» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বীরের বাহু ধরায় অতুল,

নয় সে কোথাও নিঃস্ব,

মরুভূমেও সৃষ্টি করে

নতুন কত বিশ্ব!

চন্দ্রপ্রকাশের পদধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঘরের বাইরে শোনা গেল বহুকণ্ঠে কোলাহল ও সঙ্গে সঙ্গে জয়ধ্বনি—’জয়, মহারাজা কচগুপ্তের জয়!’

কুমারদেবী নিজের মনেই অভিভূত স্বরে বললেন, ‘এখনও অভিষেক হয়নি, এখনও মহারাজের মৃতদেহ শীতল হয়নি, এরই মধ্যে কচ হয়েছে মহারাজা! কী সুপুত্র!’

ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য। কিন্তু তারা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবার আগেই, কুমারদেবী তাড়াতাড়ি এগিয়ে তাদের সামনে নিয়ে দাঁড়ালেন। তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাও তোমরা?’

মহারানিকে দেখে সৈনিকরা থতোমতো খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়াল। কেবল তাদের একজন বললে, ‘আমরা এসেছি কুমার চন্দ্রপ্রকাশের—’

বাধা দিয়ে কুমারদেবী বললেন, ‘না, কুমার নয়—বলো যুবরাজ চন্দ্রপ্রকাশ!’

পিছন থেকে ক্রুদ্ধ স্বরে শোনা গেল, আমি হচ্ছি জ্যেষ্ঠ পুত্র। এ রাজ্যের যুবরাজ হচ্ছি আমি।’

কুমারদেবী বললেন, ‘কে, কচ? কিন্তু কে বললে তুমি যুবরাজ? শুনছি তো এরই মধ্যে তুমি নাকি মহারাজা উপাধি পেয়েছ!’

কচ এগিয়ে এসে বললেন, ‘সিংহাসন শূন্য হলে তা প্রাপ্য হয় যুবরাজেরই। সেইজন্যেই আমার সৈনিকরা আমাকে ‘মহারাজা’ বলে সম্বোধন করছে।

প্রধানমন্ত্রী এতক্ষণ পরে কথা কইলেন। হতভম্ব ভাবটা সামলে নিয়ে তিনি বলনে, ‘রাজকুমার, স্বর্গীয় মহারাজের আদেশে এখন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছে চন্দ্রপ্রকাশ। সুতরাং ‘মহারাজা’ উপাধির উপরে আপনার আর কোনওই দাবি নেই!’

কচ কর্কশস্বরে বললেন, ‘বৃদ্ধ, আমার মুখের উপরে কথা কইতে তুমি সাহস করো! স্বর্গীয় মহারাজের আদেশ? কে শুনেছে তাঁর আদেশ?’

ঘরের ভিতর থেকে মন্ত্রীরা সমস্বরে বললেন, ‘আমরা সবাই শুনেছি।’

প্রচণ্ড ক্রোধে প্রায় আত্মহারা হয়ে কচ চিৎকার করে বললেন, ‘ষড়যন্ত্র। রাজভৃত্যদের এতবড় স্পর্ধা! সৈন্যগণ ওদের বন্দি করো। আর, সব ষড়যন্ত্রের মূল চন্দ্রপ্রকাশ কাপুরুষের মতো ঘরের ভিতরে কোথায় লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখো।’

কুমারদেবীর দুই চক্ষে জ্বলে উঠল আগুনের ফিনকি। দরজার দিকে দুই বাহু বিস্তার করে গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন, ‘স্বর্গীয় মহারাজা শুয়ে আছেন এখানে শেষ-শয়ানে। সাধারণ সৈনিক এসে এ ঘরের পবিত্রতা নষ্ট করবে? আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না! কচ—কচ, তোমার আদেশ প্রত্যাহার করো।’

কচ অধীর স্বরে বললেন, ‘সৈন্যগণ, এখন নারীর মিনতি শোনবার সময় নেই, যাও—আমার আদেশ পালন করো!’

