» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ক্ষুদ্র কাজে মরতে যে চায়

হয় সে পশু, নয় সে দানব।

বৃহৎ ব্রত-উদযাপনে

মরতে পারে কেবল মানব!

পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদ ঘিরে রয়েছে আজ বিরাট জনতা। উৎসব করে জনতা সৃষ্টি, কিন্তু এ উৎসবের জনতা নয়। কারণ জনতার প্রত্যেকেরই মুখে-চোখে রয়েছে আসন্ন বিপদের আভাস।

রাজবাড়ির সিংহদ্বারের পিছনে ও প্রাঙ্গণের উপরে দেখা যাচ্ছে সজ্জিত ও সশস্ত্র সৈন্যের জনতা, সেখানে অসংখ্য শূল ও নগ্ন তরবারির উপরে প্রভাত-সূর্য জ্বেলে দিয়েছে যেন অসংখ্য বিদ্যুৎ-দীপের চঞ্চল শিখা!

রাজবাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার নাগরিক এবং দেখলেই বোঝা যায় শোক ও দুশ্চিন্তায় তারা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে।

কাতর হওয়ারই কথা। কেবল মহারাজাধিরাজ চন্দ্রগুপ্তের অন্তিমকাল উপস্থিত হয়েছে বলেই প্রজারা ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় এমন ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এই প্রজাবৎসল মহারাজাকে তারা সবাই ভালোবাসত বটে, কিন্তু একথাও সকলে জানত যে কাল পূর্ণ হলে পৃথিবীতে কেউ বর্তমান থাকতে পারে না। তাদের দুর্ভাবনার অন্য কারণ আছে।

আমরা যে যুগের কথা বলতে বসেছি তখন পৃথিবীর সব দেশেই রাজার মৃত্যু হলে প্রজার আতঙ্কের সীমা থাকত না। কারণ প্রায়ই মৃত রাজার সিংহাসন লাভের জন্য রাজপুত্রদের ও রাজবংশীয় অন্যান্য লোকদের মধ্যে ঘরোয়া যুদ্ধের অবতারণা হত এবং সেই যুদ্ধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত রাজ্যের মধ্যে। নতুন রাজাকে সিংহাসনে বসতে হত মানুষের রক্ত-সমুদ্রে সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে।

তাই এই সংকট-মুহূর্তে সমগ্র পাটলিপুত্রের প্রজারা আজ রাজবাড়ির কাছে ছুটে এসেছে এবং উত্তেজিতভাবে অদূর-ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে করছে নানান রকম জল্পনা-কল্পনা।

এমন সময়ে অদূরে দেখা গেল, বিবর্ণ মুখে দ্রুতপদে এগিয়ে আসছেন রাজকুমার চন্দ্রপ্রকাশ।

সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়ে জনতা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দূরে সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে চিৎকার উঠল—’জয়, যুবরাজের জয়!’

চন্দ্রপ্রকাশ সিংহদ্বারের সামনে গিয়ে বিস্মিত নেত্রে দেখলেন, তাঁর পথ জুড়ে অটল প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে একদল সশস্ত্র প্রহরী।

তিনি অধীর স্বরে বললেন, ‘তোমরা মূর্খের মতো পথ বন্ধ করে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

প্রহরীদের দলপতি এক পা না সরেই বললে, ‘রাজবাড়ির ভিতরে এখন আর কারুর ঢুকবার আদেশ নেই।’

ক্রুদ্ধস্বরে চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘আদেশ নেই! কে দিলে এই আদেশ?’

‘মগধ রাজ্যের যুবরাজ।’

জনতার ভিতর থেকে চিৎকার করে কে বললে, ‘মূর্খ দৌবারিক! পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও। মগধের যুবরাজকে সামনে দেখেও চিনতে পারছ না?’

