» » ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ভারতের দ্বিতীয় প্রভাতে

দশম পরিচ্ছেদ

মরীচিকা—বিভীষিকা!

কালো অরণ্য!

মানুষের প্রাণ হেথা

অতি নগণ্য!

সে রাজ্যের নাম মহাকান্তার—মগধ ও ওড়িশার মধ্যবর্তী প্রদেশে তার অবস্থান। তারই রাজা হচ্ছে ব্যাঘ্ররাজ। বাঘ থাকে বনে এবং মহাকান্তার বলতে ভীষণ নিবিড় অরণ্যই বোঝায়। কাজেই রাজার ও রাজ্যের নাম হয়েছে এমন অদ্ভুত।

কিন্তু সাধারণত নিবিড় অরণ্য বললে আমাদের মনে বনের যে ছবি জেগে ওঠে, মহাকান্তারের আসল দৃশ্য তার চেয়েও ভয়ানক। এখানে এসে দাঁড়লে মনে হবে, সৃষ্টি-প্রভাতের যে পৃথিবীতে মানুষ জন্মায়নি, আমরা যেন সেই পৃথিবীরই কোনও এক অংশে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি।

যেখানে মানুষের বসতি নেই সেখানকার কথা বলতে গেলে আগে স্তব্ধতার বর্ণনা দিতে হয়। মহাকান্তারেরও অধিকাংশ স্থানে মানুষের কোনও সাড়াই পাওয়া যায় না। কিন্তু এ অরণ্য-সাম্রাজ্য নিস্তব্ধ নয়। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নানা জাতের নানা বৃক্ষ সর্বদাই জাগিয়ে রেখেছে মর্মর-গর্জন! পাহাড়ে পাহাড়ে, গুহায় গুহায় ঢুকে ঝোড়ো হাওয়া করছে অশ্রান্ত চিৎকার এবং তারপর যেন কাকে খুঁজে না পেয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে ক্রুদ্ধ নিশ্বাসে রাশি রাশি শুকনো পাতা উড়িয়ে তুলছে। যেন বনবাসী অদৃশ্য প্রেতাত্মাদের মাংসহীন অস্থি-কঙ্কালের খড়মড় খড়মড় শব্দ! লক্ষ লক্ষ লতা লক্ষ লক্ষ বৃক্ষের আপাদমস্তক জড়িয়ে যেসব জাল ফেলেছে, ঘন পাতার যবনিকা ভেদ করে তাদের দেখা যায় না এবং দুপুরের প্রখর সূর্যকরও সে দুর্ভেদ্য আবরণের ভিতর দিয়ে নীচেকার অনন্ত গুল্ম ও কাঁটাঝোপের উপরে এসে পড়তে পারে না। অরণ্যের তলায় বিরাজ করে রাত্রিময় দিবসের ভয়াবহ অন্ধকার এবং তারই মধ্যে থেকে থেকে জাগে মাতঙ্গদের বৃংহিত ও পৃথিবী কাঁপানো পদশব্দ এবং ব্যাঘ্র-ভালুকের হিংস্র কণ্ঠধ্বনি এবং হতভাগ্য নানা জীবের মৃত্যু আর্তনাদ!

এই মহাকান্তারেরই স্থানে স্থানে বনজঙ্গল কেটে মানুষেরা বসবাস করবার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু বিরাট অরণ্যের বিপুল জঠরের ভিতর থেকে তাদের আবিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হবে না। সেসব গ্রামের অবস্থা হয়েছে যেন মহাসাগরের মাঝে মিশিয়ে যাওয়া এক-এক ঘটি জলের মতো।

মহাকান্তারের অধিপতি ব্যাঘ্ররাজ—যেমন তার নাম, তেমনই তার আকৃতি, তেমনই তার প্রকৃতি! সে হচ্ছে এক অনার্য রাজা, ঘোরকৃষ্ণবর্ণ প্রায় পাঁচ হাত উঁচু দানবের মতো তার দেহ—তার এক-একখানা হাত সাধারণ মানুষের উরুর মতো মোটা এবং পায়ের তালে তার মাটি কাঁপে থরথরিয়ে! তার মিষ্ট কথাও শোনায় বাঘের গর্জনের মতো এবং সে যখন অট্টহাস্য করে লোকের কানে লেগে যায় তালা!

