রেখে ধীরে ধীরে বললেন, ‘মিছেই তুই কাঁদছিস পদ্মা! সিংহের শাবক শুনেছে বনের ডাক, ঘরোয়া স্নেহ দিয়ে আর ওকে ধরে রাখতে পারবি না!’

পিতার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পদ্মাবতী বললে, ‘বাবা, পাটলিপুত্রে আর আমি থাকতে পারব না!’

‘আমিও পারব না মা, আমিও পারব না। কচের রাজ্যে বাস করার চেয়ে অরণ্যে বাস করা ভালো!’

‘তবে আমরাও অযোধ্যায় যাই চলো!’

‘অযোধ্যায়! কেন, সেখানে চন্দ্রপ্রকাশ আছে বলে? কিন্তু শুনলি তো, দুদিন পরে অযোধ্যা ছেড়ে সে দিগ্বিজয়ে বেরুবে?’

‘তবু অযোধ্যাই ভালো, বাবা! আরও দুদিন তো চন্দ্রপ্রকাশের সঙ্গে থাকতে পারব?’