» » চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

চন্দন

‘ওপিয়াম’! কলকাতার কলেজ ফেস্টিভাল সার্কিটের অন্যতম জনপ্রিয় নাম। গোটা শীতকাল জুড়ে বিভিন্ন কলেজে চলতে থাকে ‘ফেস্ট’। ইন্টার-কলেজ কম্পিটিশান আর গেস্ট পারফরম্যান্সের মোহে বিভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়েরা হাজির হয় ফেস্টে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ফেস্ট ভীষণ জনপ্রিয়। ডিসেম্বরের শেষ তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। রোজই বেশি রাতে অতিথি শিল্পীর অনুষ্ঠান থাকে। শেষ দিনে থাকে ‘বিশেষ’ গেস্ট পারফরম্যান্স। যাকে বলা হয়, ‘কালচারাল এক্সট্রাভ্যাগানজা’। ফেস্ট সার্কিটের ছেলেপুলেরা আদর করে বলে, ‘এক্সট্রা ভ্যাজাইনা’।

সিনিয়রদের মুখে চন্দন শুনেছে, অতীতে কলেজ ফেস্ট ছিল আয়তনে ছোট, কিন্তু ট্যালেন্টের বীজতলা। আজকের যত নামকরা সাংবাদিক, সম্পাদক, ফিল্ম মেকার, লেখক, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, মঞ্চ ও চিত্র জগতের অভিনেতা, বিজ্ঞাপন জগতের নামিদামি লোক—তারা সবাই বড় হয়েছেন ফেস্ট করে। বাংলা ব্যান্ডের প্রধান নামগুলির প্রতিটি সদস্য ফেস্ট সার্কিটে গান গাইতেন। তখন অনুষ্ঠানের রকম ছিল অন্য। একদিকে হতো গানের কম্পিটিশান। রবীন্দ্রসঙ্গীত আলাদা গুরুত্ব পেত। এ ছাড়া ইস্টার্ন সোলো, ওয়েস্টার্ন সোলো, ইস্টার্ন সেমি-ক্লাসিকাল, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল—এইরকম ভাগ থাকত। থাকত কোলাজ, এক্সটেমপোর স্পিচ, ‘জাস্ট আ মোমেন্ট’ বা ‘জ্যাম’, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, পেন্টিং, ক্যাপশান রাইটিং, ওয়ান অ্যাক্ট প্লে, একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা। সবাইকে যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য থাকত ‘পারপেন্ডিকুলার রাউন্ড’ বা ‘পার্পস’। যেখানে বেলুন ফোলানো, পাঞ্জা-লড়া, অন্ত্যাক্ষরী এইসব হতো। ক্যুইজ, ডাম শ্যারাড, ক্যাও ক্যুইজ এবং ট্রেজার হান্ট ছিল স্টার অ্যাট্রাকশান। তখন স্পনসর ছিল কম। প্রাইজ মানি নগন্য। কলেজ স্টুডেন্টদের আগ্রহে ফেস্ট ফেটে পড়ত।

এখন পরিস্থিতি অন্য। কোল্ড ড্রিংক কোম্পানি, বাইক কোম্পানি, ইয়াং অ্যাডাল্ট ম্যাগাজিন, ইংরিজি কাগজের মেট্রো সেকশান—সবাই ফেস্ট স্পনসর করতে আগ্রহী। এখন টাকা জোগাড় করা সুলভ। ছাত্রছাত্রীদের ইনভলভমেন্ট কম। সবাই গিটার কাঁধে নিয়ে ঘোরে আর রক সঙ্গীত গায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কম্পিটিশান বাতিল হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাতিল, বাংলা সেমি-ক্লাসিকাল বাতিল, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল বাতিল। পেন্টিং, ক্রিয়েটিভ রাইটিং বাতিল। একাঙ্ক নাটক বাতিল। ওসব করার লোক পাওয়া যায় না। যা কিছু ভারনাকুলার, যা কিছু বাংলা—তা বাতিল। যা কিছু করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন, সময়ের প্রয়োজন—তা বাতিল। এখন খুব পপুলার প্রোগ্রাম হল ফোটোগ্রাফি কন্টেস্ট। টিনটিন একটা ভালো কথা বলেছে। ‘এক সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ”এত কবি কেন?” তিনি বেঁচে থাকলে নতুন শতকে বলতেন, ”এত বাংলা ব্যান্ড কেন?” আর এই শতকের দ্বিতীয় দশকে বলতেন, ”এত ফোটোগ্রাফার কেন?” মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসার পরে, ডিজিট্যাল ক্যামেরা সস্তা হওয়ার পরে, ফোটো এডিটিং করা সহজ হওয়ার পরে—সব্বাই প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার।’

