ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
হিন্দু ভারত ঐক্য-বাঁধনে যুক্ত,
জয় মহারাজ! জয় সমুদ্রগুপ্ত!
তিন বছরে ভারতের তিন হাজার মাইলব্যাপী ভূভাগের উপরে নিজের জয়পতাকা উড়িয়ে দিগবিজয়ী সমুদ্রগুপ্ত আবার ফিরে এলেন মগধরাজ্য। তাঁর আগে আর কোনও ভারতীয় বীর এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেননি।
এ যুগের কাছে সমুদ্রগুপ্তের এই দিগ্বিজয় কাহিনি হয়তো খুব অসাধারণ বলে মনে হবে না। আধুনিক যুদ্ধনায়করা সুনির্মিত রাস্তা, রেলপথ, মটরযান, বাষ্পীয় পোত ও উড়োজাহাজ প্রভৃতির প্রাসাদে তিন হাজার মাইলকে হয়তো বেশি গ্রাহ্য করবেন না। কিন্তু সেকালে এ সবের কিছুই ছিল না। নিরন্ধ্র অরণ্য, উত্তুঙ্গ পর্বত, প্রশস্ত নদ-নদী পার হয়ে বিপুল বাহিনী নিয়ে পদে পদে বিদেশি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর প্রান্তে ছোটাছুটি করা তখনকার দিনে যে কী অসম্ভব ব্যাপার ছিল, আজকের দিনে আমরা তা ধারণাও করতে পারব না।
সমুদ্রগুপ্ত বাধা পেয়েছেন বহুবার, কিন্তু কোথাও তিনি পরাজিত হয়েছেন বা পলায়ন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর কোনও দিগ্বিজয়ীর সম্বন্ধেই বোধ হয় একথা বলা যায় না (আগেই বলেছি, আলেকজান্ডারকেও নন্দ রাজার ভয়ে ভারতজয় কার্য অসমাপ্ত রেখে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করতে হয়েছিল)। এবং এটাই হচ্ছে সমুদ্রগুপ্তের অতুলনীয় যুদ্ধ-প্রতিভার প্রধান প্রমাণ।
তাঁকে যে অসংখ্য যুদ্ধ জয় করতে হয়েছিল, এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব যুদ্ধের কোনও ইতিহাসই আর পাওয়ার উপায় নেই। তবে এলাহাবাদের অশোক-স্তম্ভের উপরে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে কবি হরি সেন (ষেণ?) বহু পরাজিত রাজার নাম করেছেন, আমরাও এখানে তাঁদের উল্লেখ করতে পারি।
আর্যাবর্তের বা উত্তর ভারতের অহিছত্রের অধিপতি অচ্যুত (মহাভারতে উক্ত দ্রুপদ রাজা এই অহিছত্রে রাজত্ব করতেন, সম্প্রতি এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে), মথুরার রাজা নাগ সেন, পদ্মাবতীর (সিন্ধিয়া রাজ্যের আধুনিক নারওয়ার শহরের কাছে) রাজা গণপতি নাগ এবং রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, নন্দী, বলবর্মা ও চন্দ্রবর্মা প্রভৃতি)।
কথিত আছে, রাজা প্রবর সেনের পক্ষ অবলম্বন করে মথুরা। পদ্মাবতী ও অহিছত্রের রাজারা এলাহাবাদের কাছে একসঙ্গে সমুদ্রগুপ্তকে আক্রমণ করে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। এতগুলি রাজার বিরুদ্ধে একাকী দাঁড়িয়ে সমুদ্রগুপ্ত জয়মাল্য অর্জন করেছিলেন, এও তাঁর সাহস ও যুদ্ধ-প্রতিভার আর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।
উপরে সর্বশেষে যে চন্দ্রবর্মার নাম করা হয়েছে, তাঁর সম্বন্ধেও কিছু বক্তব্য আছে। তিনি উত্তর ভারতের এক অতি পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। রাজপুতানার মরুপ্রদেশে পুষ্করণা নামক স্থানে তিনি রাজত্ব করতেন। দিল্লির লৌহ স্তম্ভে উৎকীর্ণ শিলালিপি পড়ে জানা গিয়েছে, সমুদ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের কিছু আগেই তিনি বাংলা থেকে বাল্হিক দেশ পর্যন্ত—অর্থাৎ সমস্ত আর্যাবত নিজের দখলে এনেছিলেন। কিন্তু এত বড় শক্তিশালী রাজাকেও সমুদ্রগুপ্তের সামনে পরাজয় স্বীকার ও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।
