আলেকজান্ডার দি গ্রেট
পঞ্চম অধ্যায়
বিশ্বনাট্যশালায় প্রথম আবির্ভাব
বিশ বছর বয়সের এক ছোকরা এই আলেকজান্ডার!
এ বয়সে গরিবের ছেলেও বিদ্যালয় ও নিজের বাড়ির বাইরেকার কোনও খবর রাখতে পারে না। বিপুল পৃথিবীতে ছেড়ে দিলে সে হবে একান্ত অসহায়।
গরিবের ছেলে তবু নানা কারণে বাস্তব জগতের কিছু কিছু শেখবার সুযোগ ও সময় পায়, কিন্তু জন্মসুখী রাজার ছেলের কাছে তেমন অবসর বড় একটা আসে না।
তবু আলেকজান্ডার সমগ্র গ্রিসের অসংখ্য বিচক্ষণ ও বলবান শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, চারিদিক সামলে কেমন করে আত্মরক্ষায় সক্ষম হলেন? অসাধারণ বহুদর্শিতা না থাকলে এতটা সম্ভবপর হয় না। এই বহুদর্শিতার জন্ম কোথায়?
উত্তরে বলা যায়, তাঁর প্রতিভার মধ্যে। প্রতিভার ভিতরে থাকে ইন্দ্রজাল, সম্ভব করে সে অসম্ভবকে। কেবল শিক্ষায় ও অভিজ্ঞতায় প্রতিভা তৈরি হয় না।
কিছুদিন পরে ভারতে গিয়ে আলেকজান্ডারের সঙ্গে আর একটি যুবকের আলাপ হয়েছিল, তাঁর নাম চন্দ্রগুপ্ত। তিনিও ছিলেন প্রায় আলেকজান্ডারেরই সমবয়সি। এবং তিনিও প্রথম যৌবন গত হবার আগেই সমগ্র ভারতকে গ্রিক-নাগপাশ ও অরাজকতা থেকে মুক্ত করে বিরাট এক সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন। সেও প্রতিভার মহিমায়। একই যুগে এমন দুই অসাধারণ প্রতিভা পৃথিবী আর কখনও দেখেছে কি না জানি না!
ইউরোপের ইতালিতে মিকেলাঞ্জেলো বলে একজন প্রতিভাবান শিল্পী জন্মেছিলেন। তাঁর প্রায় শিশু বয়সে আঁকা দু-একখানি রেখাছবি পাওয়া যায়। সমালোচকেরা বলেছেন, সেসব ছবির তলায় যদি কোনও প্রবীণ ও পৃথিবীবিখ্যাত চিত্রকরও নাম সই করেন, তাহলেও তাঁর অমর্যাদা হবে না।
প্রথম যৌবনেই কোনও কোনও কবি মারা পড়ে সারা জগতে অমর হয়ে আছেন। তাঁদের বাল্যরচনাও পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির কবিদের কবিতার সঙ্গে সমান ঠাঁই পায়।
এসব হচ্ছে, প্রতিভার খেলা। প্রতিভার মধ্যে আছে কী যে রহস্য, কেউ তা জানে না, কিন্তু নবীনকে সে করে তোলে প্রবীণ।
বিশ বছর বয়সে আলেকজেন্ডার হলেন গ্রিসের হর্তা-কর্তা-বিধাতা।
কিন্তু গ্রিসের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রিক হয়েও আলেকজেন্ডার নিজের কর্তব্য ভুললেন না। হানিবলের মতন তিনিও পিতৃকৃত্য পালন করবার জন্যে বদ্ধপরিকর হলেন।
একদিন তিনি দুঃখিতভাবে বলেছিলেন, তাঁর জন্যে পিতা কোনও গৌরবজনক কার্য অসমাপ্ত রেখে যাবেন না। এখন দেখলেন, সামনে তাঁর গৌরবের অনেক পথই খোলা। কিন্তু সর্বাগ্রে আবশ্যক, পিতার উচ্চাকাক্ষঙাকে কার্যে পরিণত করা। গ্রিসের চিরশত্রু পারস্যের বিষদাঁত ভাঙতে হবে।।