কুমারদেবী বললেন, ‘কচ, আমি নারী হতে পারি, কিন্তু আমি তোমাদের মাতা!’

কচ উপহাসের হাসি হেসে বললেন, ‘ভুলে যাবেন না, আপনি আমার বিমাতা।’

কুমারদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘উত্তম। কিন্তু জেনে রাখো কচ, তোমার সৈন্যদের এ ঘরে ঢুকতে হবে আমার মৃতদেহ মাড়িয়ে!’

কচ বললেন, ‘শুনুন মহারানি, আমি এই শেষবার অনুরোধ করছি, হয় পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ান, নয় চন্দ্রপ্রকাশকে আমাদের হাতে এখনই সমর্পণ করুন।’

‘চন্দ্রপ্রকাশ এ ঘরে নেই।’

‘মিথ্যা কথা!’

তীব্রস্বরে কুমারদেবী বললেন, ‘কী! কার সঙ্গে কথা কইছ সে কথা কি তুমি ভুলে গিয়েছ? হতভাগ্য পুত্র, তুমি কি জানো না পবিত্র লিচ্ছবি রাজবংশে আমার জন্ম, স্বর্গীয় মহারাজা পর্যন্ত চিরদিন আমার বংশমর্যাদা রক্ষা করে চলতেন? এত স্পর্ধা তোমার, আমায় বলো মিথ্যাবাদী? তুমি কি ভাবছ, চন্দ্রপ্রকাশ এখানে থাকলে আমার এই অপমান সে সহ্য করত?’

হা হা করে হেসে উঠে কচ বললেন, ‘অপমান সহ্য করা ছাড়া তার আর উপায় কী—আমার সৈন্যদের হাতে হাতে জ্বলছে শাণিত তরবারি!…নারী, নারী, পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও, আমার ধৈর্যের উপরে আর অত্যাচার কোরো না!’

প্রধানমন্ত্রী ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘মহারানি, আপনি সরে আসুন, ওরা এসে দেখে যাক রাজকুমার ঘরের ভিতরে আছেন কিনা!’

গর্বিত, দৃঢ়স্বরে কুমারদেবী বললেন, ‘না, না মন্ত্রীমশাই, মহারাজের পবিত্র দেহ যেখানে আছে, এই হিংস্র পশুদের সেখানে আমি কিছুতেই পদার্পণ করতে দেব না। আমার স্বামীর, আমার দেবতার গায়ে পড়বে কুকুরের ছায়া? অসম্ভব!’

কচ কঠোর স্বরে বললেন, ‘সৈন্যগণ, এই নারীকে তোমরা বন্দি করো।’

পিছন থেকে সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর জাগল, ‘দাদা, কাকে তুমি বন্দি করবে?’

সচমকে ফিরে কচ সবিস্ময়ে দেখলেন, বিস্তৃত অলিন্দের উপরে এসে আবির্ভূত হয়েছেন চন্দ্রপ্রকাশ এবং তাঁর পিছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একদল লিচ্ছবি সৈন্য। প্রত্যেক সৈন্যের মস্তকে ও দেহে শিরস্ত্রাণ বর্ম, হাতে বর্শা, কোমরে তরবারি।

কুমারদেবী সভয়ে বলে উঠলেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, চন্দ্রপ্রকাশ। তুমিও আমার কথার অবাধ্য? হা অদৃষ্ট, মহারাজের শেষ নিশ্বাস-বায়ু হয়তো এখনও এখান থেকে লুপ্ত হয়নি, এর মধ্যেই রাজবাড়ির সমস্ত রীতিনীতি বদলে গেল? বেশ, তাহলে তোমরা দুই ভাই মিলে যত খুশি হানাহানি রক্তারক্তি করো, সে দৃশ্য আমি আর স্বচক্ষে দেখব না। কিন্তু দয়া করে একদিন তোমরা অপেক্ষা করো, ভ্রাতৃবিরোধ দেখবার আগেই মহারাজের সঙ্গে আমি সহগমন করতে চাই!’

