» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

জীর্ণ-জরার নাট্যশালায় জাগ্রত হও রুদ্র!

ভারত ভরে অগ্নি কর বৃষ্টি!

“উড়ুক হাতে মৃত্যু-নিশান, মরুক যত ক্ষুদ্র,—

তবেই হবে নতুন প্রাণের সৃষ্টি।

পদ্মাবতী একখানি আসন গ্রহণ করে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, প্রভাত হচ্ছে জাগরণের কাল। স্বপ্নের কথা এখন ভুলে যাও।’

চন্দ্রপ্রকাশ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না পদ্মা, এখন প্রভাত এলেও বিশাল ভারত আর জাগে না। এমন গভীর তার ঘুম যে স্বপ্ন দেখবার শক্তিও তার নেই। এই ঘুমন্ত আর্যাবর্তে আজ স্বপ্ন দেখছে কেবল দুজন লোক।’

পদ্মাবতী হেসে বললে, ‘বুঝতে পারছি, দুজনের একজন হচ্ছ তুমি। আর একজন কে?’

‘আমাদের পিতৃদেব, মহারাজাধিরাজ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত।’

‘তিনিও স্বপ্ন দেখেন নাকি?’

চন্দ্রপ্রকাশ পরিপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘নিশ্চয়! নইলে মগধ সাম্রাজ্য আজ গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারত না। এই সাম্রাজ্য বিস্তার সম্ভব হয়েছে স্বপ্নাদেশের ফলেই।’

পদ্মাবতী কৌতূহলী স্বরে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, তোমাদের স্বপ্নের কথা শোনবার জন্যে আমার আগ্রহ হচ্ছে। কী স্বপ্ন তুমি দেখ?’

‘আমি সেই স্বপ্ন দেখি পদ্মা, মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত যা দেখেছিলেন।’

‘আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো।’

‘কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের পরে ভারতের ক্ষাত্রধর্ম বহু যুগ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আর সেই দুর্বলতার সুযোগে পঙ্গপালের মতো যবন সৈন্যের পর যবন সৈন্য এসে ছেয়ে ফেলেছিল আর্যাবর্তের বুক। চারিদিকে তুচ্ছ যত খণ্ডরাজ্য—তারা কেউ কারুকে মানে না, তাদের কেউ জানে না একতার মাহাত্ম্য! পরস্পরের কাছ থেকে দু-চারটে গ্রাম বা নগর কেড়ে নিয়েই তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করত। মাথার উপরে ঝুলত যখন যবন-দিগবিজয়ীর তরবারি, তখনও হত না তাদের চেতনা! নির্লজ্জের মতো যবনের আনুগত্য স্বীকার করে রাজারা যদি নিজেদের মুকুট বাঁচাতে পারতেন, তাহলেই হতেন পরম পরিতৃপ্ত। সাড়ে ছয়শো বৎসর আগে এই অধমদের মধ্যেই আবির্ভূত হয়েছিলেন মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত—চক্ষে ছিল তাঁর অখণ্ড মহাভারতের স্বপ্ন। নিজের জীবনেই তিনি সফল করেছিলেন তাঁর সেই অপূর্ব স্বপ্নকে! আমি তাঁকে ভীমার্জুনের চেয়ে মহাবীর বলে মনে করি।’

পদ্মাবতী বিস্মিত স্বরে বললে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ, তুমিও কি আবার সেই অসম্ভব স্বপ্ন দেখতে চাও?’

‘যা একবার সম্ভবপর হয়েছে, তাকে অসম্ভব বলছ কেন পদ্মা? মৌর্য চন্দ্রগুপ্তও এই মগধের সন্তান। আর সেই স্বপ্নকে আবার সত্যে পরিণত করতে চান বলেই হয়তো আমার পিতৃদেবও চন্দ্রগুপ্ত নাম ধারণ করেছেন।’

পদ্মাবতী বললে, ‘কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য কি আর পূর্ণ হবে? মহারাজা একে বৃদ্ধ হয়েছেন, তার উপরে কঠিন ব্যাধির আক্রমণে শয্যাগত। ভগবান বুদ্ধদেবের কৃপায় তিনি রোগমুক্ত হলেও এই বয়সে আর কি সারা ভারতের উপরে এক ছত্র তুলে ধরতে পারবেন?’