মানুষ হলেও ব্যাঘ্ররাজের একমাত্র সম্বল হচ্ছে পশুশক্তি। দয়ামায়া-স্নেহের কোনও ধারই সে ধারে না। তাই মহাকান্তারের আশপাশের রাজ্যের বাসিন্দারা তার নাম শুনলেই চোখের সামনে দেখে মৃত্যুর স্বপ্ন। কারণ, সে যখন অরণ্যের অন্ধকার ছেড়ে দেশে দেশে দস্যুতা করতে বেরোয়, তখন আকাশের বুক রাঙা করে দিকে দিকে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে গ্রাম ও নগর, পথে পথে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে নরনারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবার মৃতদেহ, সর্বত্র ছড়িয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের কাতর ক্রন্দন।

কিন্তু বাইরের কোনও রাজ্যের কোনও সাহসী রাজাও ব্যাঘ্ররাজের মুল্লুকে ঢুকে তার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করতে আসেন না। প্রথম প্রথম দু-একজন সে চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু মহাকান্তারের মৃত্যু-ভীষণ অন্ধকারজালে, তার ক্ষুধার্ত উদর থেকে আজ পর্যন্ত কোনও বিদেশিই মুক্তিলাভ করতে পারেনি।

আজ ব্যাঘ্ররাজের পরামর্শ-সভা বসেছে। পরামর্শ-সভা বললে বোধহয় ঠিক হবে না। ব্যাঘ্ররাজ জীবনে কারুর পরামর্শে কান পাতেনি। সে মন্ত্রী, সেনাপতি ও অন্যান্য সর্দারদের আহ্বান করে কেবল হুকুম দেওয়ার জন্যেই।

তার গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা বাঘের ছালে, কোমরে ঝুলছে তরবারি, হাতে দুলছে গদা বা মুগুর। মাথার ঝুলে-পড়া লম্বা লম্বা চুলে ও গোঁফ-দাড়িতে তার মুখের অধিকাংশ ঢাকা পড়ে গিয়েছে—তারই ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে অজগরের মতো কুতকুতে তীব্র দুটো চক্ষু, বনমানুষের মতো থ্যাবড়া নাক ও কাফ্রির মতো পুরু ঠোঁটের ফাঁকে জানোয়ারের মতো বড় বড় দাঁত!

ব্যাঘ্ররাজ অতিশয় উত্তেজিতভাবে তখন আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। হাতের গদাটা সশব্দে আসনের উপরে রেখে দিয়ে সে বললে, ‘সুমুদ্দুরগুপ্ত মহাকান্তারের প্রান্তে এসে হাজির হয়েছে বলে তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন? তোমরা কি জানে না, আমার এই মহাকান্তারের চারিধারে কত রাজার অস্থিচূর্ণ ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে আছে? আসুক সুমুদ্দুরগুপ্ত, সে আমার করবে কি?’

সেনাপতি বললে, ‘আমিও মহারাজের মত সমর্থন করি। আমাকে আদেশ দিন, সৈন্যরাও প্রস্তুত, আমরা এই মুহূর্তে যুদ্ধযাত্রা করতে রাজি আছি।’

মন্ত্রী বললে, ‘মহারাজ, সমুদ্রগুপ্ত সাধারণ শত্রু নয়, সে কত সহজে কোশলরাজ মহেন্দ্রকে হারিয়ে দিয়েছে, তা কি আপনি শোনেননি?’

ব্যাঘ্ররাজ ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘শুনেছি হে মন্ত্রী, শুনেছি। কোশলরাজ মহেন্দ্র কি আমারও হাতের মার খায়নি? তার হাত থেকে আমিও কি মালরাজার মেয়ে দত্তাদেবীকে ছিনিয়ে আনিনি? মহেন্দ্র আর আমি কি সমান? হেঁঃ! মন্ত্রী, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি বেজায় কম। সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে দেখো, আমার গদা ওখানে শুয়ে আছে। বেশি যদি ঘ্যান ঘ্যান করো তাহলে এখনই আমার গদা তোমার বউকে বিধবা না করে ছাড়বে না! হেঁঃ, সুমুদ্দুরগুপ্ত না পুকুরগুপ্ত, খালগুপ্ত! একবার আমার হুঙ্কার শুনলেই তার নাড়ি ছেড়ে যাবে! হেঁঃ!’

বুদ্ধিমান মন্ত্রী আড়চোখ একবার গদার দিকে চেয়েই নিরাপদ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়বার চেষ্টা করলে।

ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘কী হে মন্ত্রী, সরে পড়ছ বড় যে?’

‘আজ্ঞে না মহারাজ, সরে পড়ব কেন? কী আদেশ বলুন।’

‘পুকুরগুপ্ত কত সৈন্য নিয়ে এসেছে সে খবর রাখো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ। সমুদ্রগুপ্ত যে অসংখ্য সৈন্য নিয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছে, এ খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু সে মহাকান্তারের দিকে এসেছে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে।’

‘মোটে পঞ্চাশ হাজার?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ।’

‘সেনাপতি, আমাদের কত সৈন্য আছে?’