চন্দ্রপ্রকাশ ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘মা, মা, তুমিও আমাকে ভুল বুঝো না মা! আমি তোমার অবাধ্য ছেলে নই!’

‘অবাধ্য ছেলে নও? তবে কেন তুমি আবার এখানে ফিরে এলে?’

‘মা, বাধ্যতারও কি একটা সীমা নেই? লিচ্ছবি সৈন্যদের সঙ্গে আমি তো গঙ্গাপার হয়ে বৈশালী রাজ্যের দিকে যাত্রা করেছিলুম। কিন্তু যেতে যেতে হঠাৎ আমার ভয় হল, মগধের রাজবাড়িতে হয়তো তোমার জীবনও আর নিরাপদ নয়। লিচ্ছবি সেনাপতিও সেই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তাই আমি ফিরে এসেছি আর দেখছি যে আমার ভয় অমূলক নয়।’

‘অন্যায় করেছ চন্দ্রপ্রকাশ, অন্যায় করেছ। আমার মতো তুচ্ছ এক নারীর জন্যে তুমি কি স্বদেশের প্রতি তোমার কর্তব্য পালন করবে না, নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে? শ্রীরামচন্দ্র যেদিন পিতার কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার জন্যে অরণ্যে যাত্রা করেন, সেদিন কি মা কৌশল্যার দুই চোখ শুকনো ছিল? কিন্তু মায়ের চোখে অশ্রু দেখে শ্রীরামচন্দ্র কি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গিয়েছিলেন?’

চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘প্রতিজ্ঞা আমি ভুলি নি মা, আমি কেবল তোমাকে রক্ষা করতে এসেছি।’

‘আমাকে রক্ষা করতে এসে যদি তোমার প্রাণ যায়, তাহলে কে সফল করবে আমার স্বামীর সারা জীবনের সাধনা, কে প্রতিষ্ঠিত করবে একচ্ছত্র স্বাধীন ভারতে সনাতন আর্য আদর্শ?’

‘মা, আর তুমি আমার বিপদের কথা ভেবে ভয় পেয়ো না। ফেরবার পথে স্বচক্ষে দেখেছি, সমস্ত পাটলিপুত্রের প্রজারা দলে দলে ছুটে আসছে প্রাসাদের দিকে—সকলেই করছে আমার নামে জয়ধ্বনি! দাদার পক্ষে আছে প্রাসাদের কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক রক্ষীসৈন্য মাত্র! এখানে দাঁড়িয়ে সেই হতভাগ্যরা তোমাকে কেবল ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু সারা পাটলিপুত্রের সামনে তারা ভেসে যাবে বন্যার তোড়ে খড়কুটোর মতো!’

কচ এতক্ষণ অবাক হয়ে সব শুনছিলেন। এতক্ষণ পরে তিনি আবার চিৎকার করে বললেন, ‘আক্রমণ করো, আক্রমণ করো! সৈন্যগণ, চন্দ্রপ্রকাশকে বন্দি করো—বধ করো! একমাত্র চন্দ্রপ্রকাশই হচ্ছে আমাদের পথে কণ্টকের মতো, ও কাঁটা তুলে ফেললেই সমস্ত পাটলিপুত্র আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে!’ এই বলেই তিনি নিজের খাপ থেকে তরবারি খুলে ফেললেন।

চন্দ্রপ্রকাশও নিজের অসিকে কোশমুক্ত করে বললেন, ‘দাদা, তুমি ভুলে যাচ্ছ, এখন আমি আর একলা নই! আমি যখন প্রাসাদে ফিরে আসি, তখনও তোমার অনুচররা অস্ত্র নিয়ে আমাকে বাধা দিতে এসেছিল। কিন্তু তারা এখন রক্তাক্ত মাটির উপরে শুয়ে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে!’

