» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

আঁধার পথেও এগিয়ে গেল

পথ হারাল যারা,

সামনে হঠাৎ জাগল কখন

উজল ধ্রুবতারা।

কোথায় আকাশ, কোথায় বাতাস! সে যেন অন্ধকারের অনন্ত সাম্রাজ্য! উপরে, নীচে, এপাশে, ওপাশে অন্ধকারের পরে যেন অন্ধকারের তরঙ্গ! সে যেন বিরাট এক ক্ষুধার্ত বিভীষিকা, পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে!

লক্ষ্মী প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘দেবী, চোখ আর পা কিছুই যে চলছে না! নীচে পথ নেই, মাথার ওপরে ঘন পাতার ভেতরে একটা ফুটো, আলোর একটা রেখা পর্যন্ত নেই!’

দত্তা বললেন, ‘তবু আমাদের এগুতে হবে! চলো লক্ষ্মী, দু-হাতে বনজঙ্গল ঠেলে আরও ভেতরে গিয়ে লুকোই চলে! এ অন্ধকারকে এখন আমার বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। এখানে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না!’

‘না দেবী, না! আমার মনে হচ্ছে, এখানে শত শত অজানা শত্রু অদৃশ্য চক্ষু মেলে আমাদের পানে তাকিয়ে আছে! তাদের হাত ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই—কোনও উপায় নেই!’ লক্ষ্মীর গলার আওয়াজ শুনে বোধ হয়, এইবারে তিনি কেঁদে ফেলবেন।

দত্তা লক্ষ্মীর পিঠের উপর একখানি হাত রেখে ধীরে ধীরে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না লক্ষ্মী, তাহলে আমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। এই ভয়ানক গহন বনে আমাদের কপালে যদি মৃত্যু লেখা থাকে, তাহলেও এই সান্ত্বনা নিয়ে মরতে পারব যে ব্যাঘ্ররাজকে ফাঁকি দিয়েছি!’

ফোঁস করে একটা বিশ্রী গর্জন জেগে উঠল—লক্ষ্মীর পায়ের উপর দিয়ে তীব্র গতিতে চলে গেল যেন একটা শীতল ও ভয়াবহ শব্দ-বিদ্যুৎ! এবারে লক্ষ্মী ভয়ার্ত চিৎকার না করে থাকতে পারলেন না।

‘চুপ চুপ! হল কী লক্ষ্মী?’

‘পায়ের ওপর দিয়ে একটা সাপ চলে গেল! দেবী, আর আমি এগুতে পারব না, কপালে যা আছে তাই হবে!’

‘তাহলে তুমি এইখানে থাকো, আমি একলাই অগ্রসর হব।’

‘কোথায় অগ্রসর হবেন? সামনের দিকে চেয়ে দেখুন! মাগো!’

দশ-বারো হাত তফাতে অন্ধকার হয়ে উঠেছে যেন অগ্নিময়! চারটে বড় বড় বুভুক্ষু চক্ষু দপ দপ করে জ্বলছে! ও কাদের চোখ? বাঘ, না বাঘিনী? ভালুক? বরাহ? কিছুই বোঝা যায় না!

দুই হাতে মুখ ঢেকে প্রাণের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন লক্ষ্মী।

দীপ্ত চোখগুলো নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ হল! জন্তু দুটো চলে যাচ্ছে।

দত্তা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভয় নেই লক্ষ্মী! মৃত্যু আপাতত আমাদের গ্রহণ করলে না।’

পরমুহূর্তেই অন্ধকার যেন আচম্বিতে ভাষা পেয়ে বললে, ‘কে? কে এখানে কথা কইছে?’

দত্তা অন্ধের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটলেন—পিছনে পিছনে লক্ষ্মীও।

কখনও বড় বড় গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে, কখনও কাঁটাঝোপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, কখনও মাটির উপরে পড়েই আবার উঠে তাঁরা ছুটতে লাগলেন এবং প্রতিমুহূর্তেই তাঁদের মনে হতে লাগল এই মুহূর্তেই জীবনের শেষ মুহূর্ত। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন তাঁদের পিছনেও উঠেছে একাধিক পায়ের দ্রুত পদশব্দ! যারা পালাচ্ছে আর যারা অনুসরণ করছে তারা কেউ কারুকে দেখতে পাচ্ছে না—কেবল পদশব্দের পিছু নিয়েছে শব্দ।

ছুটতে ছুটতে দত্তা লক্ষ করলেন, অরণ্য আর তত দুর্ভেদ্য নয়, অন্ধকার আর তত গাঢ় নয়, মাথার উপরে মাঝে মাঝে আলোর আভাস, মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে সমুজ্জ্বল আকাশের এক-একটা টুকরো। দারুণ ভয়ে তাঁর সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অন্ধকারের যে নিবিড়তা এতক্ষণ তাঁদের রক্ষা করছিল, এইবারে তার সাহায্য বুঝি হারাতে হয়!

