ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মন ছুটেছে সুদূর, সুদূর, সুদূর পারে—
সূর্যালোকে, চন্দ্রকরে, অন্ধকারে।
ইচ্ছা যে তার বিশ্ববাটে ঝোড়ো-হাওয়ার সঙ্গে হাঁটে
বন্দি দেহ উঠছে কেঁদে বন্ধ-দ্বারে!
পাটলিপুত্র? সমগ্র ভারতবর্ষে এ নামের তুলনা নেই এবং গৌরবে এই নগর দিল্লির চেয়েও বড়!
ঐতিহাসিক যুগে দিল্লির মর্যাদা বেড়েছে মুসলমান সম্রাটদের দৌলতেই। কিন্তু পাটলিপুত্রের কীর্তিস্তম্ভ রচনা করেছেন ভারতের হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্রাটরাই।
গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে যখন পাটলিপুত্রকে দেখেন, তখন তার মতো বৃহৎ নগর আর্যাবর্তে আর দ্বিতীয় ছিল না।
গ্রিক বর্ণনা থেকে পাটলিপুত্র সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জানা যায়। গঙ্গানদী যেখানে শোন নদের সঙ্গে এসে মিলেছে, পাটলিপুত্রের অবস্থান সেইখানেই। আজ পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আছে পাটনা শহর।
সেকালে যেসব নগর থাকত সমুদ্র বা নদীর তীরে, সাধারণত তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করবার সময়ে ইটের বদলে কাঠের ব্যবহারই হত বেশি। কাঠ দীর্ঘকাল স্থায়ী নয়, তাই তখনকার স্থাপত্য শিল্পের কোনও নিদর্শন আজ আর দেখবার উপায় নেই।
প্রকাণ্ড পাটলিপুত্র নগর, তার ভিতরে বাস করে লক্ষ লক্ষ মানুষ। খ্রিস্ট জন্মাবার পাঁচশত বৎসর আগে তার প্রতিষ্ঠা হয়। দৈর্ঘ্যে সে ছিল নয় মাইল এবং প্রস্থে দেড় মাইল। চার চারদিক উঁচু ও পুরু কাঠের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বহিঃশত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্যে প্রাচীরগাত্রের সর্বত্রই ছিদ্র ছিল, ভিতর থেকে তিরনিক্ষেপের সুবিধা হবে বলে। প্রাচীরের মাঝে মাঝে ছিল বুরুজ, তাদের সংখ্যা ৬৭০। প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্যে নগরদ্বার ছিল ৬৪টি। প্রাচীরের পরেই যে পরিখাটি নগরকে বেষ্টন করে থাকত সেটি চওড়ায় ছয়শো ফুট এবং গভীরতায় তিরিশ হাত।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাটলিপুত্র তার কোলের উপরে দেখেছিল রাজবংশের পর রাজবংশের উত্থান ও পতন।
গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠার আগে ভারতবর্ষে এসেছিল যখন অন্ধকারযুগ, তখনও পাটলিপুত্র ছিল একটি বিখ্যাত ও বৃহৎ নগর এবং তখনও যিনি পালিপুত্রের সিংহাসন অধিকার করতে পারতেন, লোকচক্ষে তিনি হতেন পৃথিবীরই অধিকারী!
গুপ্তযুগে চিন পরিব্রাজক ফা হিয়েন স্বচক্ষে পাটলিপুত্রকে দেখে যে উজ্জ্বল বর্ণনা করে গেছেন তা পড়লেই বোঝা যায়, মৌর্যবংশের পতনের পরেও সে ছিল গৌরবের উচ্চচূড়ায়।
চতুর্থ খ্রিস্টাব্দেও রাজধানী পাটলিপুত্রের বুকে দাঁড়িয়ে মৌর্য সম্রাট অশোকের প্রস্তরনির্মিত অপূর্ব প্রাসাদ করত পথিকের বিস্মিত দৃষ্টিতে আকর্ষণ! সাধারণের বিশ্বাস ছিল, এ প্রাসাদ মানুষের গড়া নয়!
কেবল কাঠের বাড়ি নয়, পাটলিপুত্র তখন বহু ইটপাথরের বাড়ির জন্যেও গর্ব করতে পারত, কারণ ভারতের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প তখন যথেষ্ট উন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছে।
পথে পথে ছুটছে আরোহীদের নিয়ে উট, অশ্ব, ও রথ! মাঝে মাঝে দেখা যায় রাজহস্তীর শ্রেণি!
রাজপথের এক জায়গায় রয়েছে প্রকাণ্ড একটি হাসপাতাল! তার দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে একজন ঘোষণা করছে :
‘গরিব, অসহায়, পঙ্গু রোগীরা এখানে আগমন করুক। এখানে তাদের যত্ন ও পরিচর্যা করা, চিকিৎসককে দেখানো আর ঔষধ-পথ্য দেওয়া হবে। তারা সম্পূর্ণ আরামে বাস করতে পারবে, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত!’
