ঐতিহাসিক সমগ্র
বর্গি এল দেশে : চার
আলিবর্দী তখনও পর্যন্ত রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রত্যাগমন করতে পারেননি!
সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন সুচতুর ভাস্কর পণ্ডিত। সাতশত বাছা বাছা অশ্বারোহী নিয়ে চল্লিশ মাইল পথ পার হয়ে তিনি অরক্ষিত মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠে এসে পড়লেন।
চারিদিকে হুলুস্থূল! বাড়িতে নয়, গ্রামে নয়, নিজ রাজধানীর উপরে ডাকাতের হানা! কে কবে শুনেছে এমন আজব কথা? যারা পারলে, জোরে পা চালিয়ে গেল পালিয়ে। যারা পারলে না, ভয়ে মুখ শুকিয়ে জপতে লাগল ইষ্টনাম।
শহরতলি থেকে শহরের ভিতরে—এ আর আসতে কতক্ষণ! বর্গিরা হই-হই করে মুর্শিদাবাদের মধ্যে এসে পড়ল—ঘরে ঘরে চলল লুঠতরাজের ধুম, বিশেষত ধনীদের প্রাসাদে হিন্দু এবং মুসলমান কেউ পেলে না নিস্তার।
এক জগৎশেঠকেই গুণে গুণে দিতে হল তিন লক্ষ টাকা! সে যুগের তিন লাখ টাকার দাম ছিল এ-যুগের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
বর্গিদের বাধা দেয় শহরে ছিল না এমন রক্ষী। তারা মনের সাধে অবাধে গোটা দিন ধরে নিজেদের ট্যাঁক ভারী করতে লাগল—সকলে ভেবে নিলে, আর রক্ষা নেই, এইবার বুঝি সর্বনাশ হয়।
এমন সময়ে কাটোয়ার পথ থেকে দলবল নিয়ে স্বয়ং আলিবর্দী এসে পড়লেন হন্তদন্তের মতো।
বর্গিরাও যথাসময়ে সরে পড়তে দেরি করলে না, সোজা গিয়ে হাজির হল কাটোয়ায় এবং আশ মিটিয়ে নিঃশেষে মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠন করতে পারলে না বলে আক্রোশে যাবার পথে দুই পাশের গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগিয়ে যেতে লাগল। চিহ্নিত হয়ে রইল তাদের সমগ্র যাত্রাপথ উত্তপ্ত ভস্মস্তূপে।
কাটোয়া হল বর্গিদের প্রধান আস্তানা। সেখান থেকে হুগলি এবং তারপর তারা দখল করলে আরও গ্রাম ও নগর। রাজমহল থেকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি তারা অধিকার করে বসল। গঙ্গার পশ্চিম দিক থেকে বিলুপ্ত হল নবাবের প্রভুত্ব—এমনকী জমিদাররা পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাদের রাজস্ব দিতে লাগল এবং তাদের বশ্যতা স্বীকার করলে ফিরিঙ্গি বণিকরাও।
গঙ্গার পূর্বদিকের ভূভাগ আলিবর্দীর হস্তচ্যুত হল না বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে সে অঞ্চলেও বর্গিরা হানা দিতে ছাড়লে না। তাদের উৎপাতের ভয়ে ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা গঙ্গার পশ্চিম দিক ছেড়ে পালিয়ে এল।
বাংলাদেশ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল বললেই চলে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হবার উপক্রম; বাজারে শস্যের অভাব, জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য; শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে উঠল; যারা তুঁতের আবাদ করে তারা পালিয়ে গেল—কারণ বর্গিরা তুঁতগাছের পাতা ঘোড়াদের খোরাকে পরিণত করলে, যা ছিল গুটিপোকাদের প্রধান খাদ্য। ফলে আর রেশম প্রস্তুত হত না—এমনকী যারা রেশমি কাপড় বুনত তারাও হল দেশছাড়া এবং রেশমের কারবারও হল স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে কিছু কিছু তুলে দিলে আসল অবস্থা উপলব্ধি করা সহজ হবে।
একজন বলছেন, ‘আপন আপন সম্পত্তি নিয়ে সকলেই পলায়ন করতে লাগল। আচম্বিতে বর্গিরা এসে তাদের চারিধার থেকে ঘিরে ফেললে। আর সব কিছু ছেড়ে তারা কেড়ে নিতে লাগল কেবল সোনা আর রুপা। আর অনেকের হাত, অনেকের নাক ও কান কেটে নিলে এবং অনেককে মেরে ফেললে একেবারেই। স্ত্রীলোকদেরও উপরে অত্যাচার করতে বাকি রাখলে না। আগে বাইরের লুঠপাট সেরে তারা গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়ত এবং আগুন লাগিয়ে দিত ঘরে ঘরে। দিকে দিকে হানা দিয়ে তারা অশ্রান্ত স্বরে চিৎকার করত—আমাদের টাকা দাও, আমাদের টাকা দাও, আমাদের টাকা দাও! যারা টাকা দিতে পারত না, তাদের নাকের ভিতর তারা সুড়সুড় করে জল ঢেলে দিত কিংবা পুকুরে ডুবিয়ে মেরে ফেলত। লোকে নিরাপদ হতে পারত কেবল ভাগীরথীর পরপারে গিয়ে।