উত্তরাপথ দখল করবার পর সমুদ্রগুপ্ত অগ্রসর হলেন দক্ষিণাপথে। এদিকে সমুদ্রগুপ্তের কাছে যাঁরা হেরে গিয়েছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নাম : ১। দক্ষিণ কোশলের রাজা মহেন্দ্র, ২। মহাকান্তারের অধিপতি ব্যাঘ্ররাজ, ৩। কৌরলদেশের রাজা মন্টরাজ, ৪। কোট্টুর ও পিষ্টপুরের (আধুনিক পিট্টপুরম) রাজা স্বামীদত্ত, ৫। এরন্ডপল্লের রাজা দমন, ৬। কাঞ্চীর রাজা বিষ্ণু গোপ, ৭। অবমুক্তের রাজা নীলরাজ, ৮। বেঙ্গীনগরের রাজা হস্তিবর্মা, ৯। পলক্কের (সম্ভবত নেলোর জেলায়) রাজা উগ্রসেন, ১০। দেবরাষ্ট্রের (আধুনিক মহারাষ্ট্রের) রাজা কুবের, ১১। কুস্থলপুরের (খন্দেশের) রাজা ধনঞ্জয় প্রভৃতি।
সমুদ্রগুপ্তের কাছে মাথা নত করে কর দিত এই সব জাতি বা রাজ্য : ১। সমতট (যা দক্ষিণ থেকে পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত), ২। ডবাক (বোধ হয় ঢাকার পূর্ব নাম), ৩ কামরূপ, ৪। নেপাল, ৫। কর্তৃপুর (আধুনিক কুমায়ুন ও গাড়োয়াল), ৬। আর্জুনায়ন, ৭। যৌধেয়, ৮। মদ্রক (পাঞ্জাব), ৯। আভীর, ১০। সনকানীক (মালব), ১১। কাক, ১২। খরপরিক।
তখনকার ভারতে যেসব রাজা সবচেয়ে বিখ্যাত ও পরাক্রমশালী ছিলেন, সমুদ্রগুপ্তের শিলালিপিতে নিশ্চয়ই কেবলমাত্র তাঁদেরই নাম স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া তাঁর দিগ্বিজয়ের নেশার মধ্যে যে আরও কত রাজার প্রাণ ও রাজ্য লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সে হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়।
শত শত রাজ্যের বিপুল ঐশ্বর্য ভারে ভারে এসে মগধের রাজভাণ্ডারকে করে তুললে যক্ষপতি কুবেরের রত্নভাণ্ডারের মতো। জনবলে, অর্থবলে ও অপূর্ব খ্যাতিতে মগধের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, ভারতবর্ষে এমন রাজ্য আর দ্বিতীয় রইল না। প্রিয়দর্শী সম্রাট অশোকের তিরোধানের পরে মহানগর পাটলিপুত্র কেবল পূর্বগৌরব থেকেই বঞ্চিত হয়নি, তার জীবনীশক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছিল ক্রমশ। সমুদ্রগুপ্তের শৌর্যবীর্য আবার তাকে করে তুললে নবযৌবনে বলীয়ান, বিচিত্র মহিমায় মহীয়ান।
ভারতের সীমান্তে ও আশেপাশের রাজ্যাধিকারীরা সমুদ্রগুপ্তের তরবারির সঙ্গে পরিচিত না হয়েও সসম্ভ্রমে উপলব্ধি করলেন যে বহুকাল পরে হিন্দুস্থানে আবার এমন এক বৃহৎ জ্যোতিষ্কের উদয় হয়েছে, যাকে আর মাথা নামিয়ে স্বীকার না করে উপায় নেই। এঁর সঙ্গে শত্রুতা করলে মৃত্যু অনিবার্য, মিত্রতা রাখতে পারা গর্ব ও সৌভাগ্যের বিষয়। গ্রিক, পারসি ও অন্যান্য জাতীয় বৈদেশিক দস্যুরা দুর্বলতার সুযোগ পেলেই ভারতকে লুণ্ঠন করবার জন্যে ছুটে আসত সাগ্রহে, তারা এখন আর আর্যাবর্তের দিকে ফিরে তাকাতেও ভরসা করল না। নিরাপদ হওয়ার জন্যে কাবুলের কুষাণ রাজা সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করলেন।