ফেস্ট অ্যাটেন্ড করা একদল ছেলেপুলে সব কলেজেই থাকে। এরা দিনরাত ক্যান্টিনে বসে ডাম শ্যারাড, অন্ত্যাক্ষরী আর জ্যাম প্র্যাকটিস করে। ক্যুইজ-পাগলারা দিনরাত বই, খবরের কাগজ আর কম্পিউটারে মাথা গুঁজে বসে থাকে। এদের বাদ দিলে ডেডিকেটেড ফেস্ট পাবলিকের সংখ্যা আগের থেকে কম। রাতের গেস্ট পারফরম্যান্স হাউসফুল হয়। সেগুলো মূলত বাংলা ব্যান্ড বা হিন্দি সিনেমার গানের অনুষ্ঠান।

বাৎসরিক তিনদিনের মোচ্ছব সফলভাবে উতরে দেওয়ার জন্য কলেজের একদল ছেলেমেয়ে বছরের ছ’মাস প্রাণপাত করে। কারণ এর সঙ্গে কলেজের সুনাম যুক্ত। ইউনিয়নের সম্মান যুক্ত। কালচারাল সেক্রেটারি ও জেনেরাল সেক্রেটারির সুনাম যুক্ত। টিনটিন আর রিপুর ‘ইজ্জত কা সওয়াল’ বলে কথা।

ওপিয়ামের মিটিং অ্যাটেন্ড করে চন্দন বুঝেছে, এই দক্ষযজ্ঞ কন্ডাক্ট করার জন্য দু’শ্রেণির ছেলে লাগে। একদল প্ল্যান করে। আর একদল ইমপ্লিমেন্ট করে। প্ল্যানিং-এর দায়িত্ব থাকে সিনিয়ররা। সেটা স্বাভাবিক, কেন না দু’তিনটে ফেস্ট হাতে কলমে উতরে না দিলে প্ল্যানার হওয়া যায় না। ইমপ্লিমেন্টেশান মানে গাধার খাটুনি। বিভিন্ন সাব-কমিটির সদস্য হয়ে, বুকে ব্যাজ লাগিয়ে দৌড়ে বেড়ান। এই কাজটা করে ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ার। তবে এখানে একটা সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা আছে। কলকাতার ছেলেমেয়েদের দেওয়া হয় রিসেপশানে সামলানোর কাজ, কম্পিটিশানের ‘এমসি’ বা ‘মাস্টার অব সেরিমনি’ হওয়ার কাজ, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব। কেন না তারা চৌখশ, স্ট্রিট-স্মার্ট, বাংলা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরিজিতে পারদর্শী। মফস্বল ও গ্রামের ছেলেমেয়েরা হেঁসেল সামলায়, হিসেব রাখে, বাজার করে। তারা ব্যাকস্টেজ ওয়ার্কার।

ব্যাকস্টেজ ওয়ার্কার যদি হতে হয়, তাহলে এক নম্বর ব্যাকস্টেজ ওয়ার্কার হওয়াই ভালো। রিপুকে পটিয়ে পাটিয়ে একশো পঁচিশে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার ইনস্টল করিয়েছে চন্দন। সঙ্গে ইন্টারনেট কানেকশান আর প্রিন্টার-কপিয়ার-স্ক্যানার। ইউনিয়নের টাকায় কেনা ইউনিয়নের সম্পত্তি। স্যামিলটন ইস্কুলে একটা কম্পিউটার নিয়ে কুড়িজনের সঙ্গে মারামারি করতে হতো। সেই মেছো বাজারে প্রয়োজনীয় অপারেশানগুলো রপ্ত করে হাত পাকিয়েয়েছিল চন্দন। এই ডেস্কটপে নিয়মিত কাজ করে হাত সেট করে ফেলল। একদিন মিটিং-এর মধ্যে রিপুর হাতে তুলে দিল বিভিন্ন কমিটি ও সাবকমিটির ছেলেমেয়ের নাম ও মোবাইল নম্বর। কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া আছে, সেই দায়িত্ব কত তারিখের মধ্যে পালন করতে হবে, কাকে রিপোর্টিং করতে হবে, কাজে ফেইল করলে ‘প্ল্যান বি’ কী হবে।

দশ পাতার প্রিন্ট আউট দেখে রিপু হাঁ। সবার সামনে চন্দনের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘যা ফ্লো চার্ট বানিয়েছ গুরু, গাধারাও ফেস্ট উতরে দেবে।’

কালচারাল সেক্রেটারি টিনটিন কাজের ঢিলেঢালা গতি নিয়ে রোজ মিটিংয়ে সবাইকে খিস্তি করে। চন্দনের তৈরি করা ‘হাউ টু অর্গানাইজ আ ফেস্ট’ কর্মসূচী দেখে বলল, ‘এটা তুই নিজে বানালি? না নেট থেকে নামালি?’