একাজে যা-যা দরকার, ফিলিপ নিজের হাতেই সমস্ত ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। তাঁর পরিকল্পনা নিখুঁত। সবচেয়ে বড় কথা, সম্পূর্ণ নতুনভাবে শিক্ষিত ফিলিপের দুর্দ্ধর্ষ সৈন্যদল আলেকজান্ডারের আদেশ মানবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। ইতিহাস তাই বলে, আলেকজান্ডারের অসামান্য সাফল্যের জন্যে ফিলিপের প্রতিভার দাবি আছে যথেষ্ট। হয়তো ফিলিপের মতন পিতা না থাকলে আজ আলেকজান্ডারের দিগবিজয়ীর নাম কেউ জানত না।
পারস্যের সাম্রাজ্য তখন পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। অর্থবল ও সৈন্যবল তার অফুরন্ত। গ্রিসের পক্ষে তাকে-আক্রমণ করতে যাওয়া হচ্ছে হাতির সঙ্গে পিঁপড়ের যুদ্ধের মতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৪ অব্দে আলেকজান্ডার যখন সদলবলে দার্দানেলেসের দিকে অগ্রসর হলেন, গ্রিসের বুদ্ধিমানরা স্থির করলেন, আলেকজান্ডার কেবল গোঁয়ার নন, পাগলও।
কতখানি বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে আলেকজান্ডার গ্রিসের বাইরে পা বাড়াতে উদ্যত হলেন, সেটাও ভাববার কথা।
মাসিডন ছাড়া গ্রিসের আর সব রাষ্ট্রই অবাধ্য, মুখে তারা বাধ্যতার অভিনয় করছে মাত্র। আসলে তারা আলেকজেন্ডারকে ভয় করে। সে ভয় ভাঙলে,অর্থাৎ তিনি দেশ ত্যাগ করে সুদূরে গেলেই যে-কোনও মুহূর্তে আবার তারা অস্ত্রধারণ করতে পারে। এথেন্সের জনপ্রিয় বক্তা ডিমোসথেনেস আজ পর্যন্ত মাসিডন ও আলেকজান্ডারের বিষম শত্রু হয়েই আছেন। এমনকী, তিনি আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে সমস্ত গ্রিসকে উত্তেজিত করবার জন্যে পারস্যের কাছ থেকে নিয়মিতরূপে প্রচুর ঘুষের টাকাও গ্রহণ করেন। গ্রিস বিদ্রোহী হলে আলেকজান্ডারের সর্বনাশ।
আলেকজান্ডার যে এসব কথা ভেবে দেখেননি, তা বলা যায় না। কিন্তু উদ্দাম যৌবন চিরদিনই অগ্রগামী, যুক্তিকে ভক্তি করে না, এবং এই কারণেই চিরদিন অসম্ভবকে সম্ভব করে এসেছে।
গ্রিকরা যে আক্রমণ করতে আসছে, পারস্যের তা জানতে বাকি ছিল না। কিন্তু তৃতীয় দরায়ুস নামে পারস্যের যে নূতন সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করেছেন, রাজদণ্ড ধারণের যোগ্যতা তাঁর ছিল না। তাঁর চরিত্রমাধুর্য থাকলেও সম্রাট হিসাবে তিনি ছিলেন নগণ্য। যদি পূর্বপুরুষদের মতন থাকত তাঁর বুদ্ধি ও পুরুষত্ব, কখনওই সফল হত না আলেকজান্ডারের দিগবিজয়ের স্বপ্ন।
তৃতীয় দরায়ুসের অধীনে অনেক বেতনভোগী গ্রিক সৈন্য ও সেনানী ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মেমনন। পারস্য সম্রাটের উচিত ছিল, মেমননের হাতে কর্তৃত্ব ভার দেওয়া। কারণ, সৈন্য চালনায় ও সামরিক বুদ্ধি বিবেচনার জন্যে মেমননের খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। কিন্তু মেমননকে অগ্রাহ্য করে দরায়ুস যুদ্ধচালনার ভার দিলেন তাঁর প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপরে।