পিছন থেকে বিকট চিৎকার জাগল, ‘পেয়েছি মন্ত্রী, আমার বউকে পেয়েছি!’

ব্যাঘ্ররাজ ও মন্ত্রী তখন দত্তাদের খুব কাছে এসে পড়েছে।

অন্ধকারের রাজ্য শেষ হল—একখণ্ড খোলা জমির উপরে বিরাজ করছে দিনের আলো।

আর পালাবার চেষ্টা করা মিছে বুঝে দত্তা ও লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে পড়লেন।

ব্যাঘ্ররাজও দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘বাব্বা, তুমি বউ, না উড়োপাখি? একেবারে বেদম হয়ে গিয়েছি যে!’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, এখানে অপেক্ষা করা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? বনের গুপ্তপথ দিয়ে শত্রু আসছে সে কথা কি ভুলে গেলেন?’

‘হেঁঃ! সে কথাও ভুলিনি, আমার বউকেও ভুলব না! হারাধন যখন ফিরে পেয়েছি তখন তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব।’

‘মহারাজ, শাস্তরে বলে, পথে নারী বিবর্জিতা।’

‘মরছি হাঁপিয়ে, এখন আবার শাস্তর-ফাস্তর নিয়ে গোলমাল কোরো না বাপু।’

‘আমার কথা শুনুন মহারাজ! ওই দত্তাদেবীর জন্যেই আজ আপনার এত বিপদ! আমি বলি কি, ও-আপদকে আপনি বনবাস দিয়ে যান!’

‘মন্ত্রী, গদাটা আমি ভুলে ফেলে এসেছি বলেই তুমি এত মুখ নাড়ছ বুঝি? কিন্তু জানো তো, আমার হাত গদার চেয়ে কম শক্ত নয়!’ ব্যাঘ্ররাজ ভারী ভারী পা ফেলে দত্তার দিকে এগিয়ে গেল।

দত্তা পায়ে পায়ে পিছোতে পিছোতে বললেন, ‘রাজা, আমার কাছে আসবেন না।’

‘কাছে আসব না মানে? হেঁঃ, তুমি না আমার বউ হবে?’

‘আপনার স্ত্রী হবার আগে আমি আত্মহত্যা করব।’

‘এ আবার কী রকম উলটো কথা হল? এমন কথা তো ছিল না!’

‘মালবের রাজকুমারীর সঙ্গে কোনও পশুর বিয়ে হতে পারে না!’

ব্যাঘ্ররাজের কুতকুতে চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ও তাঁর বাঁদুরে থ্যাবড়া নাকটা ফুলে উঠল, এমন আশ্চর্য কথা আজ পর্যন্ত তার মুখের সামনে আর কেউ বলতে সাহস করেনি। সে বললে, ‘আমি পশু? ওহে মন্ত্রী, মেয়েটা কী হে?’

মন্ত্রী মনে মনে বললে, মেয়েটা অত্যুক্তি করেনি। মুখে সান্ত্বনা দিয়ে বললে, ‘মহারাজ, দত্তাদেবী আপনাকে বোধ হয় পশুরাজ বলতে চান। আপনি পুরুষসিংহ কিনা?’

অমনই বুক ফুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, দুইদিকে দুই বাহু ছড়িয়ে ব্যাঘ্ররাজ সগর্বে বললে, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! বউ, একবার আমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখো দেখি, সত্যিই আমি পুরুষসিংহ কিনা! এমন চেহারা কটা দেখেছ?’

মন্ত্রী মনে মনে বললে, মানুষের সৌভাগ্য যে পৃথিবীতে এমন চেহারা বেশি দেখা যায় না।

দত্তা কিছু বললেন না, তাঁর দুই চোখে বিজাতীয় ঘৃণা।

ব্যাঘ্ররাজ হঠাৎ লাফ মেরে দত্তাকে ধরতে গেল।

দত্তা তাড়াতাড়ি পিছনে সরে গেলেন।

লক্ষ্মী আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কে আছ রক্ষা করো, রক্ষা করো!’