চন্দ্রপ্রকাশ দৃপ্তস্বরে বললেন, ‘পিতার পুনর্জন্ম হয় পুত্রের মধ্যেই। মহারাজ যে ব্রত গ্রহণ করেছেন, তা উদ্যাপন করব আমিই। ভারতের দিকে দিকে আজ দুর্বল হস্তে রাজদণ্ড ধারণ করে আছে শত শত নগণ্য রাজা। তাদের মন সংকীর্ণ, চোখ অন্ধ, চরণ গণ্ডির ভিতরে বন্দি। তাদের কেউ হচ্ছে শক, কেউ হচ্ছে যবন, কেউ হচ্ছে দ্রাবিড়ী। তাদের অবহেলায় ভারতের ক্ষত্রিয় ধর্ম, প্রাচীন সভ্যতা, সাহিত্য, শিল্প, দর্শন,  বিজ্ঞান একেবারে অধঃপাতে যেতে বসেছে। সম্রাট অশোকের যুগে আর্যাবর্তের নামে সারা পৃথিবীর মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে পড়ত, কিন্তু আজ ভারতকে কেউ চেনে না। আর্যাবর্তেই আর্য-আদর্শ নেই। দীর্ঘকাল অনার্য, শকদের কবলে পড়ে ভারতের অমর আত্মাও আজ মর মর, অচেতন। ভারতব্যাপী এই ক্ষুদ্রতার উপর দিয়ে আমি জ্বলন্ত উল্কার মতো ছুটে যেতে চাই, চারিদিকে আগুন ছড়াতে ছড়াতে! আমি নিষ্ঠুর হব, ভয়ানক হব, আগে করব ধ্বংস—কেবল ধ্বংস আর ধ্বংস আর ধ্বংস! তারপর সেই সমস্ত জড়তা, দীনতা, হীনতা আর ক্ষুদ্রতার রক্তাক্ত ধ্বংস্তূপের মধ্যে বসে আবার আমি গড়ে তুলব আমার স্বপ্নে দেখা সত্যিকার ভারতকে!’

হঠাৎ চলন্ত কাষ্ঠপাদুকার শব্দ উঠল। চন্দ্রপ্রকাশ ভাবের আবেগে প্রায় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করে নিজের মনের কথা বলে যাচ্ছিলেন, সে শব্দ তিনি শুনতে পেলেন না। কিন্তু পদ্মাবতী খড়মের আওয়াজ পেয়েই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘চুপ করো চন্দ্রপ্রকাশ, চুপ করো! বাবা আসছেন!’

পীতবস্ত্র ও উত্তরীয়ধারী বৌদ্ধশাস্ত্রজ্ঞ এবং বিখ্যাত গ্রন্থকার বসুবন্ধু ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মাথার চুল ও দাড়ি-গোঁফ কামানো, বয়স ষাটের কম নয়। মুখখানি প্রশান্ত—যদিও সেখানে এখন ফুটে উঠেছে বেদনার আভাস!

ঘরে ঢুকে বসুবন্ধু একবার চন্দ্রপ্রকাশের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকালেন। তারপর একটু নীরব থেকে বললেন, ‘বৎস, আসতে আসতে আমি তোমার কথা শুনতে পেয়েছি। আমার এই আশ্রমে বসে তুমি ধ্বংসের মন্ত্র উচ্চারণ করছ!’

চন্দ্রপ্রকাশ মুখ নামিয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ গুরুদেব! আমি ধ্বংস করতে চাই ভারতব্যাপী দীনতা আর জড়তাকে!’

মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বসুবন্ধু বললেন, ‘আমারও সেই কর্তব্য। জ্ঞানের আলো দেখিয়ে আমি হীনকে করে তুলতে চাই মহৎ। কিন্তু তুমি কীসের সাহায্যে দীনতা আর জড়তাকে ধ্বংস করবে?’

‘গুরুদেব, আমি রাজপুত্র। আমার অবলম্বন তরবারি।’

দুঃখিত স্বরে বসুবন্ধু বললেন, ‘আমি তোমাকে শাস্ত্রশিক্ষা দিয়েছি বৎস, অস্ত্রশিক্ষা দিইনি। আমার শাস্ত্র রচনা করেছেন ভগবান বুদ্ধদেব, সর্বজীবে অহিংসাই ছিল যার বাণী।’

‘আবার বলি গুরুদেব, আমি রাজপুত্র। রাজধর্ম হচ্ছে রাজ্যবিস্তার করা। তরবারি কোশবদ্ধ থাকলে রাজধর্ম পালন করা হয় না।’

‘বৎস, তুমি ভুল বলছ। সম্রাট অশোক কি রাজধর্ম পালন করেননি? তাঁর অধীনে কি বিরাট ভারত-সম্রাজ্য পৃথিবীতে অতুলনীয় হয়ে ওঠেনি? তিনি কি অস্ত্র ত্যাগ করে অহিংসার আশ্রয় নেননি?’

