» » বর্গি এল দেশে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বর্গি এল দেশে : পাঁচ

ভাস্কর পণ্ডিত তখনকার মতো বিতাড়িত হলেও বাংলাদেশ থেকে বর্গিদের আড্ডা উঠে যায়নি।

কারণ কিছু দিন যেতে-না-যেতেই দেখি, তাঁর মুরুব্বি রঘুজি ভোঁসলেকে নিয়ে ভাস্কর পণ্ডিত আবার হাজির হয়েছেন কাটোয়া শহরে, তাঁরা নাকি সাহু রাজার হুকুমে বাংলার চৌথ আদায় করতে এসেছেন।

রাজা রঘুজির মস্ত শত্রু মারাঠিদের প্রথম পেশোয়া বালাজি রাও। তিনিও দলে দলে সৈন্য নিয়ে বিহারে এসে উপস্থিত হলেন। দিল্লির বাদশাহ মহম্মদ শাহের অনুরোধে রঘুজিকে তিনি বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিতে এসেছেন।

কিন্তু সব শিয়ালের এক রা! বালাজিও লক্ষ্মীছেলে নন, কারণ তিনিও এলেন দিকে দিকে হাকাকার তুলে লুঠপাট করতে করতে। সাঁওতাল পরগনার বনজঙ্গল ভেদ করে তিনি এসে পড়লেন বীরভূমে, তারপর ধরলেন মুর্শিদাবাদের পথ।

বহরমপুরের কাছে গিয়ে আলিবর্দী দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। পরামর্শের পরে স্থির হল, নবাবের কাছ থেকে বালাজি বাইশ লক্ষ টাকা চৌথ পাবেন এবং তার বিনিময়ে তিনি করবেন বাংলা থেকে রঘুজিকে তাড়াবার ব্যবস্থা।

সেই খবর পেয়েই রঘুজি কাটোয়া থেকে চম্পট দিলেন চটপট। বালাজিও তাঁর পিছনে পিছনে ছুটতে কসুর করলেন না। এক জায়গায় দুই দলে বেধে গেল মারামারি। সেই ঘরোয়া লড়াইয়ে হেরে এবং অনেক লোক ও মালপত্র খুইয়ে রঘুজি ও ভাস্কর পণ্ডিত লম্বা দিলেন উড়িষ্যার দিকে। কর্তব্যপালনের জন্যে যথেষ্ট ছুটোছুটি করা হয়েছে ভেবে বালাজিও ফিরে গেলেন পুণার দিকে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ করলে প্রায় নয়মাসব্যাপী শান্তিভোগ। কিন্তু বাংলা ও বিহারের বাসিন্দারা নিশ্চিন্ত হয়ে ছিল না,—বর্গিদের বিশ্বাস কী? কলকাতাবাসী ব্যবসায়ীরা পঁচিশ হাজার টাকা তুলে শহরের অরক্ষিত অংশে এক খাল খুঁড়ে ফেললে, সেই খালই ‘মার্হাট্টা ডিচ’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। বিহারিরাও পাঁচিল তুলে দিলে পাটনা শহরের চারিদিকে।

ইতিপূর্বে বর্গিরা দুই-দুইবার বাংলা আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেও শেষপর্যন্ত লুঠের মাল নিয়ে সরে পড়তে পারেনি। সেইজন্যে ভাস্কর পণ্ডিতের আপশোশের অন্ত ছিল না। এখন বালাজির অন্তর্ধানের পর পথ সাফ দেখে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সংহার-মূর্তি ধারণ করে উড়িষ্যা থেকে আবার ধেয়ে এলেন বাংলার দিকে। চতুর্দিকে আবার উঠল সর্বহারাদের গগনভেদী হাহাকার, গ্রামে গ্রামে দেখা গেল দাউ দাউদাউ লেলিহান অগ্নিশিখা, পথে পথে ছড়িয়ে রইল অসহায়দের খণ্ড-বিখণ্ড মৃতদেহ। বর্গি এল—আবার বর্গি এল দেশে!

আলিবর্দী দস্তুরমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বালাজিকে রঘুজির পিছনে লাগিয়ে তিনি অবলম্বন করেছিলেন সেই বহু পরীক্ষিত পুরাতন কৌশল—অর্থাৎ যাকে বলে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। কিন্তু ব্যর্থ হল সে কৌশল—আবার বর্গি এল দেশে!

এখন উপায়? হতভম্ব রাবণ নাকি বলেছিলেন, ‘মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী!’ আজ আলিবর্দীরও সেই অবস্থা—বর্গিরা যেন রক্তবীজের ঝাড়! এই অমঙ্গুলে ঝাড়কে উৎপাটন করতে হলে ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান ভুলে অন্য উপায় আবিষ্কার না করলে চলবে না। রাজকোষ অর্থশূন্য; বারংবার যুদ্ধযাত্রায় সৈন্যরা পরিশ্রান্ত; বৃদ্ধ আলিবর্দীরও শরীর অপটু। এই সব বুঝে বর্গিদের জন্যে মোক্ষম দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করবার জন্যে তিনি এক গুপ্ত পরামর্শ-সভার আয়োজন করলেন।

ভাস্কর পণ্ডিতের কাছে গেল আলিবর্দীর সাদর আমন্ত্রণ; নবাব আর যুদ্ধ করতে নারাজ এবং অক্ষম। তিনি এখন আপসে মিটমাট করে শান্তি স্থাপন করতে ইচ্ছুক। ভাস্কর পণ্ডিত যদি অনুগ্রহ করে নবাব শিবিরে পদার্পণ করেন, তাহলে সমস্ত গোলযোগ খুব সহজেই বন্ধুভাবে চুকে যেতে পারে।

ভাস্কর নিশ্চয়ই মনে করেছিলেন, বালাজির মতো তিনিও আলিবর্দীর কাছে নির্বিবাদে বহু লক্ষ টাকা হাতিয়ে বাজিমাৎ করতে পারবেন। কাজেই কিছুমাত্র সন্দেহ না করেই মাত্র একুশজন সঙ্গী সেনানী নিয়ে হাসতে হাসতে তিনি পদার্পণ করলেন নবাবের শিবিরে। সেদিনের তারিখ হচ্ছে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ।

ভাস্কর পণ্ডিত এবং বিশজন সেনানী আর বর্গিরা আস্তানায় প্রত্যাগমন করতে পারেননি। শিবিরের আনাচেকানাচে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করছিল দলে দলে হত্যাকারী। সহসা আবির্ভূত হয়ে তারা বর্গিদের টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললে। মাত্র একজন সেনানী সেই মারাত্মক খবর নিয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল ভগ্নদূতের মতো।

ব্যস, এক কিস্তিতেই বাজিমাৎ! সেনাপতি ও অন্যান্য দলপতিদের নিধনসংবাদ শুনেই বর্গি পঙ্গপালরা মহাভয়ে সমগ্র বঙ্গ ও উড়িষ্যা দেশ ত্যাগ করে পলায়ন করলে।