ব্যাঘ্ররাজ অট্টহাস্য করে বললে, ‘ভয় নেই, আমিই তোমাদের রক্ষা করব!’

‘রক্ষা করে, রক্ষা করো!’

‘ওহে মন্ত্রী, একেই বুঝি অরণ্যে রোদন বলে? ও বোকা মেয়েটা চেঁচিয়ে কাকে ডাকতে চায়?’

পিছন থেকে গম্ভীর স্বরে কে বললে, ‘আমাকে।’

ব্যাঘ্ররাজ চমকে ফিরে সবিস্ময়ে দেখলে এক দীর্ঘদেহ সৈনিক স্থির পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন! মাথায় শিরস্ত্রাণ, দেহে বর্ম, পৃষ্ঠে তূণ ও ধনু, কটিবন্ধে তরবারি, ডান হাতে বর্শাদণ্ড। মুখ দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে তিনি কোনও অসাধারণ পুরুষ।

ব্যাঘ্ররাজ আগন্তুকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, ‘বন থেকে বেরুল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। তুমি কে বট হে?’

‘আমি সমুদ্রগুপ্ত।’

ব্যাঘ্ররাজের চোখ দুটি যেন ঠিকরে পড়বার মতো হল। বিস্ময়ের আতিশয্যে সে কথা বলতে পারলে না।

দত্তা দৌড়ে সমদ্রগুপ্তের কাছে গিয়ে অবশ হয়ে বসে পড়লেন।

সমুদ্রগুপ্ত প্রশান্ত নেত্রে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেবী, শ্রেষ্ঠ ফুল দেখলেই চেনা যায়, পরিচয়ের দরকার হয় না। মালব-রাজকুমারী, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।’

ব্যাঘ্ররাজ চিৎকার করে বললে, ‘ওহে সমুদ্দুরগুপ্ত, তুমি জানো আমি কে?’

সমুদ্রগুপ্ত একটু হেসে বললেন, ‘নিকৃষ্ট পশুকে দেখলেই চেনা যায়। তুমি ব্যাঘ্ররাজ। এতক্ষণে আমার সৈন্যরা তোমার রাজধানী দখল করছে। পাছে মালব-রাজকুমারীকে নিয়ে তুমি এইদিক দিয়ে পালিয়ে যাও, সেই ভয়েই গুপ্তপথ দিয়ে আমি বাঘগড়ে যাচ্ছিলুম।’

‘একা?’

‘একটু আড়ালেই আমার একহাজার সৈন্য অপেক্ষা করছে। তুমি কি তাদের দেখতে চাও? একবার ভেরি বাজালেই তারা আসবে।’

মন্ত্রী চুপিচুপি বললে, ‘এখন বুঝুন মহারাজ, এদিকে এসে আপনি কী অন্যায় করেছেন।’

দাঁতে দাঁত ঘষে ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘কী বলব সমুদ্দুরগুপ্ত, নিতান্ত একলা পড়ে গেছি, নইলে তোমাকে একবার দেখে নিতুম।’

সমুদ্রগুপ্ত সে কথার জবাব না দিয়ে হেঁট হয়ে দত্তার হাত ধরে তুলে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

ব্যাঘ্ররাজ গর্জন করে বললে, ‘কী! আমার বউ-এর গায়ে হাত! মন্ত্রী, মন্ত্রী, থাবড়া মেরে সমুদ্দুরগুপ্ত গালটা ভেঙে দিয়ে এসো তো!’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, ও কাজটা আমার চেয়ে আপনিই ভালো করে করতে পারবেন। আমি এখন পালালুম।’

ব্যাঘ্ররাজ ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘দাঁড়াও হে মন্ত্রী, দাঁড়াও! আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি!’

সমুদ্রগুপ্ত ভেরি বার করে ফুঁ দিলেন!

ব্যাঘ্ররাজ সভয়ে বললে, ‘ও মন্ত্রী, ও যে আবার শিঙে বাজায় গো!’

মন্ত্রী হতাশভাবে বললে, ‘এইবারে আমাদেরও শিঙে ফুঁকতে হবে! ওই দেখুন, চারিধার থেকে দলে দলে সেপাই আসছে।’