চন্দ্রপ্রকাশ বললেন, ‘কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোককে আর রাজ্যবিস্তার করতে হয়নি, সে কর্তব্য প্রায় শেষ করে গিয়েছিলেন তাঁর পিতামহ চন্দ্রগুপ্তই। কিন্তু সম্রাট অশোক তরবারি ত্যাগ করেছিলেন বলেই তাঁর মৃত্যুর পরেই হয়েছিল মৌর্যসাম্রাজ্যের পতন।’

বসুবন্ধু বললেন, ‘আমার কাছে সাম্রাজ্যের পতন খুব বড় কথা নয় রাজকুমার! আমি চাই কেবল আত্মাকে পতন থেকে রক্ষা করতে। রক্তসাগরে সাঁতার দেয় পশুর আত্মাই, সেখানে ঠাঁই নেই মনুষ্যত্বের! বৎস, তোমাকে এই শিক্ষাই আমি বার বার দিয়েছি, আমার শিক্ষা কি তবে ব্যর্থ হবে?’

চন্দ্রপ্রকাশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘গুরুদেব, সিংহের শিশু কি নিরামিষের ভক্ত হতে পারে? অস্ত্রহীন ক্ষত্রিয় সন্তান, একথা কি কোনওদিন কল্পনাতেও আসে? প্রেমের মন্ত্রে বিশ্বের হৃদয় জয় করা যায়, ভগবান বুদ্ধদেব যা করে গেছেন। কিন্তু ভারতব্যাপী হিংস্র পশুত্বকে দমন করতে পারে কেবল শক্তির মন্ত্র। কুরুক্ষেত্রে অর্জুন যদি অস্ত্রত্যাগ করতেন, তাহলে কে করত এখানে ধর্মরাজ্য স্থাপন? চন্দ্রগুপ্তের তরবারি যদি হিন্দুস্থানের সমস্ত দীনতাকে হত্যা না করত, তবে কী করে প্রতিষ্ঠিত হত অশোকের প্রেমধর্ম? গুরুদেব, গুরুদেব, আগে আমাকে আগাছা কেটে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে দিন, তারপর সেখানে ছড়াবেন আপনার প্রেমের বীজ।’

ঘরের বাইরে হঠাৎ দ্রুত পদশব্দ উঠল। তারপরেই দরজার কাছে এসে অভিবাদন করলে এক রাজভৃত্য। তার মুখেচোখে দারুণ দুর্ভাবনার চিহ্ন।

চন্দ্রপ্রকাশ উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে? তুমি এখানে কেন?’

‘মহারাজের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তাঁর অন্তিমকাল উপস্থিত। মহারাজা আপনাকে স্মরণ করেছেন!’

চন্দ্রপ্রকাশ তাড়াতাড়ি বসুবন্ধুর চরণে প্রণাম করে বললেন, ‘গুরুদেব, গুরুদেব। আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার! মগধের মঙ্গলের জন্যে ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করুন!’ তারপরে উঠেই ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেলেন।

বসুবন্ধু চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললেন, ‘পদ্মা, সত্যই আজ মগধের অতি দুর্দিন! মহারাজের যদি মৃত্যু হয়, তবে সিংহাসনে বসবে কে? চন্দ্রপ্রকাশ, না তার বৈমাত্রেয় ভাই কচ?’

পদ্মাবতী বললেন, ‘প্রজারা চন্দ্রপ্রকাশকেই যুবরাজ বলে জানে, আর মহারাজের উপরে চন্দ্রপ্রকাশের মা কুমারদেবীর প্রভাব কত বেশি, সে কথা তো আপনিও জানেন বাবা!’

বসুবন্ধু বললেন, ‘কিন্তু রাজকুমার কচ তো শান্ত মানুষ নন, নিজের দাবি তিনি ছাড়বেন বলে মনে হয় না! পদ্মা, মগধ রাজ্যে শীঘ্রই মহা অশান্তির সম্ভাবনা—ভ্রাতৃবিরোধ, ঘরোয়া যুদ্ধ, রক্তপাত!’