বলা বাহুল্য, সারা পৃথিবীর কোনও দেশেই তখন এমন হাসপাতাল ছিল না।
পৃথিবীতে প্রথম সরকারি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন বৌদ্ধ সম্রাট অশোক। পাটলিপুত্রের রাজা এখন হিন্দু হলে কি হয়, অশোকের মানবতার প্রভাব তাঁকেও অভিভূত করে। কেবল হাসপাতাল নয়, নগরের নানাস্থানে আরও অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে এবং রাজধানীতে যে বৌদ্ধ প্রভাবও সামান্য নয়, এর প্রমাণ পাওয়া যায় বড় বড় বৌদ্ধ মঠগুলিকে দেখলে। কোনও মঠে থাকেন মহাযান এবং কোনও মঠে হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধসন্ন্যাসীরা। সেইসব মঠে বাস করে শত শত শিক্ষার্থীও। সন্ন্যাসীদের পাণ্ডিত্য ছিল এমন অসাধারণ যে ভারতের দূর-দূরান্ত থেকে—এমনকী ভারতের বাহির থেকেও ছাত্ররা আসত বিদ্যালাভ করতে। পাটলিপুত্রের এমনই একটি মঠে থেকে চিনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন সংস্কৃত শেখবার জন্যে পুরো তিনটি বৎসর কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
পাটলিপুত্রের প্রজারা পরম সুখে কালযাপন করত। ফা হিয়েনের বিবরণ পড়লে মনে হয়, পুরাকালের কল্পিত রামরাজত্বেও প্রজারা এর চেয়ে সুখে বাস করত না। গৃহস্থরা রাত্রে বাড়ির সদর দরজা খোলা রেখেও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে পারত—সভ্যতা-গর্বিত ইংরেজ রাজত্বেও আজ যা অসম্ভব। গুরুতর অপরাধের সংখ্যা ছিল এত কম যে প্রাণদণ্ডের কথা লোকে জানতই না। বারংবার ডাকাতি করলে বড় জোর অপরাধীর ডান হাত কেটে নেওয়া হত। কিন্তু এই চরম দণ্ড দেওয়ার দরকার হত না প্রায়ই। অধিকাংশ অপরাধেরই শাস্তি ছিল জরিমানা মাত্র!
নগরের মাঝখানে গুপ্ত রাজপ্রাসাদ। এটিও পাথরের তৈরি। তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের চরম উন্নতির যুগে ভারতের যে নিজস্ব শিল্পরীতি অপূর্বতা সৃষ্টি করেছিল পূর্ণ মহিমায়, মহারাজাধিরাজ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন লাভের আগেই তার প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। এইটেই স্বাভাবিক। ফুল আগে কুঁড়ির আকারে দেখা না দিয়ে একেবারে ফোটে না। মৌর্য সম্রাট অশোকের যুগেও ভারত-শিল্পের নিজস্ব রীতি আত্মপ্রকাশ করেনি এবং মৌর্য রাজপ্রাসাদ ও ভাস্কর্যের উপরে পারসি প্রভাব ছিল অল্পবিস্তর। তারপর উত্তর ভারতের শিল্পের উপরে পড়ে গ্রিক প্রভাব,—তার প্রমাণ গান্ধার-ভাস্কর্য। কিন্তু তারপর থেকেই ভারত-শিল্পীর দৃষ্টি ফিরে আসতে শুরু করে ঘরের দিকে। সেই দৃষ্টি পরিবর্তনের সুফল দেখি অজন্তা, ইলোরা, সাঁচী, সারনাথ, ভরহুত, অমরাবতী ও শিগির প্রভৃতি স্থানে।
রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে একটি তপোবনের মতো মনোরম জায়গা। সেখানে নানা জাতের শত শত তরুলতা করেছে স্নিগ্ধ শ্যামলতা সৃষ্টি, সেখানে ঘাসের নরম গালিচার উপরে খেলা করছে আলো আর ছায়া, সেখানে উপরে বসে গান গায় স্বাধীন বনের পাখি, নীচে নেচে নেচে বেড়িয়ে বেড়ায় ময়ূর ও হরিণের দল, সরোবরে জললীলায় মাতে মরাল-মরালীরা। সরোবরের ধারে একখানি কাঠের বাড়ি, তার সর্বত্র শিল্পীর হাতের কারুকার্য। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, সেসব কারুকার্য দেখতে কেমন? তাহলে তাঁকে বলব, আজও ভারতে যেসব প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন বিদ্যমান আছে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে। কারণ সেসব স্থাপত্য পাথরে গড়া হলেও তাদের শিল্পীরা অনুকরণ করেছে পূর্ববর্তী যুগের কাঠের শিল্পকেই।
সরোবরের জলে মিষ্টি হাওয়ায় আবেশে কেঁপে কেঁপে উঠেছে ফোটা-অফোটা কমলেরা এবং তাদের উপরে ঝরে পড়ছে নরম রোদের সোনালি স্নেহ। ঘাটের সিঁড়ির উপরে বসে একটি তরুণী আনমনে দেখছিল, পদ্মফোটার খবর পেয়ে কোথা থেকে উড়ে আসছে মধুলোভী ভ্রমররা।
এমন সময়ে বাড়ির ভিতরে কার হাতে জেগে উঠল এক মধুর বীণা!