‘নিজে বানালাম।’

‘এত ডিটেলে সবকিছু জানলি কী করে? এর আগে তো একটা ফেস্টও অ্যাটেন্ড করিসনি।’

‘ইউনিয়ন রুমে গত দশ বছরের ওপিয়ামের ফাইল জমিয়ে রাখা আছে। ধুলো ঝেড়ে ফাইলগুলো পড়ছিলাম। মিটিং-এর মিনিট পড়লে বোঝা যায় প্রতি বছর প্রবলেমের প্যার্টানগুলো এক। আমি সেই প্রবলেমগুলোকে অ্যাড্রেস করেছি।’

‘আমাকে এক কপি দে তো!’ চন্দনের দিকে হাত বাড়ায় টিনটিন। চন্দন বলে, ইউনিয়নের সব সদস্যদের আর ওপিয়ামের বিভিন্ন কমিটিতে যতজন সদস্য আছে, সবাইকে আমি এই অ্যাটাচমেন্টটা মেল করে দিয়েছি। নিজেরা ডাউনলোড করে প্রিন্ট নিও। এই প্রিন্টারের কার্ট্রিজে কালি কম আছে।’

‘আমাকে প্রিন্ট আউট দিবি না?’ ফুঁসে ওঠে টিনটিন। ‘ফার্স্ট ইয়ারের ছোকরা, আমার সঙ্গে রোয়াবি হচ্ছে?’

‘আহ! টিনটিন!’ রিপু থামায় কালচারাল সেক্রেটারিকে, ‘এখন বাওয়াল দেওয়ার সময় নয়। প্রিন্টারে সত্যিই কালি নেই। মিটিং-এর পরে আমরা এই প্রিন্ট আউট থেকে ফোটোকপি করে নেব। তুই এখন বল, প্রথম দিন গেস্ট পারফম্যান্স কাকে দিয়ে করাবি?’

‘প্রথম দিন কোনও বাংলা নাটক-ফাটক রাখো। কম পয়সায় উতরে যাবে।’ ক্যাজুয়ালি বলে টিনটিন।

‘না না। নাটকের লোকগুলো খুব ঢ্যাঁঠা হয়। স্টেজে উঠে ইমপ্রমচু অ্যান্টি-গভর্নমেন্ট কিছু বলে দিলে বাওয়াল হয়ে যাবে। অন্য কিছু ভাব।’ আপত্তি করে রিপু, ‘গ্রুপ থিয়েটারের লোকগুলো এখন ব্যাপক ঢ্যামনা হয়ে গেছে। কম টাকায় কাজ তো করবেই না, উলটে স্টারসুলভ ‘অ্যাটি’ দেখিয়ে ফেস্টে এসে সন্দীপ সামন্ত আর জনমোর্চাকে হাম্পু দিয়ে চলে যাবে। তখন অধীর হালদার জেলা কমিটিতে ডেকে প্যান্টুল খুলে নেবে।’

‘অধীর হালদার কে?’ জানতে চায় চন্দন।

‘তোর অত জানার কী দরকার?’ টিনটিন দাবড়ানি দেয় চন্দনকে। চন্দন বিরক্ত হয়ে বলে, ‘মিটিং-এর মধ্যে কোনও কথা বললে, সেটা এক্সপ্লেনও করতে হয়। যাক গে যাক। বাদ দাও। আমার একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না। কোনও নাটকের দল অ্যান্টি-গভর্নমেন্ট কথাবার্তা বললে আমাদের কী? আমরা কি গভর্নমেন্টের ঠিকাদারি নিয়ে রেখেছি নাকি?’

‘অ্যাই! তুই চুপ!’ চন্দনকে আবার শাসায় টিনটিন। রিপুকে বলে, ‘তাহলে আমি একটা ডিজে ধরে আনি। সস্তায় পুষ্টিকর। হাজার দশেক টাকায় নাচাগানা হয়ে যাবে।’

‘গুড! এই তো! আমাদের কালচারাল সেক্রেটারির মাথা খেলছে।’ টিনটিনের পিঠ চাপড়ে দেয় সুব্রত। বান্টি বলে, ‘সেকেন্ড ডে তে কী রাখবি? বাংলা ব্যান্ড?’

‘বাংলা ব্যান্ড শেষ দিনে। এখন ব্যান্ডগুলোর হেবি ভাও হয়েছে। লাখের নিচে কথা বলছে না কেউ।’ বিরিক্ত মুখে বলে টিনটিন, ‘ ”চন্দ্রভানু” এক লাখ পনেরো চাইছে। প্লাস এসি গাড়িতে যাতায়াত এবং যন্ত্রপাতির জন্য পিকআপ ভ্যান। ”জীবাশ্ম” বলছে দেড়লাখ। সব ইনক্লুসিভ। ‘ফণীমনসা’-র ফ্রন্টম্যান ডাক্তার। মেডিক্যাল কলেজের ফেস্টে ডাকলেই আসে। ছেলেটার প্রাণে মায়াদয়াও আছে। এক লাখে রাজি হয়েছে। তবে ওদের গ্রুপের মেম্বারদের মধ্যে এত ঝগড়া যে ডাকতে ভরসা হয় না। ”পিপুফিশু” আর ”আততায়ী”ও অনেক টাকা চাইছে।’

‘সঞ্চারী সেনকে ডাকলে হয় না?’ পরামর্শ দেয় চন্দন, ‘উনি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। শুনেছি রেমুনারেশানও বেশি নয়।’

