» » বর্গি এল দেশে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বর্গি এল দেশে : তিন

শিবাজীর আমল থেকেই মারাঠি সৈনিকরা লুণ্ঠনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, আগেই বলা হয়েছে ও কথা।

তখনকার কালে ভারতীয় হিন্দুদের পক্ষে এ-সব হামলা ছিল তবু কতকটা সহনীয়। কারণ ধর্মদ্বেষী মুসলমানদের বহুযুগব্যাপী অত্যাচারের ফলে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত সমগ্র হিন্দুজাতি অত্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শিবাজীর অতুলনীয় প্রতিভাই সর্বপ্রথমে প্রতিষ্ঠিত করলে এমন এক বৃহৎ ও পরাক্রান্ত সাম্রাজ্য, যার বিরুদ্ধে মহামোগল ও হিন্দুবিদ্বেষী সম্রাট ঔরংজেবেরও প্রাণপণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রধানত মুসলমানদের কাহিল করার জন্যেই শিবাজী লুঠতরাজ চালিয়ে যেতেন মোগল সাম্রাজ্যের দিকে দিকে; সেই সূত্রে মোগল সম্রাটের হিন্দু প্রজারাও হানাদারদের কবলে পড়ে অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হত বটে, তবে সে ব্যাপারটা সবাই খুব বড় করে দেখত বলে মনে হয় না।

কিন্তু যখন ভারতে মুসলমানরা ক্রমেই হীনবল হয়ে পড়েছে এবং প্রায় সর্বত্রই বিস্তৃত হয়ে পড়েছে মারাঠিদের প্রভুত্ব, তখনও বর্গি হানাদাররা তাদের স্বধর্মাবলম্বী নাগরিক ও গ্রামীণদের উপরে চালিয়ে যেতে লাগল অসহনীয় ও অবর্ণনীয় অত্যাচার এবং তার মধ্যে কিছুমাত্র উচ্চাদর্শের পরিবর্তে ছিল কেবল নির্বিচারে যেন তেন প্রকারে নিছক দস্যুতার দ্বারা লাভবান হবার দুশ্চেষ্টা। যেখান দিয়ে বর্গি হানাদাররা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায়, সেখানেই পিছনে পড়ে থাকে কেবল সর্ববিষয়ে রিক্ত, ধূ ধূ-করা হাহাকার-ভরা মহাশ্মশান। এতটা বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠল এবং বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যাও পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল।

এক হিসেবে হুন আটিলা ও গ্রিক আলেকজান্ডার উভয়কেই দস্যু বলে মনে করা চলে। কারণ তাঁরা দুজনেই স্বদেশ ছেড়ে বেরিয়ে পরের দেশে গিয়ে হানা দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে আলেকজান্ডার বরেণ্য ও আটিলা ঘৃণ্য হয়ে আছেন। তার কারণ একজনের সামনে ছিল মহান আদর্শ, আর একজন করতে চেয়েছিলেন শুধু নরহত্যা ও পরস্বাপহরণ। বর্গিদের দলপতিরা ছিল শেষোক্ত নিকৃষ্ট শ্রেণির জীব।

সেটা হচ্ছে ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দের কথা। পাঠানদের দমন করবার জন্যে নবাব আলিবর্দী খাঁ গিয়েছিলেন উড়িষ্যায়। জয়ী হয়ে ফেরবার মুখে মেদিনীপুরের কাছে এসে তিনি খবর পেলেন, মারাঠি সৈন্যেরা অসৎ উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে বাংলার দিকে।

তার কিছুদিন পরে শোনা গেল, মারাঠিরা দেখা দিয়েছে বাংলার ভিতরে, বর্ধমান জেলায়, চারিদিকে তারা লুঠপাট, অত্যাচার ও রক্তপাত করে বেড়াচ্ছে।

দুঃসংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আলিবর্দী বর্ধমানের দিকে রওনা হতে বিলম্ব করলেন না। কিন্তু তিনি বোধহয় মারাঠিদের সংখ্যা আন্দাজ করতে কিংবা তাড়াতাড়ির জন্যে উচিতমতো সৈন্য সঙ্গে আনতে পারেননি—কারণ তাঁর ফৌজে ছিল মাত্র তিন হাজার অশ্বারোহী ও এক হাজার পদাতিক।