প্রাচীন কবি গঙ্গারাম তাঁর রচিত ‘মহারাষ্ট্রপুরাণ’ কাব্যে বর্গির হাঙ্গামার চিত্র দিয়েছেন :
এই মতে সব লোক পলাইয়া যাইতে।
আচম্বিতে বরগী ঘেরিলা আইসে সাথে।।
মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।
সোনা, রূপা লুঠে নেয় আর সব ছাড়া।।
কারু হাত কাটে কারু কাটে কান।
একই চোটে কারু বধয়ে পরান।।’
বর্ধমানের মহাসভার সভাপণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার বলেছেন : সাহু রাজার সেপাইরা নৃশংস; গর্ভবতী নারী, শিশু, ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রের হত্যাকারী, বন্যপ্রকৃতি। তাবৎ লোকের উপরে দস্যুতা করিতে দক্ষ এবং যে-কোনও পাপ কাজ করতে সক্ষম। তাদের প্রধান শক্তির কারণ, আশ্চর্যরূপে দ্রুতগতি অশ্ব। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখলেই তারা ঘোড়ায় চড়ে অন্য কোথাও চম্পট দেয়।
বর্গিদের চারিত্রিক বিশেষত্ব বোঝা গেল। তারা দস্যু, তারা নির্মম, তারা কাপুরুষ। মহারাষ্ট্রের বিশেষ গৌরবের যুগেও একাধিকবার মারাঠি চরিত্রের এইসব লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। দিল্লির মুসলমানরাও এইজন্যে তাদের দারুণ ঘৃণা করত।
বর্ষা এল বাংলায়, ঘাট-মাঠ-বাট জলে জলে জলময়, অচল পথ-চলাচল। বর্গিদেরও দায়ে পড়ে অলস হয়ে থাকতে হল।
আলিবর্দী রাজধানীর বাইরে এসে প্রচুর সৈন্যবল সংগ্রহ করে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।
ভাস্কর পণ্ডিতও তলে তলে তৈরি হবার চেষ্টা করলেন। আরও বেশি ফৌজ পাঠাবার জন্যে আবেদন জানালেন নাগপুরের রাজা রঘুজির কাছে। কিন্তু তাঁর আবেদন মঞ্জুর হল না। কারণ হয়তো সৈন্যাভাব।
আলিবর্দী ছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি। তিনি বেশ বুঝলেন, নদী নালার জল শুকিয়ে গেলে বর্গিদের বেগবান ঘোড়াগুলো আবার কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। এই হচ্ছে তাদের কাবু করবার মাহেন্দ্রক্ষণ!
দুর্জন হলে কী হয়, ভাস্করের ভক্তির অভাব নেই। জমিদারদের কাছ থেকে জোর করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আদায় করে তিনি মহাসমারোহে দুর্গাপুজার আয়োজন করলেন কাটোয়া শহরে।
নবমীর রাত্রি। পূজা ও আমোদ-প্রমোদের পরে খাওয়াদাওয়া সেরে আনন্দশ্রান্ত মারাঠিরা অচেতন হয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।
কিন্তু আলিবর্দী ও তাঁর বাছা বাছা সৈনিকের চোখে নেই নিদ্রা। গোপনে গঙ্গা ও অজয় নদী পার হয়ে আলিবর্দী সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘুমন্ত দস্যুদের উপরে।
বেশি কিছু করতে হল না এবং লোকক্ষয়ও হল না বেশি। সবদিক দিয়েই সফল হল এই অভাবিত আক্রমণ।
প্রায় বিনা যুদ্ধেই বিষম আতঙ্কে পাগলের মতো বর্গিরা বেগে পলায়ন করলে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। তাদের সমস্ত রসদ, তাঁবু ও মোটঘাট হল আক্রমণকারীদের হস্তগত।
ফৌজ নিয়ে বাংলা ছেড়ে পালাতে পালাতে ও লুঠপাট করতে করতে ভাস্কর পণ্ডিত কটক শহরে গিয়ে আবার এক আড্ডা গাড়বার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু আলিবর্দী তাঁর পিছনে লেগে রইলেন ছিনে জোঁকের মতে—তাঁকে আর হাঁপ ছাড়বার বা নতুন শক্তিসঞ্চয় করবার অবসর দিলেন না! ভাস্করকে কটক থেকেও তাড়িয়ে একেবারে চিল্কা পার করে দিয়ে অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন নবাব আলিবর্দী খাঁ। তারপর বিজয়ী বীরের মতো ফিরে এলেন নিজের রাজধানীতে। এ হল ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।