তরুণী হাসিমুখে কান পেতে শুনলে যে এই সুন্দর প্রভাতে আনন্দময়ী ভৈরবী রাগিণীর মধ্যেও যেন কেঁদে কেঁদে উঠছে বীণকারের মন। হাসতে হাসতে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বাড়ির ভিতরে গেল।
বাগানের ধারে একখানি ঘরে উচ্চ কাষ্ঠাসনে বসে একটি যুবক আপনমনে বীণার তারে তারে করে যাচ্ছে অঙ্গুলিচালনা।
যুবকের বর্ণ শ্যাম, মাথায় কুঞ্চিত কেশদাম, উন্নত কপাল, ডাগর চোখ, টিকেলো নাক, ওষ্ঠাধরের উপরে নতুন গোঁফের রেখা। তার কানে দুলছে হীরকখচিত সুবর্ণকুণ্ডল, গলায় দুলছে রত্নহার, পরনে দামি রেশমি সাজ। তার সুদীর্ঘ দেহের ভিতর থেকে বলিষ্ঠ যৌবনের উদ্দাম শক্তি যেন মাংসপেশীগুলোকে ঠেলে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার দিকে তাকালেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে সে হচ্ছে অসাধারণ যুবক, তার সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন মানুষ দুর্লভ।
যুবক দুই চোখ মুদে এমন একমনে বীণা বাজাচ্ছিল যে জানতেও পারলে না, তরুণী ঘরে ঢুকে একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
তরুণী হাসিমুখে ডাকলে, ‘চন্দ্রপ্রকাশ!’
যুবক চমকে উঠে চোখ খুলে তরুণীর দিকে তাকালে,—কিন্তু সে দৃষ্টি দেখলে মনে হয়, তার স্বপ্নমাখা চোখ যেন তরুণীকে ছাড়িয়ে, ঘরের দেওয়াল ভেদ করে চলে গিয়েছে দূরে, বহুদূরে!
‘চন্দ্রপ্রকাশ!’
‘পদ্মাবতী!’ একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে যুবক বীণার তার থেকে হাত তুললে।
‘চন্দ্রপ্রকাশ, তুমি আমার বাবার যোগ্য ছাত্রই বটে! ভোরবেলার শাস্ত্র অধ্যয়নের সময়ে বীণা বাজিয়ে কান্না শুরু করেছ!’
‘তাহলে আমার কান্না তুমি শুনতে পেয়েছ?’
‘কান্না তো তোমার নিত্যই শুনি, দিনে দিনে তুমি যেন হাসিকে ভুলে যেতে বসেছ!’
‘না পদ্মা, এ আমার মনের কান্না নয়, এ হচ্ছে আমার দেহের কান্না!’
‘দেহের কান্না?’
‘হ্যাঁ, বন্দি দেহের কান্না। আমার যৌবনের কান্না!’
‘যৌবন তো হাসে চন্দ্রপ্রকাশ, যৌবন তো কাঁদে না?’
‘হাসতে পারে কেবল স্বাধীন যৌবন। দেহের সঙ্গে আমার যৌবনও অলস হয়ে গণ্ডির ভিতরে বন্দি হয়ে আছে। এ গণ্ডি আমি ভাঙতে চাই, কিন্তু পারছি না।’
‘তাই এমন সুন্দর প্রভাতটিতে তোমার কান্নার সুরে ভরিয়ে তুলতে চাও?’
‘তাছাড়া আর কী করতে পারি পদ্মা? মহারাজ চান, আমি তোমার পিতার শিষ্য হই। তোমার পিতা চান শাস্ত্রালোচনা করে আমি ধার্মিক হই। কিন্তু আমি চাই বিশ্বের রাজপথে মহাপ্রস্থান করতে।’
‘মহাপ্রস্থান করতে? তুমি আর ফিরতে চাও না?’
‘ঠিক তা নয় পদ্মা ফিরতে পারি, সফল যদি হই—স্বপ্ন যদি সত্য হয়।’
‘যুবরাজ—’
‘আবার তুমি আমার নাম না ধরে আমাকে যুবরাজ বলে ডাকছ? কে যুবরাজ? জানো আমার বৈমাত্রেয় ভাই কচ আছেন?’
‘কিন্তু প্রজারা তাঁকে চায় না।’
‘থাক, ওসব কথা নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। তার চেয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপটি করে ওইখানে গিয়ে বসো। আমার স্বপ্নকাহিনি শোনো। বিচিত্র এই স্বপ্ন—এর মধ্যে আছে মহাভারতের কণ্ঠস্বর!’
এই চন্দ্রপ্রকাশ কে? মগধের রাজপুত্র। পাটলিপুত্র এঁকে আরও দুই নামে জানে—বালাদিত্য, পরাদিত্য।
পদ্মাবতী হচ্ছেন বৌদ্ধ শাস্ত্রকার ও চন্দ্রপ্রকাশের শিক্ষাগুরু বসুবন্ধুর পালিতা কন্যা, রাজপুত্রের বান্ধবী।