» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

শিকেয় তুলে গল্পকথাগুলি,

ঘাঁটব এবার ইতিহাসের ঝুলি!

ব্যাঘ্ররাজকে পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত দিগবিজয় ব্রত সমাপ্ত করবার জন্যে আবার অন্য দিকে যাত্রা করলেন।

এই ফাঁকে আমরা দু-একটা কথা বলে নিই। বাজে নয়, কাজের কথা।

একশো বছর আগে সমুদ্রগুপ্তের নামও কেউ জানত না বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু তারপরে পণ্ডিতদের প্রাণপণ চেষ্টায় বহু শিলালিপি, প্রাচীন মুদ্রা ও অন্যান্য প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। আজ ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে তিনি হচ্ছেন প্রাচীন ভারতের নেপোলিয়ন এবং মাত্র তিন বৎসরের মধ্যে প্রায় সমগ্র ভারত (তিন হাজার মাইল) জয় করে তিনি প্রমাণিত করেছেন, তাঁর কীর্তিকাহিনি অনায়াসেই আলেকজান্ডারের দিগবিজয়ের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে!

এক হিসাবে আলেকজান্ডারের চেয়ে সমুদ্রগুপ্তকে শ্রেষ্ঠ প্রতিভার অধিকারী বলা চলে। প্রথমত, সমুদ্রগুপ্ত কেবল দিগ্বিজয়ী ছিলেন না, কাব্য ও সংগীতেও তিনি প্রথম শ্রেণির শিল্পী বলে বিখ্যাত। দ্বিতীয়ত, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই তার সাম্রাজ্যের পতন হয়। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত এমন দৃঢ় ভিত্তির উপরে সাম্রাজ্য স্থাপন করে গিয়েছিলেন যে তার পরমায়ু হয়েছিল প্রায় দুই শত বৎসর।

সমুদ্রগুপ্তের দ্বারা প্রচারিত তিনটি স্বর্ণমুদ্রার প্রতিলিপি আমরা দেখেছি। এই সচিত্র মুদ্রা তিনটি চমৎকার। এর লেখাগুলি বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় ব্রাহ্মী অক্ষরে। মুদ্রাগুলির ছবি থেকে চতুর্থ শতাব্দীর ভারতীয় সাজপোশাক ও আসবাবের কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায় এবং সমুদ্রগুপ্ত ও তাঁর পিতা-মাতার আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধেও অল্পবিস্তর আন্দাজ করা যেতে পারে। মুদ্রা তিনটির বর্ণনা দিলুম।

প্রথম মুদ্রা : শিল্পী সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসে বীণা বাজাচ্ছেন। সিংহাসন বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, এ সে রকম সিংহাসন নয়। একখানা সামনের দিকে লম্বাটে, কিছু বেশি উঁচু, বাহারি পায়াওয়ালা জলচৌকির উপরে চেয়ারের মতো পিঠ রাখবার জায়গা থাকলে দেখতে যে রকম হয় এই সিংহাসন হচ্ছে সেই রকম। এ সিংহাসনকে ভারতীয় কৌচ বলাও চলে। অবশ্য, সিংহাসনটি কী দিয়ে তৈরি সেটা বলা কঠিন। সোনা-রুপো বা অন্য কোনও ধাতুরও হতে পারে, কাঠের বা হাতির দাঁতেরও হতে পারে। ডান পায়ের উপর দিয়ে বাঁ-পা ঝুলিয়ে সমুদ্রগুপ্ত উপবিষ্ট, বাঁ-পায়ের তলায় পাদপীঠ। তাঁর পেশিবদ্ধ, চওড়া বুক। প্রভামণ্ডলের মাঝখানে খালি মাথা, কানে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে পড়া কুণ্ডল, গলায় হার। পরনে হাঁটুর উপরে খাটো কাপড়—সেকালের রাজারাজড়ারা যে রাজসভার বাইরে বেশি কাপড়-চোপড় পরতেন না, এটা হচ্ছে তারই প্রমাণ। তাঁর হাতের বীণাটি অলাবুহীন, ধনুকাকৃতি—অনেকটা প্রাচীন ইউরোপীয় বীণার মতো। নাকটি বেশ দেখা যায়। গঠন ছিপছিপে, কিন্তু বলিষ্ঠ। মুদ্রার চারিধারে মণ্ডলাকারে লেখা—’মহারাজাধিরাজ শ্রীসমুদ্রগুপ্তঃ’।