এই সময়ে (৩৬০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি) সুদূর সিংহল থেকে দুজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এলেন বুদ্ধগয়ায় তীর্থ করতে। সমুদ্রগুপ্তের উৎসাহে নবজাগ্রত হিন্দুত্বের প্রাথমিক উত্তেজনায় মগধের প্রজারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উচিত মতো আদর করেনি, সম্মান দেখায়নি। সন্ন্যাসীরা নানা অসুবিধা ভোগ করে দেশে ফিরে গিয়ে সিংহলের রাজা শ্রীমেঘবর্ণের কাছে সব কথা জানালেন। মেঘবর্ণ তখনই সমুদ্রগুপ্তের কাছে বহূমূল্য উপহার পাঠিয়ে সিংহলী বৌদ্ধদের জন্যে বুদ্ধগয়ায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন।
বলেছি, হিন্দু ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলাই ছিল সমুদ্রগুপ্তের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য এবং তিনি নিজেও ছিলেন বিষ্ণুর পূজক। কিন্তু তাঁরও কয়েক শতাব্দী আগে শেষ মৌর্য রাজাকে হত্যা করে সেনাপতি পুষ্যমিত্র যেমন মগধের সিংহাসনে হিন্দুত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার জন্যে অগুন্তি বৌদ্ধ মঠ-মন্দির ভেঙে হাজার হাজার বৌদ্ধকে তরবারির মুখে সমর্পণ করেছিলেন, সমুদ্রগুপ্ত তেমন হিংসুক হিন্দু ছিলেন না। তাঁর মন ছিল পরম উদার, তাই বৌদ্ধ না হয়েও বৌদ্ধ বসুবন্ধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হননি। সুতরাং তিনি সানন্দেই বুদ্ধগয়ায় নতুন মঠ প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে সিংহলপতির কাছে নিজের সম্মতি জানালেন। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে রোম ও চিন সাম্রাজ্যের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।
কিন্তু তিনি পিতার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভোলেননি। দিগবিজয়ের কর্তব্য সমাপ্ত, কিন্তু এখনও অশ্বমেধ যজ্ঞ করা হয়নি।
বহু শতাব্দী আগে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্যের জন্যে ভারত থেকে অশ্বমেধের প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ ওই দুই ধর্মে জীবহিংসা নিষিদ্ধ। তারপর পুষ্যমিত্রের রাজত্বকালে হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই আবার অশ্বমেধের বৈদিক অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু সেও পাঁচ শতাব্দীরও বেশি আগেকার কথা।
এরই মধ্যে কুষাণ সম্রাটদের যুগে বৌদ্ধধর্ম আবার মাথা তোলবার অবসর পায়। তারপর ভারতে আসে অন্ধকারযুগ এবং আর্যাবর্ত হয়ে যায় খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত। সে সময়ে হিন্দু রাজার অভাব ছিল না বটে—কিন্তু তাঁদের কারুর অশ্বমেধের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবার শক্তি ও সাহস ছিল না। কারণ যিনি মহাশক্তিমান সার্বভৌম সম্রাট নন, তাঁর পক্ষে অশ্বমেধ যজ্ঞের দুরাশা করা বামনের চাঁদ ধরবার দুশ্চেষ্টা করার মতো হাস্যকর।
অশ্বমেধ বিধি হচ্ছে এই : একটি বিশেষ লক্ষণযুক্ত ঘোড়াকে মন্ত্রপূত করে তার মাথায় জয়পত্র বেঁধে নানা দেশে বেড়াবার জন্যে ছেড়ে দেওয়া হত—তার সঙ্গে সঙ্গে থাকত বহু সশস্ত্র রক্ষক। রাজা বা তাঁর প্রতিনিধিও সঙ্গে যেতেন। ঘোড়া কোনও বিদেশি রাজার রাজ্যে ঢুকলে তাঁকে হয় যুদ্ধ করতে, নয় বশ মানতে হত। এক বৎসর ধরে ঘোড়ার সঙ্গে এই যাত্রা চলত। যে যে দেশের ভিতর দিয়ে ঘোড়া অগ্রসর হত তার প্রত্যেকটিরই রাজা যদি অধীনতা স্বীকার করতেন, তাহলে ঘোড়ার মালিক দিগ্বিজয়ী বীরের মতো বশীভূত রাজাদের সঙ্গে নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসতেন। কোনও