সমুদ্র পার হয়ে আলেকজান্ডার পদার্পণ করলেন এশিয়ার মাটিতে। তারপর প্রথমেই ছুটলেন তীর্থদর্শন করতে! সে তীর্থ হচ্ছে তাঁর প্রাণের কবি হোমারের অমর কাব্যে উল্লিখিত ট্রয় নগরের ধ্বংসাবশেষ। মহাভারতে উল্লিখিত কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ালে হিন্দুর চিত্ত যেমন অতীত স্মৃতির প্রভাবে অভিভূত হয়, প্রাচীন ট্রয়ের মাটির উপরে দাঁড়িয়ে আলেকজান্ডারেরও মনের অবস্থা হয়েছিল যে সেই রকম, এটুকু আমরা অনায়াসেই অনুমান করতে পারি। কারণ, বীরধর্মী গ্রিকদের কাছে হোমারের বীররসাত্মক অমর কাব্যের চেয়ে পবিত্র আর কিছুই নেই।
সেখানে ছিল মহাবীর অ্যাকিলিজের সমাধি—আলেকজান্ডার যাঁকে নিজের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করেন এবং যাঁর অপূর্ব বীরত্ব গাথা হোমার বিচিত্র ভাষায় বর্ণনা করেছেন। ভক্তিনত প্রাণে আলেকজান্ডার আগে করলেন বীরপূজা। তারপর নিজের পথে অগ্রসর হলেন।
খুব সম্ভব এই সময়েরই একটি গল্প আছে।
ফ্রাইগিয়া নামে এক প্রাচীন দেশ ছিল এশিয়া মাইনরে। তার বাসিন্দারা নানা কারণে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এমন সময়ে দৈববাণী হয়, জুপিটার দেবের মন্দিরের পথে প্রথম যে পথিকের দেখা পাবে, বাসিন্দারা তাকেই যদি রাজা করে তাহলে দূর হয়ে যাবে দেশের সব দুঃখ কষ্ট।
বাসিন্দারা পথের ধারে অপেক্ষা করতে লাগল।
সেপথে সর্বপ্রথমে গাড়ি চালিয়ে এল এক চাষা, নাম তার গর্ডিয়াস। বাসিন্দারা সেই অবাক চাষার মাথাতেই পরিয়ে দিলে রাজার মুকুট।
কৃতজ্ঞ চাষা তখন নিজের গাড়িখানিকে জুপিটার দেবের নামে উৎসর্গ করে মন্দিরের গায়ে বেঁধে রাখলে।
কিন্তু রাজা হয়েছিল বলেই গর্ডিয়াস আজ পর্যন্ত বিখ্যাত হয়ে নেই। মন্দিরের গায়ে গাড়ির রজ্জু এমন সুকৌশলে সে গ্রন্থি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল যে, দড়ির প্রান্ত কেউ খুঁজে পেত না, গ্রন্থিও কেউ খুলতে পারত না।
দৈববাণী শোনা গেল, এ গ্রন্থি যে খুলতে পারবে, সমগ্র এশিয়া হবে তার হস্তগত।
আলেকজান্ডারের যুগেও এ গল্পটি ছিল প্রাচীন। লোকের মুখে গল্পটি শুনে তিনিও গেলেন জুপিটারের মন্দিরে। কিন্তু গ্রন্থি এমন জটিল যে, তা খোলবার কৌশল মাথায় আনতে পারলেন না।
তখন খাপ থেকে তরোয়াল খুলে তিনি গ্রন্থির উপরে বসিয়ে দিলেন এক কোপ। গ্রন্থি কেটে দু-টুকরো।
গ্রন্থি খোলবার এই অতি সহজ উপায় দেখে সকলেই চমৎকৃত। চারিদিকে রটে গেল—আলেকজান্ডার গর্ডিয়াসের গ্রন্থি খুলেছেন, নিশ্চয়ই তিনি হবেন এশিয়া-বিজয়ী!