প্রহরী নির্ভীক কণ্ঠে বললে, ‘মগধের যুবরাজ হচ্ছেন কচগুপ্ত। আমরা তাঁরই আদেশ মানব।’

চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘মহারাজা আমাকে আহ্বান করেছেন। তোমরা যদি পথ না ছাড়, আমি কোশ থেকে তরবারি খুলতে বাধ্য হব।’

প্রহরী দৃঢ়স্বরে বললে, ‘আমরাও তা হলে রাজকুমারকে বাধা দিতে বাধ্য হব।’

চন্দ্রপ্রকাশ কিছু বলার আগেই জনতার ভিতর থেকে জেগে উঠল বহু কণ্ঠে ক্রুদ্ধ গর্জনধ্বনি। তুচ্ছ এক প্রহরী মগধের রাজকুমারের মুখের উপরে স্পর্ধার কথা বলতে সাহসী হয়েছে দেখে অনেকে তাকে আক্রমণ করবার জন্যে ছুটে এল। প্রহরীরাও আত্মরক্ষা করবার জন্যে প্রস্তুত হল।

তখন কী রক্তাক্ত দৃশ্যের সূচনা হত বলা যায় না, কিন্তু সেই মুহূর্তেই রাজবাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এলেন এক প্রাচীন পুরুষ—তাঁর মাথায় শুভ্র কেশ, মুখে শুভ্র শ্মশ্রু, পরনে বহুমূল্য শুভ্র পোশাক। সকলেই চিনলে, তিনি হচ্ছেন মগধের প্রধানমন্ত্রী।

প্রহরীরা সসম্মানে তাঁকে অভিবাদন করলে।

মন্ত্রী বললেন, ‘এ কী বীভৎস ব্যাপার! উপরে মুমূর্ষু মহারাজ, আর এখানে এই অশান্তি!’

দৌবারিকদের নেতা বললে, ‘আমরা কী করব প্রভু? যুবরাজের আদেশেই আমরা দ্বার রোধ করে দাঁড়িয়ে আছি!’

মন্ত্রী মহাশয় দুই ভুরু সঙ্কুচিত করে বললেন, ‘মহারাজা জীবিত থাকতে এ রাজ্যে তাঁর উপরে আর কারুর কথা বলবার অধিকার নেই। মহারাজ স্বয়ং রাজকুমার চন্দ্রপ্রকাশকে স্মরণ করেছেন। যদি মঙ্গল চাও, তাহলে এখনই তোমরা রাজকুমারের পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও!’

প্রহরীরা একবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলে। তারপর পথ ছেড়ে দিলে বিনা বাক্যব্যয়ে।

চন্দ্রপ্রকাশ কোনওদিকে না তাকিয়েই ছুটে চললেন রাজবাড়ির দিকে এবং যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন, মহারাজা এখনও পৃথিবীতে বর্তমান, কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কত বড় একটা ষড়যন্ত্রের আয়োজন হয়েছে!

মহারাজের শয়ন-আগারে উপস্থিত হয়ে দেখলেন সুবর্ণখচিত ও হস্তীদন্তে অলঙ্কৃত প্রশস্ত পালঙ্কের উপরে দুই চোখ মুদে শুয়ে আছেন মহারাজাধিরাজ চন্দ্রগুপ্ত—তাঁর মুখে আসন্ন মৃত্যুর ছায়া। মহারাজের শিয়রের কাছে পাখা হাতে করে সাশ্রুনেত্রে বসে আছেন পাটরানি ও চন্দ্রপ্রকাশের মা কুমারদেবী এবং তাঁর পাশে অন্যান্য রানি ও পুরমহিলারা। পালঙ্কের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন রাজপুত্র কচ এবং ঘরের ভিতরেই খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন অমাত্য ও বড় বড় রাজকর্মচারী।

চন্দ্রপ্রকাশ ছুটে গিয়ে একবারে খাটের পাশে নতজানু হয়ে বসে পড়ে অশ্রুজলে গাঢ়স্বরে ডাকলেন, ‘মহারাজ, মহারাজ!’