দ্বিতীয় মুদ্রা : যোদ্ধা, দিগবিজয়ী সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ, কানে কুণ্ডল, ঊর্ধ্বোত্থিত বাম হাতে ধনুক, ডান হাতে তরবারি কিংবা দণ্ড, পরনে পাজামা, পায়ে পাদুকা। অশ্বারোহীর বেশ। সমুদ্রগুপ্ত বৈষ্ণব ছিলেন, তাই তাঁর সামনে গরুড়ধ্বজার উপরে গরুড়ের মূর্তি। সমুদ্রগুপ্তের এ মূর্তির মুখেও বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর সুদীর্ঘ নাসিকাটি।

তৃতীয় মুদ্রা : সমুদ্রগুপ্ত এর উপরে দেখিয়েছেন তাঁর পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও মাতা কুমারদেবীকে। এটি নাকি তাঁদের বিবাহের স্মারক মুদ্রা। মা কুমারদেবী মহাসম্ভ্রান্ত ও প্রাচীন লিচ্ছবি রাজবংশের মেয়ে বলে সমুদ্রগুপ্ত যথেষ্ট গর্ব অনুভব করতেন। চন্দ্রগুপ্তের যোদ্ধার বেশ। কুমারদেবীর দেহের উপর-অংশ অনাবৃত। পণ্ডিতেরা বলেন, সেকালের রাজপরিবারেরও মেয়েরা খালি বা আদুল গায়ে থাকতেন (কিন্তু গুপ্ত-রাজত্বেই মহাকবি কালিদাসের উদয় হয়েছিল, তাঁর কাব্যে কি এর নজির আছে?)। চন্দ্রগুপ্ত ডান হাতে করে রানি কুমারদেবীর হাতে কী একটা গহনা পরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর বাঁ হাতে অর্ধচন্দ্র-পতাকা। তাঁর বাঁ পাশে উপর থেকে নীচে লেখা ‘চন্দ্রগুপ্ত’ এবং নারীমূর্তির ডান পাশে লেখা ‘শ্রীকুমারদেবী।’

সমুদ্রগুপ্ত প্রভৃতির চেহারা ও পোশাকের কথা বলা হল। কিন্তু কী রকম ফৌজ নিয়ে তিনি দিগবিজয়ে বেরিয়েছিলেন, এবারে সেটা দেখা দরকার। তবে এ বিভাগে আমাদের অল্পবিস্তর অনুমানের সাহায্য নিতে হবে, কারণ, সমুদ্রগুপ্ত নিজের দিগবিজয় কাহিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন বটে, কিন্তু নিজের বাহিনীর বর্ণনা দেননি।

তবে আমাদের অনুমান বিশেষ ভ্রান্ত হবে না। কারণ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভারতের যুদ্ধশাস্ত্র সেনাগঠনের যেসব নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, কয়েক শতাব্দীর মধ্যে তার আর কোনও অদল-বদল হয়নি বললেও চলে। রামায়ণে—বিশেষ করে মহাভারতে ফৌজ ও যুদ্ধরীতির যেসব বর্ণনা পড়ি, কবিকল্পনার অত্যুক্তি ত্যাগ করলে দেখি আলেকজান্ডারের ভারতীয় অভিযানের সময়েও সেসব বর্ণনার অনেকটাই হুবহু মিলে যায়। সমুদ্রগুপ্তেরও ঢের পরে, সপ্তম শতাব্দীর সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রাচীন রীতির কিছু কিছু ত্যাগ করেছিলেন। ভারতীয় ফৌজের প্রধান একটি অঙ্গ—অর্থাৎ রথারোহী সৈন্যদল তিনি গঠন করেননি। যদিও হর্ষবর্ধনের যুগে অন্যান্য যুদ্ধের সময়ে যে রথ ব্যবহৃত হত তার প্রমাণ আছে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় দেখি, একজন ভারতীয় সেনাপতি চার ঘোড়ায় টানা রথে চেপে এক দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন।