স্থানে পরাজিত হলে লোকে তাঁকে উপহাস করত, সার্বভৌম সম্রাট বলে মানত না এবং তিনি যজ্ঞাধিকারীও হতে পারতেন না। সফল হয়ে ফিরে এলে পর চৈত্র পূর্ণিমায় খুব ঘটা করে যজ্ঞ আরম্ভ হত। ঘোড়াকে দেওয়া হত বলি। ঘোড়ার বুকের চর্বিতে হত যজ্ঞাগ্নির সংস্কার এবং তার দেহের মাংস পুড়িয়ে করা হত হোম। যজ্ঞ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠাতা উপবাস করে থাকতেন এবং রাত্রে তাঁকে সস্ত্রীক শয্যাহীন মাটির উপরে শুয়ে ঘুমোতে হত।
নির্বিঘ্নে অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করে সমুদ্রগুপ্ত প্রমাণিত করলেন যে তিনিই হচ্ছেন ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট, এখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন এমন আর কেউ নেই।
কথিত আছে, এই যজ্ঞ উপলক্ষ্যে ভারতব্যাপী গুপ্তসাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র নগরে মহোৎসবের সাড়া পড়ে গিয়েছিল এবং মহারানি দত্তাদেবীকে নিয়ে মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্ত যে যজ্ঞের প্রত্যেকটি নিয়ম পালন করেছিলেন, সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। ব্রাহ্মণরা দান পেয়েছিল কোটি কোটি মুদ্রা।
দক্ষিণা দেওয়ার জন্যে, সমুদ্রগুপ্ত নতুন রকমের স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করিয়েছিলেন। তার এক পিঠে আছে যজ্ঞযূপে বাঁধা বলির ঘোড়ার মূর্তি, অন্য পিঠে সমুদ্রগুপ্তের মহারানির মূর্তি। এই দুষ্প্রাপ্য মুদ্রার একটি নমুনা কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত আছে। সমুদ্রগুপ্তের হুকুমে গড়া তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়ার একটি পাথরের মূর্তিও হিমালয়ের তলায় বনের ভিতরে আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি আছে লক্ষ্ণৌ-এর জাদুঘরে।
কবি হরিসেন শিলাপটে সমুদ্রগুপ্তের যে সমুজ্জ্বল শব্দচিত্র এঁকে গেছেন তাতে দেখি যে তিনি একাধারে দিগবিজয়ী সম্রাট, গীতবাদ্যে প্রথম শ্রেণির শিল্পী এবং কাব্যরাজ্যেও শ্রেষ্ঠ কবির সমকক্ষ।
দিগবিজয়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পরও অধিকাংশ দিগবিজয়ীর রক্ত-নেশা পরিতৃপ্ত হয় না এবং অনেক দিগবিজয়ীই অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করেছেন রক্তাক্ত তরবারি হাতে করেই। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত এ-শ্রেণির যুদ্ধপাগল বীর ছিলেন না। যুদ্ধপর্ব যখন সমাপ্ত হল, তখন তিনি একাগ্র চিত্তে নানাদিকে নানা সুব্যবস্থা করে নিজের সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ়তর করে তোলবার চেষ্টায় নিযুক্ত হলেন। এত যত্নে প্রজাপালন করতে লাগলেন যে তাঁর রাজ্য হয়ে উঠল রামরাজ্যের মতো। তাঁর শক্তি ও বীরত্ব দেখে যারা মনে মনে তাঁকে মানত না তারাও ভয়ে হয়ে পড়েছিল বিষহারা নতফণা সর্পের মতো। কঠিন ও দৃঢ় হস্ত রাজদণ্ড ধারণ করে আছে দেখে দস্যু, চোর ও অসাধুদের দল গেল ভেঙে। এইসব কারণে প্রজাদের সুখের সীমা ছিল না—তারা যাপন করত শান্তিময় জীবন। সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই চৈনিক ভ্রমণকারী ফা হিয়েন গুপ্তসাম্রাজ্যে এসে দেখেছেন, এখানে গুরুতর অপরাধের সংখ্যা এত কম যে প্রাণদণ্ড দেওয়ার কথা লোকের মনেই পড়ত না এবং রাজ্যের কোথাও ছিল না দস্যুতার উপদ্রব।