চন্দ্রগুপ্ত সচমকে চোখ খুললেন, তাঁর মৃত্যুকাতর মুখও হাস্যে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল। ক্ষীণ স্বরে তিনি বললেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, এতক্ষণ আমি তোমারই অপেক্ষায় ছিলুম!’

‘মহারাজ!’

‘পৃথিবীর রাজ্য আমি পৃথিবীতেই রেখে যাচ্ছি বৎস, এখন আমাকে আর মহারাজ বলে ডেকো না। বলো, বাবা!’

‘বাবা, বাবা!’

‘হ্যাঁ, ওই নামই বড় মিষ্টি।…মন্ত্রীমশাই, আমার হাতে আর বেশি সময় নেই, যা বলি মন দিয়ে শুনুন। আপনারা সবাই এখানে জানতে এসেছেন, আমার অবর্তমানে মগধের সিংহাসনের অধিকারী হবেন কে? তাহলে চেয়ে দেখুন এই চন্দ্রপ্রকাশের—এই মহৎ যুবকের দিকে। বিদ্যা, বুদ্ধিতে অদ্বিতীয়, বীরত্বে আর চরিত্রবলে অসাধারণ চন্দ্রপ্রকাশকে আপনারা সকলেই জানেন। এখন বলুন, চন্দ্রপ্রকাশ কি অযোগ্য ব্যক্তি?’

মন্ত্রীগণ ও অন্যান্য সভাসদদের ভিতর থেকে নানা কণ্ঠে শোনা গেল, ‘নিশ্চয়ই নয়, নিশ্চয়ই নয়!’—’মহারাজের জয় হোক!’—’আমরা ওঁকেই চাই!’ প্রভৃতি।

চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘এটাও কারুর অবিদিত নেই যে পবিত্র আর মহা সম্ভ্রান্ত লিচ্ছবি বংশের রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করেই আজ আমার এত মানমর্যাদা। মগধের রাজধানী এই পাটলিপুত্রও আমি যৌতুকরূপে পেয়েছি সেই বিবাহের ফলে। সুতরাং কুমারদেবীর পুত্রেরও পাটলিপুত্রের সিংহাসনের উপরে একটা যুক্তিসঙ্গত দাবি আছে। নয় কি মন্ত্রীমশাই?’

প্রধানমন্ত্রী উৎসাহিত স্বরে বললেন, ‘মহারাজ, আপনার আদেশ এ রাজ্যের সবাই সানন্দে মাথা পেতে গ্রহণ করবে। সমস্ত মগধরাজ্যে রাজকুমার চন্দ্রপ্রকাশের চেয়ে যোগ্য লোক আর দ্বিতীয় নেই।’

চন্দ্রগুপ্ত সস্নেহে চন্দ্রপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাছা, শেষ নিশ্বাস ফেলবার আগে আমি তোমাকে একবার আলিঙ্গন করতে চাই।’

চন্দ্রপ্রকাশ কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়িয়ে পিতার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চন্দ্রগুপ্তের চোখও অশ্রুসজল।

এইভাবে কিছুক্ষণ থেকে চন্দ্রগুপ্ত হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, উঠে দাঁড়াও!’

পিতার কণ্ঠস্বর পরিবর্তনে বিস্মিত হয়ে চন্দ্রপ্রকাশ শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘পিতা?’

‘প্রতিজ্ঞা করো!’

‘কী প্রতিজ্ঞা, পিতা?’