এ গেল সপ্তম শতাব্দীর কথা। এরও প্রায় একহাজার বছর আগেকার যবনিকা তুললে দেখা যাবে, গ্রিকদের বিরুদ্ধে রাজা পুরুর রথারোহী সৈন্যেরা যুদ্ধে চলেছে। প্রত্যেক রথে জোড়া চার ঘোড়া এবং প্রত্যেক রথের উপরে রয়েছে যে ছয়জন করে আরোহী, তাদের মধ্যে দুজন হচ্ছে ঢাল-বাহী, দুজন ধনুকধারী এবং দুজন সারথি। শত্রুদের ভিতরে গিয়ে পড়লে, হাতাহাতি যুদ্ধের সময়ে সারথিরাও ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে ধনুর্বাণ নিয়ে লড়াই করে।

এক হাজার বছরের ভিতরে যে দেশে একমাত্র হর্ষবর্ধন (তাও সপ্তম শতকে) ছাড়া আর কেউ ফৌজ গঠনে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করেননি, সে দেশে চতুর্থ শতকের যোদ্ধা সমুদ্রগুপ্তও যে ফৌজে প্রাচীন ধারাই বজায় রেখেছিলেন, এটা অনুমান করা কঠিন নয়। অন্তত হর্ষবর্ধনের আগে আর কেউ যে ভিন্নভাবে ভারতীয় ফৌজ গঠন করেছিলেন, এর কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।

আলেকজান্ডারের ভারতীয় অভিযান দেখে কিছু কিছু নতুন শিক্ষা পেয়ে মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর চন্দ্রগুপ্ত হয়তো স্বগঠিত ফৌজকে অল্পবিস্তর পরিবর্তিত করেছিলেন এবং তারপর থেকে খুব সম্ভব মৌর্য ফৌজই ছিল ভারতের আদর্শস্থানীয়। কিন্তু প্রথম ভারত সম্রাট মৌর্য চন্দ্রগুপ্তও চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ফৌজের প্রধান চার অঙ্গই বজায় রেখেছিলেন, যথা—অশ্বারোহী, পদাতিক, হস্তী ও রথ। এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত সেনাবিভাগের এই চতুরঙ্গ অবলম্বন করেই প্রত্যেক রাজা করতেন যুদ্ধযাত্রা।

ভারতের অতীত গৌরবের প্রতি সমুদ্রগুপ্তের ছিল অতিশয় অনুরাগ। আর্য সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান ও দর্শনকে পুনর্বার নবজীবনে পরিপুষ্ট করে তোলবার চেষ্টাই যে ছিল তার জীবনের সাধনা, এর ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব নেই। বুদ্ধদেবের জন্মের আগে ভারতের অবস্থা কী রকম ছিল তার কোনও ঐতিহাসিক ছবি নেই বটে, কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যের মধ্যে আর্য আদর্শ এবং সংস্কৃতি প্রভৃতির বড় অল্প পরিচয় পাওয়া যায় না। সমুদ্রগুপ্ত সেই আদর্শ, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন এবং ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন অধিকতর সমুজ্জ্বল রূপেই। বৌদ্ধধর্মের আসরে তিনি হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং হিন্দু শিল্প ও সাহিত্যকে করেছিলেন বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত। তাঁর যুগে পালি ও প্রাকৃতের বদলে দেবভাষা সংস্কৃতই হয়েছিল সাহিত্যের ভাষা। অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রথা লুপ্ত হয়েছিল বৌদ্ধদের অহিংস ধর্মের মহিমায়। সমুদ্রগুপ্ত আবার সেই প্রথার পুনঃপ্রচলন করেন। এমনকী তাঁর দিগবিজয় যাত্রার মধ্যেও দেখতে পাই রামায়ণ-মহাভারতে কথিত পৌরাণিক দিগবিজয়ীদের অনুসরণ। সুতরাং ফৌজ গঠনের সময়েও তিনি যে পুরাতন যুদ্ধশাস্ত্রের নিয়ম মেনেই কাজ করতেন এ বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহ হওয়ার আর একটা বড় কারণ এই যে ফৌজ গঠনে সমুদ্রগুপ্ত নতুন রীতি অবলম্বন করলে পরবর্তী যুগের যোদ্ধারাও পুরাতনকে ছেড়ে এই নতুন ও সফল রীতিই গ্রহণ করত। কিন্তু তা হয়নি। সপ্তম শতাব্দীতেও দেখি, ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রে ফৌজের প্রাচীন চতুরঙ্গের কোনও অঙ্গের হানি হয়নি।

মৌর্য যুগে ভারতীয় বাহিনী কী ভাবে গঠিত হত তা দেখলেই সকলে সমুদ্রগুপ্তের ফৌজ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করতে পারবেন।