কিন্তু কেবল রাজনীতি নিয়েই তিনি মেতে থাকতেন না। কেবল গীত-বাদ্য-কাব্যই তাঁর অবলম্বন ছিল না। হরিসেন বলেন, বিদ্বজ্জ্বন সমাজের মধ্যে থাকতে পারলে সমুদ্রগুপ্ত অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। শাস্ত্রালোচনার সুযোগ তিনি ছাড়তেন না।
সব দিক দিয়ে হিন্দুর লুপ্ত গৌরবকে পুনরুদ্ধার করবার জন্যে সমুদ্রগুপ্ত প্রাণপণ চেষ্টার ত্রুটি করেননি। গ্রিক ও পারসিদের প্রার্দুভাবের জন্যে ভারতের শিল্পে ও সাহিত্যে বিদেশি প্রভাব ক্রমেই বেড়ে উঠেছিল, সমুদ্রগুপ্ত দিলেন সেই প্রভাব লুপ্ত করে। কবি, নাট্যকার ও শিল্পীদের ঘুমন্ত দৃষ্টিকে জাগিয়ে তুলে তাদের সামনে দেশের দর্পণ ধরে তিনি বললেন—’একবার নিজেদের মুখের পানে তাকিয়ে দেখ। তোমরা হচ্ছ সুন্দরের বংশধর, নিজেরাও পরমসুন্দর!’ সমুদ্রগুপ্তেরই সাধনমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অন্ধকারযুগের অত্যাচারিত, জীবন্মৃত ভারত আবার শক্তিধর হয়ে জ্যোতির্মণ্ডলের মধ্যে দৃঢ়পদে দাঁড়িয়ে লাভ করল ধ্রুবদৃষ্টি—দেখতে পেল আপন আত্মার ঐশ্বর্য। পিতৃদত্ত শিক্ষার গুণে বিখ্যাত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা কাব্যে প্রসিদ্ধ বিক্রমাদিত্য মহাভারতের যে বিচিত্র মানস-প্রতিমা সম্পূর্ণ করে বিশ্বের বিস্মিত চোখের সামনে তুলে ধরেন, তার অপূর্ব কাঠামো গড়ে গিয়েছিলেন সমুদ্রগুপ্তই স্বহস্তে। সেই বহু বাহুধারিণী দেবীমূর্তির হাতে কেবল শত্রুঞ্জয় নানা প্রহরণই ছিল না, ছিল বেদ, উপনিষদ, নব নব পুরাণ—ছিল দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা—ছিল কাব্য, নাটক, কথাসাহিত্য—ছিল গীত-বাদ্য-নৃত্য ও অভিনয়ের প্রতীক—ছিল চিত্র-ভাস্কর্য-স্থাপত্য প্রভৃতি বিবিধ ললিতকলার নিদর্শন এবং সেই সঙ্গে পরিপূর্ণ ধনধান্যের পসরা। রামায়ণ-মহাভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগ কবিদের কল্পনা-কুহেলিকায় রহস্যময় বলে মনে হয়—তার ভিতর থেকে নিশ্চিতভাবে কিছুই আবিষ্কার করবার উপায় নেই। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের ধ্যানের মন্ত্র হিন্দু-ভারতের যে মহিমময় মূর্তিকে সাকার করল, ঐতিহাসিক কালের আগে ও পরে তার সঙ্গে তুলনীয় আর কিছুই দেখা যায় না। পুত্র বিক্রমাদিত্য ও পৌত্র কুমারগুপ্ত উত্তরসাধক হয়ে সমুদ্রগুপ্তেরই সাধনাকে অগ্রসর করে নিয়ে গিয়েছিলেন—তাঁরা ছিলেন সমুদ্রগুপ্তেরই প্রতিষ্ঠিত আদর্শের অনুসারী।
সমুদ্রগুপ্ত অক্ষরে অক্ষরে পিতৃসত্য পালন করলেন। দিগবিজয়ের দ্বারা খণ্ড খণ্ড ভারতকে সংযুক্ত করে স্থাপন করলেন এক অখণ্ড ও বিরাট সাম্রাজ্য এবং বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে সার্বভৌম সম্রাট হয়ে আর্যাবর্তে ফিরিয়ে আনলেন আবার হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি—প্রাচীন হিন্দুধর্ম হল আবার নবীন যুবকের মতো।
এই সকল সাধনার আশ্চর্য পরিকল্পনার মধ্যে কোথায় ডুবে যাবে আমাদের মতো ক্ষুদ্র গল্প-লিখিয়ের কাল্পনিক কাহিনির সূত্র—মহাসাগরে সাঁতারুর সৃষ্ট অস্থায়ী জলের মতো। এরপর গালগল্প চলে না। তাই সমুদ্রগুপ্তের নিপুণ হাতের বীণাবাদন শোনবার জন্যে তাঁর রানি দত্তাদেবী আর সখী পদ্মাবতীকে আর আমন্ত্রণ করতে পারলুম না।