‘পঁচিশ হাজার।’

‘পঁচিশ হাজার? হেঁঃ! ব্যাঘ্ররাজের এক-একজন সৈন্য পুকুরগুপ্তের চার চারজন সৈন্যের সমান! কী বলো হে সেনাপতি, তাই নয় কি?’

‘নিশ্চয়ই মহারাজ, নিশ্চয়ই!’

‘তুমি কী বলো হে মন্ত্রী?’

মন্ত্রী আর একবার গদার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘নিশ্চয় মহারাজ, নিশ্চয়!’

‘হেঃ’! মন্ত্রী, আমার গদার ভয়ে তুমি ও-কথা বলছ না তো?’

‘সে কী মহারাজ, আপনার মন্ত্রী হয়ে গদাকে আবার কীসের ভয়? ও গদার ঘা খেয়ে খেয়ে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে যে!’

‘তা যা বলেছ, পেটে খেলেই পিঠে সয়! হেঁঃ, মাইনেটি তো বড় কম পাও না! যাক ও কথা! সেনাপতি, তুমিই যুদ্ধে যাও! আমি আর ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব না।’

সেনাপতি বিদায় নিলে।

ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘মন্ত্রী, মনে আছে তো, মালবরাজার মেয়ে দত্তাদেবী আমার কাছ থেকে দু-মাস সময় চেয়েছিল, আজ সে সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ!’

‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, দত্তাদেবীর সঙ্গে আজ বাদে কাল আমার বিয়ে হবে! হেঁঃ, কী আনন্দ মন্ত্রী, কী আনন্দ! কাল সকালে উঠেই তুমি বিয়ের সব বন্দোবস্ত করে ফেলো—বুঝেছ?’

‘বুঝেছি।’

ব্যাঘ্ররাজ গর্জন করে বললে, ‘বুঝেছ না ছাই বুঝেছ, ঘোড়ার ডিম বুঝেছ! হেঁঃ, কী বুঝেছ বলো দেখি?’

‘আজ্ঞে না মহারাজ, আমি কিছুই বুঝিনি!’

‘তাই বলো, তুমি কিছু বুঝলে কি বোকার মতো আমার মন্ত্রী হতে আসতে? কিন্তু বোঝো আর না বোঝো, যা বললুম মনে রেখো। এখন চলো, রাজধানীর সিংহদ্বারের ওপরে নহবতখানায় বসে মজা করে যুদ্ধ দেখা যাক।’

আশ্চর্য ব্যাপার, এটা কল্পনাই করা যায় না। ব্যাঘ্ররাজ যা বলেছিল তাই হল।

রাজধানীর সামনেই এক মস্ত মাঠ—তার দুই দিকেই গভীর অরণ্য।

মাঠের মধ্যে খানিকক্ষণ যুদ্ধ হওয়ার পরেই মগধ সৈন্যেরা বেগে পলায়ন করতে লাগল এবং তাদের পিছনে পিছনে ছুটল জয়ধ্বনি করতে করতে মহাকান্তারের সৈন্যগণ!

সিংহদ্বারের উপর থেকে বিকট আনন্দে চেঁচিয়ে ব্যাঘ্ররাজ বললে, ‘দেখছ হে মন্ত্রী, দেখছ? মহাকান্তারের বীরত্বটা দেখছ তো? তবু আমি যুদ্ধে নামিনি।’

মন্ত্রী প্রকাশ্যে কিছু না বলে মাথা নাড়তে নাড়তে মনে মনেই বললে, ‘দিগ্বিজয়ী মগধ সৈন্যরা এত সহজে পালাবে? অসম্ভব। ভেতরে নিশ্চয়ই কোনও ফন্দি আছে। কিন্তু ফন্দিটা যে কী হতে পারে সেটা বোঝা গেল না।’

ব্যাঘ্ররাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘মন্ত্রী, মগধের দর্প তো চূর্ণ হল, আমি বাঘগড়ে দত্তাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে চললুম।’

ব্যাঘ্ররাজ চলে গেল, মন্ত্রী কিন্তু সেখান থেকে নড়ল না। দূর মাঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মগধ সৈন্যেদের তাড়া করে মহাকান্তারের সৈন্যেরা তখন অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল মাঠের দুই পাশের বনের দিকে। চমকে উঠে সে বললে, অ্যাঁ! আগে ছিল অর্ধচন্দ্র ব্যূহ, এখন হচ্ছে চক্রব্যূহ! কী সর্বনাশ, কী সর্বনাশ!’