সেকালে ভারতের বড় বড় রাজরাজড়াদের কারবার ছিল অগুন্তি সৈন্য নিয়ে। রাজা পুরু মোটে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে গ্রিকদের গতিরোধের চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি খুব বড় দরের রাজা ছিলেন না, গ্রিকদের সংস্পর্শে না এলে আজ তাঁর নাম পর্যন্ত কেউ জানত না। ভারতে তখনকার শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন মগধের মহারাজা নন্দ—যাঁর ভয়ে আলেকজান্ডারকে পর্যন্ত ভারতবিজয় অসমাপ্ত রেখে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে হয়েছিল! গ্রিক ঐতিহাসিক প্লিনি বলেন, নন্দের অধীনে ছিল আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার রথ (প্রত্যেক রথে থাকত সারথি ও দুজন করে যোদ্ধা—সুতরাং আট হাজার রথ মানে চব্বিশ হাজার লোক), ছয় হাজার হাতি (প্রত্যেক হাতির উপরে থাকত মাহুত ও তিনজন করে ধনুকধারী—সুতরাং ছয় হাজার হাতি মানে চব্বিশ হাজার লোক)! অতএব মান বাঁচিয়ে সরে পড়ে আলেকজান্ডার বুদ্ধিমানেরই কাজ করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মগধ জয় করে এই সৈন্যসংখ্যা আরও ঢের বাড়িয়ে তুলেছিলেন। তাঁর অধীনে ছিল ছয় লক্ষ পদাতিক সৈন্য, তিরিশ হাজার অশ্বারোহী, ছত্রিশ হাজার গজারোহী এবং চব্বিশ হাজার রথারোহী—মোট ছয় লক্ষ নব্বই হাজার নিয়মিত সৈন্য!

ভারতের অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থাৎ প্রাদেশিক রাজারাও বেশি লোক নিয়ে নাড়াচাড়া করতে না পারলে খুশি হতেন না। অনেক কালের কথা নয়, মধ্যযুগেও বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব (১৫০৯-২৯ খ্রিস্টাব্দ) সাত লক্ষ তিন হাজার পদাতিক, বত্রিশ হাজার ছয়শো অশ্বারোহী ও পাঁচশো একান্ন রণহস্তী নিয়ে এক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন!

সমুদ্রগুপ্ত বেরিয়েছিলেন প্রায় সমস্ত ভারত জয় করতে। সুতরাং তাঁর মতো দিগ্বিজয়ীর অধীনে কত লক্ষ সৈন্য ছিল, তা অনুমান করা কঠিন নয়।

এই বিরাট ফৌজের তত্বাবধান করা হত কী উপায়ে, মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের কার্যবিধি দেখলেই আমরা সেটা ধারণা করতে পারব।

চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বাহিনীকে ছয় বিভাগে বিভক্ত করেছিলেন। পরিচালনার জন্যে তিনি তিরিশজন প্রধান কর্মচারী রেখেছিলেন—প্রত্যেক বিভাগে পাঁচজন করে। বিভাগগুলি এই :

প্রথম : নৌ বিভাগ। দ্বিতীয় : রসদ বিভাগ। মাল চালান দেওয়ার, দামামাবাহক, সহিস, কারিকর ও ঘেষেড়া প্রভৃতিরও খোরাকের জন্যে ভালো ব্যবস্থা ছিল। তৃতীয় : পদাতিক বিভাগ। চতুর্থ : অশ্বারোহী বিভাগ। পঞ্চম : যুদ্ধরথ বিভাগ। ষষ্ঠ : রণহস্তী বিভাগ।