কচ তরবারি তুলে এগুতে এগুতে আবার বললেন, ‘আক্রমণ করো! হত্যা করো!’

কুমারদেবী ছুটে গিয়ে দুই দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ক্ষান্ত হও, তোমরা ক্ষান্ত হও!’

আচম্বিতে প্রাসাদের বাইরে জাগল সমুদ্র-নির্ঘোষের মতো এমন গভীর কোলাহল যে, সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিস্ময়ে চমৎকৃত হয়ে! তারপরেই শোনা গেল অসংখ্য অস্ত্রে অস্ত্রে ঝনৎকার, ভয়াবহ গর্জন, প্রচণ্ড চিৎকার, বিষম আর্তনাদ এবং সঙ্গে সঙ্গে হাজারহাজার কণ্ঠে জয়-নিনাদ!

প্রধানমন্ত্রী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘পাটলিপুত্রের প্রজারা প্রাসাদ আক্রমণ করেছে, তারা সিংহদ্বার ভেঙে আঙিনায় ঢুকেছে, যুবরাজ চন্দ্রপ্রকাশের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, প্রাসাদের অনেক প্রহরীর প্রাণ গিয়েছে, অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে!’

কুমারদেবী কঠিন স্বরে বললেন, ‘অপূর্ব! ঘরের ভিতরে মগধের মহারাজের মৃতদেহ, ঘরের বাইরে মগধের রাজপুত্ররা পরস্পরের কণ্ঠচ্ছেদ করতে উদ্যত, প্রাসাদের বাইরে মগধের প্রজারা বিদ্রোহী, প্রাসাদের ভিতরে মগধের সৈন্যরা বিশ্বাসঘাতক! অপূর্ব! মগধের ভবিষ্যৎ কী উজ্জ্বল! কচ, চন্দ্রপ্রকাশ, এখনও কি তোমাদের রক্ততৃষা শান্ত হয়নি?’

চন্দ্রপ্রকাশ তরবারি নামিয়ে বললেন, ‘মা, আমি তো কারুকে আক্রমণ করতে চাই না।’

‘তাহলে শীঘ্র প্রাসাদের বাইরে গিয়ে প্রজাদের শান্ত করে এসো।’

‘তোমাকে এইখানে একলা রেখে?’

‘হ্যাঁ শীঘ্র যাও। এখনও ইতস্তত করছ? যাও!’

চন্দ্রপ্রকাশ দ্রুতপদে প্রস্থান করলেন।

কুমারদেবী ফিরে শান্ত স্বরে বললেন, ‘বৎস কচ, দেখছ, রাজ্যলোভে তুমি কী সর্বনাশের আয়োজন করেছ?’

কচ নীরবে মাথা নত করলেন।

‘শোনো কচ। মহারাজের নিজের হাতে গড়া এত বড় রাজ্য যদি ভ্রাতৃবিরোধের ফলে ছারখার হয়ে যায়, তবে তার চেয়ে দুভার্গ্য আমার কল্পনায় আসে না। তুমি পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসতে চাও? বেশ, তোমার বাসনাই পূর্ণ হোক। আমাদের কেবল কিছুদিন সময় দাও, মহারাজের অন্ত্যেষ্টি আর পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ হোক—তারপর তুমি করবে রাজ্যশাসন, আর আমরা যাব নির্বাসনে!’

কচ সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘নির্বাসনে?’

‘হ্যাঁ, আমি যাব আমার পিতৃরাজ্যে ফিরে, আর চন্দ্রপ্রকাশ যাবে তার প্রতিজ্ঞাপালনের পথে। পাটলিপুত্র ছাড়া পৃথিবীতে আরও অনেক রাজ্যের—আরও অনেক সিংহাসনের অভাব নেই। এ বসুন্ধরা হচ্ছে বীরের ভোগ্য, আমার পুত্র বীর।’