ইংরেজি অভিধান খুললে আজও দেখা যাবে Gordian Knot নামে কথাটি।
গ্রানিকাস একটি নদীর নাম, সে গিয়ে পড়েছে মর্মরসাগরে। আলেকজান্ডার নদীর একপারে সসৈন্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই হচ্ছে এশিয়ায় প্রবেশ করার প্রথম ও প্রধান পথ।
নদীর ওপারে পারস্য-সৈনিকদের নিয়ে শিবির স্থাপন করেছেন প্রাদেশিক শাসন-কর্তারা।
গ্রানিকাসের স্রোতের বেগ দেখে আলেকজান্ডারের সৈন্যাধ্যক্ষরা রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়লেন। এ নদী পার হওয়া সহজ কথা নয়।
ফিলিপের মতন আলেকজান্ডারেরও প্রধান সেনাপতি ছিলেন প্রবীণ পার্মেনিয়ো। তিনিও বললেন, ‘রাজা, এখন নদী পার হবার চেষ্টা করবেন না। ওপারে তাকিয়ে দেখুন, বেতনভোগী গ্রিক সৈনিকদের সঙ্গে পারসিকরা কীরকম সুরক্ষিত জায়গায় ব্যূহ রচনা করেছে। এখন ওদের আক্রমণ করা নিরাপদ নয়।’
কিন্তু কোথায় রাজা? তিনি তখন তেরোজন মাত্র অশ্বারোহী সৈনিক সঙ্গে নিয়ে নদীর মধ্যে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন!
তিনি জানতেন, নদীর খরস্রোতও তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে তুচ্ছ—চিরশত্রু পারস্যের সঙ্গে এই প্রথম শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পেয়ে আলেকজান্ডার আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে রাজি নন। সাবধানতা? সাবধান হোক বুড়োরা—’যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?’
তিনি জানতেন, তাঁর সুশিক্ষিত গ্রিক সৈনিকদের ঘনব্যূহের ধাক্কা সামলাতে পারে, পারসিদের এমন শক্তি নেই।
রাজাকে অগ্রসর হতে দেখে সমস্ত গ্রিক সৈন্য মরিয়ার মতন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আলেকজান্ডার সর্বাগ্রে ওপারে গিয়ে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে পারসিরাও আক্রমণ করলে। আরম্ভ হয়ে গেল লড়াই—দুই পক্ষেরই কতক সৈন্য জলে এবং কতক সৈন্য স্থলে।
ভাগ্যে আলেকজান্ডার সেদিন প্রিয় ঘোড়া ষণ্ডমুণ্ডকে এই বিপদের মধ্যে টেনে আনেননি! কারণ, শত্রুদের আক্রমণে তাঁর ঘোড়া মারা পড়ল। দুইজন পারসি সেনাপতি একসঙ্গে তাঁর উপরে অস্ত্রচালনা করলেন, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য!
ক্লিটাস ছিলেন আলেকজান্ডারের বন্ধু, কোথা থেকে তিনি বেগে ছুটে এসে পারসি সেনাপতিদের কবল থেকে তাঁকে উদ্ধার করলেন।
ওদিকে দেখতে দেখতে গ্রিক সাদী-সৈনিকদের প্রচণ্ড আক্রমণে পারসিদের প্রথম দল ভেঙে গেল। তখন এল ফিলিপের হাতে তৈরি ঘনব্যূহের কৃতিত্ব দেখাবার সময়!
উচ্চভূমিতে যে সুশিক্ষিত বেতনভোগী গ্রিকরক্ষী সৈন্যদল অপেক্ষা করছিল, পারসিরা তখনও তাদের কাজে লাগায়নি।
আলেকজান্ডার প্রবীণ সৈন্যচালকের মতন আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যে, শত্রুরা তাদের সাদী-সৈন্যদের, আক্রমণের জন্যে নয়—আত্মরক্ষার জন্যে সজ্জিত করে রেখেছে। প্রথমেই তিনি শত্রুদের এই ভ্রমের সুযোগ গ্রহণ করলেন।
আলেকজান্ডারের হুকুমে তাঁর সৈন্যরা শত্রুদের বামপার্শ্বভাগ আক্রমণের ভান করলে এবং শত্রুরাও সেই ছলনায় ভুলে সেইদিকে রক্ষা করার জন্যে অগ্রসর হতেই মধ্যভাগ দুর্বল হয়ে পড়ল।
আলেকজান্ডার চিৎকার করে বললেন, ‘ঘনব্যূহের সৈনিকগণ, আক্রমণ করো—আক্রমণ করো! সর্বাগ্রে আক্রমণ করো শত্রুপক্ষের পেশাদার গ্রিকদের! তারা দেশদ্রোহী! তাদের একজনকেও ক্ষমা কোরো না!’