আগেই বলা হয়েছে, ভারতীয় ফৌজ চিরকালই পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ ও হস্তী—এই চার অঙ্গ নিয়ে গঠিত হত। চন্দ্রগুপ্তের প্রতিভা এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরও দুটি অঙ্গ জুড়ে দিয়েছিল—রসদ ও নৌ বিভাগ। হয়তো গ্রিকদের ফৌজ পর্যবেক্ষণ করে এই দুটি অঙ্গের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্তকেও সমগ্র ভারত জুড়ে সৈন্যচালনা করতে হয়েছিল। রসদের সুব্যবস্থা না থাকলে এটা অসম্ভব হত। যাত্রাপথে পড়ত তাঁর বহু সেতুহীন নদ-নদী। সুতরাং তাঁর নৌ বিভাগও না থাকলে চলত না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, চন্দ্রগুপ্তের দেখাদেখি তিনিও এই দুটি অঙ্গকে পুরাতন চতুরঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত যথেচ্ছভাবে বা ভাড়াটে সৈন্য জোগাড় করতেন না। তাঁর প্রত্যেক সৈন্য নিজস্ব, তাদের তিনি নিয়মিত মাহিনা দিতেন। ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, সাজপোশাক ও রসদ—সমস্তই দেওয়া হত রাজভাণ্ডার থেকেই। মধ্যযুগেও ভারতের ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশে এ প্রথা ছিল না। কারণ সৈনিকরা হত হয় ভাড়াটে, নয় নিজেদের ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, সাজপোশাক সংগ্রহ করত নিজেরাই। অনেক সময়েই তাদের রসদও দেওয়া হত না, তারা যাত্রাপথে যেসব গ্রাম-নগর পড়ত, লুঠ করে পেট ভরাবার ব্যবস্থা করত। সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত তিরিশবৎসরব্যাপী ইউরোপীয় যুদ্ধের সময়ে ওদেশে লোকে বলত—’যার তরবারি নেই, জামাকাপড় বেচে সে তরবারি কিনুক, তা হলেই সেপাই হতে পারবে!’ ওই সময়েই দেখা গিয়েছিল, ব্যাভেরিয়ার ফৌজে লোক আছে এক লক্ষ আশি হাজার, কিন্তু রাজভাণ্ডার রসদ জোগায় মাত্র চল্লিশ হাজার লোকের জন্যে। বাকি এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক খাবার জোগাড় করত যথেচ্ছভাবে—অর্থাৎ চুরি, রাহাজানি, লুঠপাট প্রভৃতির দ্বারা!

চাণক্যের মত ছিল, ফৌজের পক্ষে সবচেয়ে দরকারি হচ্ছে, রণহস্তীরা। কারণ শত্রুসৈন্য ধ্বংস হয় তাদের দ্বারাই।

প্রত্যেক অশ্বারোহীর কাছে থাকত একখানা করে ঢাল ও দুটি করে বল্লম। পদাতিকের প্রধান অস্ত্র ছিল চওড়া ফলকওয়ালা তরবারি এবং অতিরিক্ত অস্ত্ররূপে তারা সঙ্গে নিত শূল বা ধনুকবাণ। আমরা এখন যেভাবে বাণ ছুড়ি, তারা সেভাবে ছুড়ত না। গ্রিক ঐতিহাসিক এরিয়ান বলেন, ‘ভারতীয় সৈনিকরা ধনুকের এক প্রান্ত মাটির উপরে রেখে, বাঁ-পায়ের চাপ দিয়ে এমন ভয়ানক জোরে বাণ ত্যাগ করত যে, শত্রুদের ঢাল ও লৌহবর্ম পর্যন্ত কোনও কাজে লাগত না!’ বোঝা যাচ্ছে, সেকালের ধনুক হত আকারে রীতিমতো বৃহৎ!

এতক্ষণে প্রাচীন ভারতীয় ফৌজ সম্বন্ধে পাঠকরা নিশ্চয় অল্পবিস্তর ধারণা করতে পেরেছেন। সমুদ্রগুপ্ত এই ধরনের বাহিনী নিয়েই চতুর্থ শতাব্দীর ভারতবর্ষের দিকে দিকে উড়িয়েছিলেন তাঁর রক্তাক্ত বিজয়পতাকা! তিনি বৈষ্ণব ছিলেন বটে, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিমন্ত্রের দ্বারা করতেন বিষ্ণু উপাসনা! একালের গোঁড়া বৈষ্ণবেরা নিরামিষ খায় জীবহত্যার ভয়ে। এ হচ্ছে কেবল তাদের ভীরুতা, শক্তিহীনতা ও কাপুরুষতা লুকোবার বাজে ওজর! কারণ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর প্রধান উপাস্য যিনি সেই বিষ্ণু কেবল হাতে পদ্ম নিয়ে কমলবিলাসীরূপে পরিচিত নন, অধর্মের কবল থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে রক্তপাতেও তাঁর যে কিছুমাত্র আপত্তি নেই, ভয়াবহ গদা ও শাণিত সুদর্শন চক্র ধারণ করে সেই সত্যই তিনি প্রকাশ করতে চান।