চন্দ্রগুপ্ত নিজের সব শক্তি একত্র করে পরিপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘কঠোর প্রতিজ্ঞা! জানো চন্দ্রপ্রকাশ, আমার জীবনের একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, বিপুল আর্যাবর্ত জুড়ে করব একচ্ছত্র সাম্রাজ্য বিস্তার, কাপুরুষ সংহার, যবন দমন।  মহাভারতে আবার ফিরিয়ে আনব সেই কতকাল আগে হারানো ক্ষাত্র যুগকে! কিন্তু কী সংক্ষিপ্ত এই মানুষজীবন! যে ব্রত গ্রহণ করেছিলুম তা সাঙ্গ করে যাওয়ার সময় পেলুম না, তাই আমি তোমাকে এই পৃথিবীতে রেখে যেতে চাই আমারই প্রতিনিধি রূপে। পাটলিপুত্রের সিংহাসন পেয়ে তোমার প্রথম কর্তব্য হবে, দিগবিজয়ীর ধর্ম পালন করা, স্বাধীন ভারতে আবার আর্য আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। পারবে?’

চন্দ্রগুপ্তের দুই চরণ স্পর্শ করে চন্দ্রপ্রকাশ সতেজে বললেন, ‘পারব পিতা, পারব! আপনার আশীর্বাদে ক্ষুদ্র ভারতকে আবার আমি  মহাভারত করে তুলতে পারব! যতদিন না আর্যাবর্ত জুড়ে স্বাধীন ভারত-সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারি, ততদিন পাটলিপুত্রে আর ফিরে আসব না—এই আমি প্রতিজ্ঞা করছি!’

আনন্দে বিগলিত স্বরে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘আশীর্বাদ করি পুত্র, তুমি সক্ষম হও—ভারত আবার ভারত হোক!’—বলতে বলতে তাঁর দুই চোখ মুদে এল, উপাধানের একপাশে তাঁর মাথাটি নেতিয়ে পড়ল। গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত ইহলোক থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন।

ঘরের ভিতরে পুরললনা ও রানিদের কণ্ঠে জাগল উচ্চ হাহাকার! কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই সেই শোকার্তনাদকে ডুবিয়ে বাইর থেকে ছুটে এল বিপুল জনকোলাহল এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রঝঞ্ঝনা। প্রধানমন্ত্রী দৌড়ে গবাক্ষের ধারে গিয়ে দেখে বললেন, ‘এ কি প্রজাবিদ্রোহ?’

অতি দ্রুতপদে বাইর থেকে একজন প্রাসাদ-প্রহরী ভয়বিহ্বল মুখে এসে খবর দিলে, ‘শত শত সৈন্য নিয়ে রাজপুত্র কচ প্রাসাদের ভিতরে ছুটে আসছেন।’

চন্দ্রপ্রকাশ সচকিত নেত্রে চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলেন, ইতিমধ্যে সকলের অগোচরে কচ কখন ঘরের ভিতর থেকে অদৃশ্য হয়েছেন।

পালঙ্কের উপর থেকে নেমে এসে কুমারদেবী বললেন, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, কচ আসছে তোমাকেই বন্দি বা বধ করতে। কিন্তু কচকে আমি চিনি, এর জন্যেও আমি প্রস্তুত ছিলুম। শীঘ্র তুমি রাজবাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। সেখানে আমার পিত্রালয়ের লিচ্ছবি সৈন্যরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাদের সঙ্গে গঙ্গা পার হয়ে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত হও।’

চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘তা হয় না মা। আমি কাপুরুষ নই, সিংহাসন পেয়ে প্রথমেই পলায়ন করা আমার শোভা পায় না।’

কুমারদেবী বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘আমি তোমার মা, আমার আদেশ পালন করো। মহারাজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে, তাঁর মৃতদেহের পাশে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি আমি সহ্য করব না। তার উপরে এইমাত্র মহারাজের পা ছুঁয়ে তুমি কী প্রতিজ্ঞা করেছ মনে রেখো। নির্বোধের মতো তুচ্ছ ঘরোয়া যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা হবে তোমার পক্ষে একই কথা। নিজের প্রাণকে রক্ষা করো উচ্চতর কর্তব্যপালনের জন্যে। যাও, যাও চন্দ্রপ্রকাশ। ওরা যে এসে পড়ল!’