ভয়াবহ ঘনব্যূহ! এরকম আক্রমণ ছিল পারসিদের ধারণাতীত! তারা চারিদিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। এতক্ষণ পরে বিপদ বুঝে পারসি সাদী-সৈন্যরা ঘোড়া ছুটিয়ে বাধা দিতে এল বটে, কিন্তু সুসময় উতরে গিয়েছে—তাদের সমস্ত বাধা দেবার চেষ্টা ব্যর্থ হল।
দশ হাজার পদাতিক ও দুই হাজার সাদী-সৈন্যের মৃতদেহ রণক্ষেত্রে ফেলে পারসিরা পালিয়ে গেল। হাজার হাজার লোক বন্দি হল। বেতনভোগী গ্রিক সৈন্যদের প্রায় সকলেই মারা পড়ল। আলেকজান্ডারের জয়!
এই যুদ্ধের ফলে আলেকজান্ডার এশিয়া মাইনরের অনেকখানি জায়গা দখল করে ফেললেন।
পারসি সৈনিকদের তিনশোখানা ঢাল আর বহু সামগ্রী উপহার স্বরূপ স্বদেশে পাঠিয়ে আলেকজান্ডার সগর্বে এই পত্রখানি লিখলেন—’স্পার্টা ছাড়া গ্রিসের আর সকলের কাছেই এইসব ভেট পাঠাচ্ছি—এগুলি হচ্ছে, এশিয়াবাসী বর্বরদের সম্পত্তি। আমি ফিলিপের ছেলে আলেকজান্ডার!’
এই ছোট্ট চিঠিখানির ভিতরে তীক্ষ্ণবুদ্ধি আলেকজান্ডার যথেষ্ট রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমত, এথেন্সের বক্তা ডিমোসথেনেস যে ফিলিপকে হেয় প্রমাণিত করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টার ত্রুটি করেননি, আলেকজান্ডার সদর্পে নিজেকে পরিচিত করতে চেয়েছেন তাঁর পুত্ররূপে। দ্বিতীয়ত, কৌলীন্যগর্বিত স্পার্টা মাসিডনের প্রাধান্য স্বীকার করতে নারাজ, তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে এই বিজয়গৌরব থেকে। তৃতীয়ত, যে ‘বর্বর’ (যে-কোনও বিদেশিকে গ্রিকরা এই নামে ডাকত) শব্দ গ্রিকরা মাসিডনের বাসিন্দাদের উপরে প্রয়োগ করত, তাই প্রয়োগ করা হয়েছে পারসিদের উপরে। অর্থাৎ গ্রিকদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মাসিডনবাসীরা বর্বর বা বিদেশি নয়, তারাও সত্যিকার গ্রিক এবং আসল বর্বর হচ্ছে গ্রিকদের শত্রু পারসিরাই।
একসঙ্গে যুদ্ধ ও রাজনীতি ব্যবসায়ীরূপে আলেকজান্ডার আরও নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন। যেসব শহর ও দেশ তাঁর অধীনতা স্বীকার করেছিল, সেখানে প্রজাদের হিতকর অনেক নব নব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। পারসিদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে ওইসমস্ত জায়গায় বাসিন্দারা হয়ে পড়ল তাঁর পরম বন্ধু।
জলপথে পারসিরা ছিল গ্রিকদের চেয়ে ঢের বেশি প্রবল। আলেকজান্ডার তাই জলযুদ্ধে কোনওরকম শক্তি পরীক্ষার চেষ্টা না করে স্থলপথেই পারস্য সাম্রাজ্যের ভিতরদিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।
তাঁকে খুব বেশিদূর এগুতে হল না। কারণ, পারসিরা এইবার বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলে।