» » বর্গি এল দেশে

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বর্গি এল দেশে : দুই

তখন মারাঠিদের সর্বময় কর্তা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজীর পৌত্র ও উত্তরাধিকারী মহারাজা সাহু। কেবল নিজ-মহারাষ্ট্রে নয়, মধ্যভারতেও ছিল তাঁর রাজ্যের এক অংশ। তাঁর অধীনে ছিলেন দুইজন নায়ক—পেশোয়া (বা প্রধান মন্ত্রী) বালাজি বাজীরাও এবং নাগপুরের রাজা বা সামন্ত রঘুজি ভোঁসলে। তাঁরা পরস্পরকে দেখতেন চোখের বালির মতো। দুজনেই দুজনকে বাধা দেবার জন্যে সর্বদাই প্রস্তুত থাকতেন।

শিবাজীর সময়ে এমন ব্যাপার সম্ভবপর হত না; কারণ সর্বময় কর্তা বলতে ঠিক যা বোঝায়, শিবাজী ছিলেন তাই। অধীনস্থ নায়কদের চলতে-ফিরতে হত একমাত্র তাঁরই অঙ্গুলিনির্দেশে। সে-রকম ব্যক্তিত্ব বা শক্তি ছিল না মহারাজা সাহুর। অধীনস্থ নায়কদের স্বেচ্ছাচারিতা তিনি ইচ্ছা করলেও সব সময়ে দমন করতে পারতেন না। এই কথা মনে রাখলে পরবর্তী ঘটনাগুলির কারণ বোঝা কঠিন হবে না।

কবিবর ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন—’স্বপ্ন দেখি বর্গীরাজ হইল ক্রোধিত।’

তাঁর আর একটি উক্তি শুনলে সন্দেহ থাকে না যে, কাকে তিনি ‘বর্গীরাজ’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতচন্দ্র বর্গির হাঙ্গামার সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি বলেছেন।

‘আছিল বর্গীর রাজা গড় সেতারায়।

আমার ভকত বড় স্বপ্ন কহ তায়।।’

‘সেতারা’ বা সাতারার রাজা বলতে সাহুকেই বোঝায়। যদিও বর্গিরা ‘চৌথ’ আদায়ের নামে যে টাকা আদায় করত তার মধ্যে তাঁরও অংশ থাকত, তবু বর্গির হাঙ্গামার সঙ্গে সাহুর যোগ ছিল প্রত্যক্ষ ভাবে নয়, পরোক্ষ ভাবে।

‘চৌথ’ হচ্ছে সাধারণত রাজস্বের চারভাগের এক ভাগ। মারাঠিদের দ্বারা ভয় দেখিয়ে বা হানা দিয়ে চৌথ বলে টাকা আদায়ের প্রথা শিবাজীর আগেও প্রচলিত ছিল। তবে শিবাজীর সময়েই এর প্রচলন হয় বেশি। কিন্তু তখনও তার মধ্যে যে যুক্তি ছিল, সাহুর সময়ে তা আর খাটত না, তখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যথেচ্ছাচারিতার নামান্তর মাত্র বা নিছক দস্যুতার সামিল।

চৌথের নিয়মানুসারে টাকা আদায় করবার কথা বৎসরে একবার মাত্র। কিন্তু বর্গিরা টাকা আদায় করতে আসত যখন-তখন। হয়তো একদল বর্গিকে টাকা দিয়ে খুশি করে প্রজাদের মান ও প্রাণ বাঁচানো হল। কিন্তু অনতিবিলম্বে এসে হাজির নতুন আর একদল বর্গি। তারা আবার টাকা দাবি করে। সে দাবি মেটাতে না পারলেই সর্বনাশ। অমনি শুরু হয়ে যায় লুঠতরাজ ও খুনখারাপি—সে এক বিষম ডামাডোলের ব্যাপার।

সময়ে এবং অসময়ে অর্থাৎ প্রায় সব সময়েই বর্গিদের এই যুক্তিহীন ও অসম্ভব দাবি মেটাতে মেটাতে অবশেষে বাংলাদেশের নাভিশ্বাস ওঠবার উপক্রম। কি রাজার এবং কি প্রজার হাল ছাড়বার অবস্থা আর কি!

এই সব নচ্ছার ও পাষণ্ড হানাদারের কবল থেকে বাঙালিরা মুক্তি পেলে কী উপায়ে, এইবারে আমরা সেই কাহিনিই বর্ণনা করব।

কিন্তু তার আগে আর একটা কথা বলে রাখা দরকার। আগেই বলা হয়েছে বর্গির হাঙ্গামা বিশেষ করে বাংলাদেশেরই ব্যাপার। বাদশাহি আমলে এক-একটি ‘সুবা’র অন্তর্গত ছিল এক-একজন সুবাদার বা শাসনকর্তার অধীনস্থ এক-একটি প্রদেশ। বাংলার সঙ্গে তখন যুক্ত ছিল বিহার ও উড়িষ্যা দেশও এবং বর্গির হাঙ্গামার সময়ে এদের সুবাদার ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁ। ইংরেজদের আমলেও প্রায় শেষপর্যন্ত বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার শাসনকর্তা ছিলেন একজন রাজপুরুষই!

প্রাচীনকালে—অর্থাৎ ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের আগেও দেখি, বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যার কতকাংশ একই রাজ্য বলে গণ্য হয়েছে। বাঙালি মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক প্রভৃতি এমনি রাজ্যই শাসন করতেন। বাঙালির সঙ্গে বিহারি ও ওড়িয়ারা তখন নিজেদের একই রাজ্যের বাসিন্দা বলে আত্মপরিচয় দিত,—’বিহার কেবল বিহারীদের জন্যে’ বা ‘উড়িষ্যা কেবল ওড়িয়াদের জন্যে’,—এ-সব জিগির আওড়াবার চেষ্টা করত না। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রেই এ-দেশে এই শ্রেণির সঙ্কীর্ণ জাতি-বিদ্বেষের জন্ম হয়েছে।

বর্গি হানাদাররা পদার্পণ করেছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার যুক্ত রঙ্গমঞ্চেই! তবে এ-কথা বলা চলে বটে, প্রধানত নীচু বাংলার উপরেই তাদের আক্রমণ হয়ে উঠেছিল অধিকতর জোরালো!