তাঁকে রীতিমতো বিপদে পড়তে হল। সংখ্যায় মারাঠিরা ছিল অগণ্য। তারা পিল পিল করে চারদিক থেকে এসে তাঁকে একেবারে ঘিরে ফেললে। সম্মুখ যুদ্ধে তাদের পরাস্ত করা অসম্ভব দেখে আলিবর্দী বর্ধমানেই ছাউনি ফেলতে বাধ্য হলেন।

মারাঠিদের নায়কের নাম ছিল ভাস্কর পণ্ডিত। নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলের সেনাপতি। নিজের ফৌজকে তিনি দুই অংশে বিভক্ত করলেন। এক অংশ আলিবর্দীকে বেষ্টন করে পাহারা দিতে লাগল। আর একদল ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে এবং চল্লিশ মাইলব্যাপী জায়গা জুড়ে আরম্ভ করলে লুঠতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও অকথ্য অত্যাচার।

ভাস্কর পণ্ডিতের দলবল এমনভাবে আটঘাট বেঁধে বসে রইল যে, কোনওদিক থেকেই নবাবি ফৌজের ছাউনির ভিতরে আর রসদ আমদানি করবার উপায় রইল না। শিবিরের মধ্যে কেবল সেপাইরা নয়, সেই সঙ্গে হাজার হাজার অনুচর এবং নবাবের পরিবারবর্গও বন্দি হয়েছিল, আহার্যের অভাবে সকলের অবস্থাই হয়ে উঠল দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো।

অবশেষে আলিবর্দী মরিয়া হয়ে মারাঠিদের সেই চক্রব্যূহ ভেদ করে সদলবলে কাটোয়ার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁকে বেশিদূর যেতে হল না, আশপাশ থেকে আচম্বিতে মারাঠিরা হুড়মুড় করে এসে পড়ে চিলের মতো ছোঁ মেরে নবাবি ফৌজের মোটঘাট ও তাঁবুগুলো কেড়ে নিয়ে কোথায় সরে পড়ল। আলিবর্দী তাঁর পক্ষের সকলকে নিয়ে খোলা আকাশের তলায় অনাহারে কর্দমাক্ত ধানক্ষেতের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে রইলেন; সে এক বিষম ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা—তিনি না পারেন এগুতে না পারেন পেছুতে।

কেটে গেল এক দিন ও দুই রাত্রি দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে।

উদরে নেই অন্ন, মাথার উপরে নেই আচ্ছাদন। হয় মৃত্যু, নয় মুক্তি! দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করে আলিবর্দীর সাহসী আফগান অশ্বারোহীর দল সবেগে ও সতেজে ঝাঁপিয়ে পড়ল মারাঠিদের উপরে এবং সে প্রবল আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে শত্রুরা পিছু হঠে যেতে বাধ্য হল।

নবাবি ফৌজ অগ্রসর হল কিছুদূর পর্যন্ত। তারপর শত্রুরা ফিরে-ফিরতি প্রতি-আক্রমণ শুরু করলে কাটোয়ার অনতিদূরে। সেখানে একটা লড়াই হল, কিন্তু শত্রুরা নবাবের গতিরোধ করতে পারলে না, নিজের অনশনক্লিষ্ট সৈন্যদল নিয়ে তিনি কাটোয়ার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

নবাবি শিকার হাতছাড়া হল বটে, কিন্তু মারাঠিরা বাংলার মাটি ছাড়বার নাম মুখে আনলে না। রক্তের স্বাদ পেলে বাঘের হিংসা যেমন বেড়ে ওঠে, অতি সহজে অতিরিক্ত ঐশ্বর্যলাভের আশায় ভাস্কর পণ্ডিতের লোভও আরও মাত্রা ছাড়িয়ে উঠল, অবাধে লুঠপাট করার জন্যে লেলিয়ে দিলেন নিজের পাপসঙ্গীদের।