‘কলেজ ফেস্টে রবীন্দ্রসঙ্গীত? চাষাটাকে তাড়াও রিপুদা।’ শ্রাগ করে টিনটিন। ‘এর কথা শুনলে ভোটে হার গ্যারান্টিড।’

‘ওর কথা ছাড়। তুই বল।’ রিপু টিনটিনকে বলে।

‘আমার মনে হয় সেকেন্ড ডে-তে ফ্যাশন শো করা যেতে পারে। আমাদের বন্ডেল রোডে ”ওম” নামের একটা বুটিক খুলেছে। ওরা শুধু কলেজ স্টুডেন্টদের ক্যাটার করে। বোথ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। জামা-কাপড়, অ্যাক্সেসারি, এনার্জি ড্রিংক, বই, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ঠেক। ওদের বললে কম খরচে একটা শো নামিয়ে দেবে।’ মতামত জানায় টিনটিন। সুব্রত আর আর বান্টি টিনটিনের পিঠ চাপড়ে বলে, ‘ব্রাভো গুরু! হেব্বি আইডিয়া।’ রিপু চন্দনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী রে? আইডিয়াটা কেমন?’

‘আমি চাষার ছেলে। ফ্যাশান এখনো বুঝি না। তবে এইটা বুঝি যে একটা কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপন করার জন্য ওপিয়ামের স্টেজ ব্যবহার করবে। সেক্ষেত্রে আমরা কোনও টাকা দেব না। কম বা বেশি কোনো খরচই আমরা করব না। খরচ করবে ওম।’ চন্দন ঠান্ডা মাথায় বক্তব্য রাখে।

তার কথার প্রতিক্রিয়ায় বান্টি বলে, ”ফ্যাশান এখনও বুঝি না’ কথাটার মানে কী? ”এখনও” বলতে কী বোঝাচ্ছিস?’

‘সব জিনিস শিখতে সময় লাগে। আমি গ্রামের ছেলে। মাজরা পোকা বুঝি। ইউরিয়া বুঝি। ”ওস্তাদ” বিষ বুঝি। শ্যালো বুঝি। ওটা তোমরা বোঝো না। আমাদের বাড়িতে বছর খানেক থাকলেই বুঝবে। তেমনই, আমি বছর খানেক কলকাতায় থাকলেই ফ্যাশন বুঝব। সোজা কথা।’ ফতুয়ার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে টিনটিনকে অফার করে চন্দন, ‘খাও। রাগ কোরো না।’

টিনটিনের মুখ লাল। রাগে সে এবার ফেটে পড়বে। সিগারেট না নিয়ে বলল, ‘তোর কী মনে হয়? আমি কাট মানি খাব?’

‘আমার তা মনে হয় না,’ সিগারেট ধরিয়ে বলে চন্দন, ‘আমার মনে হয় সাপ্লাই-ডিম্যান্ডের তত্ত্বটা তুমি বুঝতে পারোনি। ওমের মালিককে বলো যে, ”এক ঘণ্টার জন্য ওপিয়ামের স্টেজ দেব। আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। তুই এলে আয়। আমাদের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানসে রাজি না হলে, ওমের বদলে বোম, লোম বা যম আসবে।” দেখো, ঠিক রাজি হয়ে যাবে।’

‘তা হলে সেকেন্ড ডে-তে ফ্যাশন শো ফাইনাল।’ চন্দনকে থামায় রিপু, ‘টিনটিন, তুই ওমের মালিকের সঙ্গে কথা বল। পঞ্চাশ হাজার না হলেও চলবে। তিরিশের নীচে নামিস না। থার্ড ডেতে কাকে ডাকছিস বল।’

‘কলকাতার প্রধান পাঁচটা রকব্যান্ড গত পাঁচ বছরে পারফর্ম করেছে। চন্দ্রভানু, জীবাশ্ম, ফণীমনসা, পিপুফিশু, আততায়ী—সব্বাই। এবার নতুন কাউকে ডাকব? না ওদেরই?’ বান্টি আর সুব্রতর মতামত চায় টিনটিন।

তারা কিছু বলার আগে চন্দন বলে, ‘মাটি নামে যে ফোক ব্যান্ড আছে, ওদের ডাকো না।’

‘ফোক সঙের তুই কী বুঝিস?’ টিনটিন দাবড়ানি দেয় চন্দনকে।

‘তোমার থেকে বেশি বুঝি। বাউল, দরবেশ, সুফি, ভাটিয়ালি, আগমনী গান এখনও গ্রামে শোনা যায়। তোমরা যা সিডিতে শোনো, আমরা, চাষারা সেটা লাইভ শুনি। দোতারা বা গুপিযন্ত্র বা খঞ্জনি বাজিয়ে যে গান গাওয়া হয়, সেই গানকে ধুমধাড়াক্কা বাজনার সঙ্গে মিশিয়ে চচ্চড়ি বানিয়ে ”মাটি” তোমাদের শোনাচ্ছে। পাবলিক ভালোই খাচ্ছে। ‘মাটিকে ডাকো।’ রিপুর দিকে তাকিয়ে বলে চন্দন।

‘আইডিয়াটা খারাপ নয়।’ রিপু টিনটিনকে বলে, ‘মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। আমার সঙ্গে আলাপ নেই। এই সুযোগে আলাপটা করলে হয়।’

টিনটিন মাথা নিচু করে ভাবছিল। টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘তুমি তাহলে ওদের সঙ্গে কথা বলো। আমিও ”আরবান স্কাউন্ড্রেল”দের সঙ্গে কথা বলছি। ওরা পাঁচ বছর আগে লাস্ট এসেছিল। নতুনরা ওদের পারফরম্যান্স দেখেনি। যে কম টাকায় রাজি হবে তাকে ডাকা হবে।’

‘ঠিক হ্যায়! তাহলে এখন মিটিং শেষ। কাল আবার আমরা রাত দশটার সময়ে এখানে মিট করছি।’ খাট থেকে উঠে বলে রিপু।

চন্দন বলে, ‘কালকের মিটিং-টা অন্য ঘরে করো। ফেস্টের পরেই আমাদের ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা। এখন থেকে পড়তে না বসলে ফেল করব।’

‘ওকে ওকে!’ সহৃদয় গলায় বলে রিপু, ‘কালকের মিটিংটা টিনটিনের ঘরে হবে। একশো চব্বিশ।’

টিনটিন রাগত চোখে চন্দনকে মাপল। অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, ‘আচ্ছা।’ তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। টিনটিনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল বান্টি, সুব্রত এবং বাকিরা। ঘরে এখন রিপু আর চন্দন। ফিকফিক করে হেসে রিপু বলল, ‘তুই শালা খুব হারামি আছিস।’

‘ঠিক বলেছ।’ হাই তুলে বলল চন্দন।

‘অ্যাঁ? তুই জানিস যে তুই হারামি?’ রিপু অবাক।

‘জানি।’ বারমুডার ওপরে প্যান্ট গলাচ্ছে চন্দন। ‘কতটা হারামি এটা এখনও জানি না।’

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘লেডি আর্চার্স হোস্টেলে।’

‘এত রাতে?’

‘বৃন্দার কাছ থেকে কতগুলো নোটস নেব। গতকাল আর আজ ফিজিওলজির থিয়োরি ক্লাস করিনি। পার্বতী ম্যাডাম দু’দিনে অ্যানিমিয়ার ক্লাসিফিকেশান পড়িয়ে দিয়েছেন। সবাই বলছে, ওটা ম্যাডামের ফেভারিট চ্যাপ্টার। ভাইভায় ধরবেই।’

‘অ্যানিমিয়া বুঝতে সারা জীবন লাগে। দু’দিনের নোটস পড়ে ঘোড়ার ডিম বুঝবি। আমার বক্তব্য সেটা নয়। নোটসটাই আসল উদ্দেশ্য, না বৃন্দার সঙ্গে ঝাড়ি মারার প্ল্যান করছিস?’

‘বামনের চন্দ্রভিলাষ কি খারাপ?’

‘উরিততারা! কী টাফ বাংলা বলছিস মাইরি!’ হাসতে হাসতে কানে আইপডের ইয়ারপড গোঁজে রিপু। শার্ট গলিয়ে চন্দন একশো পঁচিশ থেকে বেরোয়। বয়েজ হোস্টেলের চারতলা থেকে তরতরিয়ে নেমে, অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং আর এলএলটির মাঝখানের গলতা দিয়ে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গেটে পৌঁছয়। সবুজ গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ফুলমতিয়াকে বলে, ‘রুম নাম্বার থার্টিনের বৃন্দাকে বলো, চন্দন এসেছে।’

ফুলমতিয়ার বেশ ডাঁটো চেহারা। উত্তর ভারতীয়দের কায়দায় ডানদিকে শাড়ির আঁচল। শাড়ির ঝুল হাঁটু আর গোড়ালির মাঝামাঝি। পায়ে রূপোর মল পরা। কপালে আর চিবুকে উল্কি করা। দু’হাত ভরতি সিটি গোল্ডের চুড়ি। চোখের পাতায় মোটা করে কাজল ল্যাপা। মাথার চুল দু’বিনুনি করে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। কুটকুট করে পানমশলা চিবোতে চিবোতে বছর চল্লিশের ফুলমতিয়া বলল, ‘দিনের বেলা দরকার মিটাতে পারো না? সব দরকার রাতে?’

‘সব দরকার না। একটাই দরকার। তুমি ডেকে দাও।’ সিগারেট ধরিয়ে বলে চন্দন।

ঠোঁট উল্টে ফুলমতিয়া বলে, ‘সে তেরো নম্বরে পার্টি করছে। ওই চুড়েইল ঘরের দিকে আমি যাব না। তুমি মোবাইলে ডেকে নাও।’

বিরক্ত হয়ে চন্দন বলে, ‘ওফ! ভূত ভূত করেই তোমরা গেলে।’ তারপর বৃন্দাকে ফোন করল। দু-তিনবার রিং হওয়ার পরে বৃন্দা ধরে বলল, ‘বল।’

‘আমি গেস্টরুমে। তুই আজকের ফিজিয়োলজির ক্লাস নোটস নিয়ে একবার নীচে আয়।’

‘উফফ! আমি এখন নামতে পারব না। আমাদের রুমে এক্ষুনি পাজামা পার্টি শুরু হবে।’

‘কী পার্টি?’

‘পাজামা পার্টি। এটা একটা অল গার্লস পার্টি। ছেলেরা নট অ্যালাওড। আমরা সাজুগুজু না করে ক্যাজ থাকি।’

‘শালা, নতুনগ্রাম থেকে কলকাতায় না এলে জানতেই পারতাম না যে পাজামা পার্টি নামে এক ধরনের পার্টি হয়।’

‘ধুস! ওটা একটা নাম। দিতে হয় তাই দেওয়া। রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার আগে আমি, দিঠি, সাবিনা, জেমসি, শ্রীপর্ণা আর আপ্পুদি মিলে ভদকা খাব।’

‘তোরা মদ খাবি? মদ তো বাজে মেয়েরা খায়!’

‘বাজে মেয়ে মদ খায়। আমি থাকি ভদকায়,’ ছড়া কেটে খিকখিক করে হাসে বৃন্দা। বলে, ‘তুই মোবাইলে আর বকাস না। আমি আসছি।’

লাইন কেটে দিল বৃন্দা। দু’মিনিটের মধ্যে নেমে এসে বলল, ‘গেস্টরুমে আয়। ভালোই ঠান্ডা পড়েছে।’

ডিসেম্বর মাসের আজ ছ’তারিখ। সোমবার। এখনও শীত পড়েনি। বৃন্দা জিনস আর টপের ওপরে একটা সুতির চাদর জড়িয়ে আছে। চাদর থেকে লেবুলেবু গন্ধ আসছে। এই গন্ধটা পেলে চন্দন নিজেকে আর সামলাতে পারে না। দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে শাহরুখ খানের কায়দায় ছুটতে ইচ্ছে করে। ম্যানহ্যাটানের রাস্তা দিয়ে স্লো-মো দৌড়ের শেষে প্রীতি জিন্টা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গালে টোল ফেলা হাসি।

বৃন্দা গালে টোল ফেলে হাসল। বলল, ‘পিএমের ক্লাসে এলি না কেন? প্রবাল তোর প্রক্সি দিয়েছে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’

‘ফিজিওলজি আমি ম্যানেজ করে ফেলব। বায়োকেমিস্ট্রিও। কিন্তু অ্যানাটমিটা কিছুতেই সামলাতে পারছি না। নাম মুখস্থ করতে করতে জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস বাঙ্ক করে অ্যানাটমি পড়ছিলাম।’ সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলে চন্দন।

‘ওই করতে গিয়ে শেষে ফিজিওলজিতেই সাপ্লি খাবি। এই নে, তোর নোটস।’

একতাড়া কাগজ নিয়ে চন্দন বলে, ‘তুই হোস্টেলে থাকা কবে থেকে শুরু করলি?’

‘গত সপ্তাহ থেকে। আপ্পুদি একদিন ধরে বেঁধে এনে আমাকে আর দিঠিকে একটা করে বেড অ্যালট করে দিল। রুম নাম্বার থার্টিন। আনলাকি রুম। ওই ঘরেই নাকি লেডি আর্চার মার্ডার হয়েছিলেন। মেমপেত্নীর ভয়ে ওই ঘরে কেউ থাকে না।’ নিকোটিনের গন্ধওয়ালা ধোঁয়া নাক থেকে তাড়িয়ে বলে বৃন্দা।

‘তোর ভয় করল না?’ লেবুগন্ধের অক্সিজেন নাকে টেনে প্রশ্ন করে চন্দন।

‘আমি শুধু সোমবার রাতগুলোয় থাকছি। টোকেন প্রেজেন্স। মঙ্গলবার সকালের বায়োকেমিস্ট্রি থিয়োরি ক্লাসটা ন’টা থেকে। ওটা মিস করলে আরতি ম্যাডাম বিশাল ঝামেলা করে। তাছাড়া আপ্পুদি ওপিয়ামের জন্য অ্যাড তোলার দায়িত্ব দিয়েছে। মিডিয়া পার্টনারও জোগাড় করতে হচ্ছে। এইগুলো সোমবার সেকেন্ড হাফে করছি। হোস্টেলে থাকার জন্য অজুহাত লাগে তো! এগুলো আসলে অজুহাত।’ চন্দনের হাত ধরে টেনে গেস্টরুমে ঢোকায় বৃন্দা, ‘ভেতরে আয়, বাইরে হিম পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।’

‘ভ্যাট! ঠান্ডার নামগন্ধ নেই। তুই খুব শীতকাতুরে আছিস মাইরি।’ সোফায় বসে বলে চন্দন। এদিক ওদিক দেখে পোড়া ফিল্টার ছুঁড়ে মারে গেস্টরুমের কোণে।

‘তা আছি।’ সামনের সোফায় গুটিশুটি মেরে বসে বলে বৃন্দা।

‘অ্যাড তুলতে কোথায় কোথায় গেলি?’

‘মিডিয়া পার্টনার জোগাড় করতে খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলের অফিসে যাওয়াটা খুব ইন্টারেস্টিং। অনেক সেলিব্রিটি দেখা যায়। অ্যাড তুলতে ওষুধ কোম্পানিতে যাওয়াটা বোরিং। মার্কেটিং ম্যানেজারগুলো খুব ঢ্যাঁটা হয়। আমাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখে।’

ছদ্ম বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে চন্দন বলল, ”আমরা” মানে? তোর সঙ্গে আর কে থাকছে?’

‘অনেকগুলো টিম আছে তো! একেক সপ্তাহে একেক জন থাকছে। কোনওদিন প্রবাল, কোনওদিন দীপ, কোনওদিন সঞ্জয়, কোনওদিন সবুজ, কোনওদিন অভি। টিমগুলো এমন করে বানানো হয়েছে যাতে প্রতি টিমে একটা একটা ছেলে আর মেয়ে থাকে।’

‘আমাকে তো কেউ বলেনি!’ এখনও ভুরু কুঁচকে আছে চন্দনের।

বৃন্দা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘তোকে বলেনি, কেন না তোকে অন্য টিমে রেখেছে। তুই যেতে চাস? সেটা আগে বলিসনি কেন?’

‘কাকে বলব?’ মিচকে হেসে বলে চন্দন।

‘কেন? আমাকে!’

‘তুই কাকে বলবি?’

‘কেন রিপুদাকে?’

‘রিপুদা কাকে বলবে?’

‘শুনেছি টিনটিন আর চন্দন মিলে সাব কমিটিগুলো বানিয়েছে…’ বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়ে বৃন্দা, ‘আয়্যাম সরি রে। কী বোকার মতো কথা বলছি।’

দু’জনেই চুপচাপ। গেস্টরুমের দেওয়ালের পে-ফোনের বাক্সে নীরবে তাকিয়ে রয়েছে দু’জনের দিকে। হোস্টেলের ভিতর থেকে মেয়েদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না। ফুলমতিয়া একবার উঁকি মেরে বলে গেল, ‘আমি এন্টালি থেকে মোমো আনতে যাচ্ছি। তোমাকে ওরা ডাকছে।’

বৃন্দা ফুলমতিয়াকে পাত্তা দিল না। ফাঁকা ঘরে এখন চন্দন আর বৃন্দা। আর দেওয়াল ঘড়ির ঘড়ির টকটক শব্দ।

মেঝের দিকে তাকিয়ে চন্দন বলল, ‘বৃন্দা…’

বৃন্দা বলল, ‘না।’

‘কী ”না”? আমি কিছু বলব না? না, আমি যা বলব, তার উত্তর ”না”?’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলে চন্দন। সে সাহস করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। গোড়াতেই তাকে থামিয়ে দিয়েছে বৃন্দা।

‘আপাতত প্রথমটা। তুই এখন হোস্টেলে যা। অনেক রাত হল।’ শালমুড়ি দিয়ে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে যায় বৃন্দা। তেরো নম্বর ঘরে ঢুকে দেখে, জেমসি ভদকার সঙ্গে লাইম কর্ডিয়াল মেশাচ্ছে। দময়ন্তীর খাটে বসে আপ্পু, সাবিনা, আর দময়ন্তী। তার খাটে বসে শ্রীপর্ণা আর জেমসি। নিজের খাটে না বসে, মেঝেতে পাতা মাদুরে বসে কোলের কাছে একটা বেঁটে টেবিল রেখে বৃন্দা বলে, ‘মোমো কই?’

জেমসি বলল, ‘ফুলমতিয়া আনছে।’

তেরো নম্বর ঘরটা ফুলমতিয়া ঝকঝকে করে দিয়েছে। ধুলো, ঝুল, নোংরা —সব উধাও। বৃন্দা গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে চারটে সিএফএল বাতি লাগিয়েছে। এত বড় ঘরে দুটো টিউবলাইট যথেষ্ট নয়। একগাদা ফুলগাছের টব নিয়ে এসেছে। দময়ন্তী বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে বাহারি ল্যাম্পশেড, বেডশিট, বেডকভার, বালিশ আর পাশবালিশের ওয়াড়, একগাদা ওয়াল হ্যাঙ্গিং, মুখোশ, ছবির প্রিন্ট, মাদুর আর দড়ি। জানলার পর্দা দোকান থেকে বানিয়ে নিয়েছে। ঘর সাজাতে সাজাতে বৃন্দা আর দময়ন্তীর মধ্যে চমৎকার সখ্য গড়ে উঠেছে।

তেরো নম্বর ঘরটা দেখতে হয়েছে চমৎকার। দেওয়ালের রং অফ হোয়াইট। বিছানার চাদরে আর বালিশের ওয়াড়ে কচি কলাপাতা সবুজ আর সর্ষে খেতের হলুদ রঙের মেলামেশা। পর্দাতে জলপাই সবুজ আর গেরুয়ার কম্বিনেশান। ল্যাম্পশেডের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারে জোনাল লাইটিং ফুটে উঠেছে চমৎকার। তেরো নম্বরে ভূত থাকলেও সে খুব নরম সরম, মিষ্টি ভূত হবে।

জেমসি সবার হাতে গ্লাস ধরালো। বৃন্দা গ্লাস মুখে ঠেকিয়ে বলল, ‘মিষ্টি মিষ্টি খেতে।’

জেমসি হাত থেকে গ্লাস কেড়ে নিয়ে বলল, ‘দারু পিনার এটিকেট জানিস না? সবাই হাতে গ্লাস নেবে। ফের চিয়ার্স হবে। ফের দারু খাওয়া হবে।’

‘দারু খাবে না পিবে?’ খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে সাবিনা।

জেমসি বলে, ‘সরি সরি! বঙ্গালি লোগ সবকুছ খাতা হ্যায়। সিগারেট ভি খাতা হ্যায়, পানি ভি খাতা হ্যায়। চিয়ার্স বেবিলোগ! হ্যাপি হাউস ওয়ার্মিং পার্টি!’

‘চল চল, ফার্স্ট পেগ তাড়াতাড়ি শেষ কর। পরেরগুলো আস্তে আস্তে খাস।’ তাড়া দেয় আপ্পু, ‘ফুলমতিয়া মোমো নিয়ে আসছে।’

‘জীবনদার ক্যান্টিনের মোমো নয় তো? ওগুলো টেরিবলি ব্যাড।’ শ্রীপর্ণা ঢক করে চুমুক দিয়ে বলে।

‘না। আমাদের বাড়ি যাওয়ার পথে, জেম সিনেমার উলটো দিকে একটা রেস্তোরাঁ আছে। নাম ”রোম্যানো স্যান্টোস”। চিনে আর তিব্বতি খাবারের কোয়ালিটি বেশ ভালো। আমি অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। ফুলমতিয়া আনতে গেছে।’ জানায় দময়ন্তী।

‘আই লাভ স্টিমড মোমো।’ গেলাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলে জেমসি। তার কথার মধ্যে ফুলমতিয়া ঢোকে। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া মোমো আর প্লাস্টিকের পাউচে ভরা স্যুপ টেবিলে রেখে আপ্পুকে বলে, ‘আমার কোটা?’

‘জেমসি, ফুলমতিয়াকে এক গেলাস দে।’ হুকুম করে আপ্পু। বৃন্দা সবার আগে গ্লাস মুখে দিয়ে পান করার অভিনয় করেছিল। সবার সঙ্গে চিয়ার্স করার পরেও একবিন্দু মুখে ঢালেনি। বাড়িতে মদ্যপ স্যামিকে দেখে দেখে তার অ্যালকোহলের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। সেটা এখানে এক্সপ্রেস করা যাবে না। তার থেকে অভিনয় বেটার। মোমো নিতে নিতে গ্লাসের ভদকা সে বেঁটে টেবিলের নীচে রাখা গাছের টবে ঢেলে দিল। খাটে না বসে এই কারণেই সে মাদুরে বসেছে। নাইন ও’ক্লকের টবটা আগে থেকেই টেবিলের তলায় রেখে দিয়েছিল। এক পেগের অভিনয় করতে পারলেই যথেষ্ট। একটু বাদেই এরা সবাই মাতাল হয়ে যাবে।

জেমসি গোয়ার গল্প বলছে। শোনার অভিনয় করতে করতে বৃন্দা ভাবল, চন্দন প্রোপোজ করতে চায়না কি? কী জানি বাবা! স্কুল জীবন থেকেই ছেলেদের অ্যাডমিরেশান পেয়ে অভ্যস্ত বৃন্দা। ক্লাসমেটের বাবাদের দৃষ্টিতে অপত্য স্নেহের বাইরে অন্যরকম অনুভূতি ছায়া ফেলত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তাকে প্রোপোজ করেনি। নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ব হল বৃন্দার। পাশাপাশি চন্দনকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে সে খুশি। প্রেম-ফ্রেম প্রচুর চাপের জিনিস। এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে না।

ফাঁকা গেস্টরুমে চন্দন অনেকক্ষণ একা একা বসে থাকে। তার উল্টোদিকে ব্যাথাহত মুখে এসে বসেন শাহরুখ খান। হিরোর কাঁধ এখন ঝোঁকানো। হিরোর চোখের কোণে অশ্রু। শাহরুখকে গেস্টরুমে বসিয়ে রেখে চন্দন বেরোয়। হনহন করে বয়েজ হোস্টেলের দিকে হাঁটতে থাকে। ‘না’ শব্দটি তার মাথায় দমাস দমাস করে হাতুড়ি মারছে। পরাজয় তার পছন্দ নয়। রাগের চোটে মাথা কাজ করছে না। আক্রোশবশত আবার সিগারেট ধরায় সে।