বৃন্দা
‘অ্যাই! রোজ ডে-স্কলারদের মতো ক্লাস শেষ হলেই বাড়ি কাটিস কেন?’ বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল শেষ করে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং থেকে বেরোনো মাত্র বৃন্দাকে প্রশ্ন করল আপ্পু।
‘আমি ডে-স্কলার। তাই!’ হাসতে হাসতে উত্তর দিল বৃন্দা।
‘হোস্টেলে রুমের দরকার নেই তা হলে?’ সরু চোখে প্রশ্ন করে আপ্পু। উত্তর দিতে গিয়ে থমকায় বৃন্দা। এটা সত্যি যে সে হোস্টেলে থাকবে না। কিন্তু কখনও কোনও ইমার্জেন্সিতে কলেজে রাত কাটানোর প্রয়োজন হতে পারে। সেটা কলেজ ফেস্ট হোক, বা এমবিবিএস পরীক্ষার আগের কয়েক সপ্তাহ। সুতরাং হোস্টেলের একটা রুমে নিজেকে অ্যালট করা জরুরি। আপ্পু তার সংগঠনের স্বার্থ দেখছে। পাশাপাশি জুনিয়রের প্রতি কনসার্নও আছে। আপ্পুর প্রশ্নের উত্তর সাবধানে দেয় বৃন্দা, ‘দরকার তো আছে। কিন্তু আমার থেকেও বেশি দরকার, যাদের দূরে বাড়ি, তাদের।’
বৃন্দা জানে, গার্লস হোস্টেলে স্থান সংকুলানের সমস্যা পুরনো। এবং এই সমস্যার একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। মানবীবিদ্যা নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা ভালো বলতে পারবেন, কেন মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলগুলোয় ছেলেদের জায়গা পাওয়া কোনও সমস্যা নয়, কিন্তু মেয়েদের হোস্টেলে বেড পাওয়া নিয়ে নিয়মিত চুলোচুলি হয়।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের আদি নাম রবিনসন মেডিক্যাল কলেজ। এখানকার মেয়েদের হোস্টেলের নাম লেডি আর্চার্স হোস্টেল। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা শহরে সাইমন আর্চার নামে এক আমলা এসেছিলেন। তাঁর বাসস্থান ছিল লাল ইটের তৈরি এই দোতলা বাড়ি। সাইমন প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেতেন ব্রিটিশ সরকারের কাজে। সারাদিন লেডি আর্চার বাড়িতে একা। একগাদা নেটিভ চাকর পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁর দিন কাটত। সন্ধে পার করে সাইমন বাড়ি ফিরতেন। রাত হলেই বাড়িতে পার্টি, রোজ নিত্যনতুন শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারীর আনাগোনা, মদের ফোয়ারা, নাচাগান, হইহুল্লোড়। দিনের বেলার বিমর্ষ লেডি আর্চার রাতের বেলায় হয়ে উঠতেন পুরোদস্তুর সোসাইটি লেডি। সাইমন স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। কিন্তু জানতে পারেননি যে লেডি আর্চার কোনও শ্বেতাঙ্গর সঙ্গে নয়, এক নেটিভ ভিস্তিওয়ালার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক নিয়মিত লিপ্ত হন। ইন্ডিয়ান সামারে অসুস্থ হয়ে একদিন দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে সাইমন দেখেন, শোওয়ার ঘরে লীলাখেলা চলছে। রাগের চোটে বেডরুমেই বন্দুক চালিয়ে ভিস্তিওয়ালা এবং লেডি আর্চারকে হত্যা করেন সাইমন। তারপর নিজের রগে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালান। এই ত্রিকোণ প্রেমের গালগল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লেডি আর্চার্স হোস্টেল।
চৌকোনা দোতলা প্রাসাদ। মাঝখানে বিশাল বাগান। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ব্রিটিশ আমলের যে কটি স্থাপত্য আছে, তার মধ্যে অন্যতম।
বসতবাড়িকে হোস্টেলে বদলে ফেললে যা যা সমস্যা হয় তার সবক’টি লেডি আর্চার্স হোস্টেলে আছে। ঢাউস ঢাউস ঘর, কিন্তু সংখ্যায় কম। প্রতি ফ্লোরে বাথরুমের সংখ্যা নামমাত্র। ঘরে এত বড় বড় জানলা, যে ঢাকতে গিয়ে পর্দায় টান পড়ে। বিশাল বাগান, কিন্তু দেখাশুনো করার মালি নেই। আলাদা ডাইনিং রুম নেই। গার্লস হোস্টেলের সুপার রিনা দত্ত একতলার দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। ঘর-সংকট থাকা সত্ত্বেও কেউ রিনা দত্তকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। কেননা তিনি প্যাথলজির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট এবং জনমোর্চা চিকিৎসক সংগঠনের সদস্য। সব মিলিয়ে লেডি আর্চার্স হোস্টেলে মেয়েদের সমস্যা তিনটে। স্থানাভাব, বাথরুমের অভাব, আব্রুর অভাব।
মেয়েদের হোস্টেলে রুমের ক্রাইসিস এত মারাত্মক যে এই নিয়ে সরকারপন্থী এবং সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন দু’দলই আন্দোলন করেছে। ডেপুটেশান থেকে বনধ, অনশন থেকে সুপারের অফিস ঘেরাও—সব হয়েছে। আন্দোলনের শেষে প্রাপ্তি, পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের একটি চিঠি। যার সারমর্ম, ‘লেডি আর্চার্স হোস্টেল নিডস ভার্টিকাল ইরেকশান। দ্য গার্ডেন শুড নট বি ট্যাম্পার্ড উইদ।’ সারমর্ম, ফাঁকা জায়গায় নতুন কনস্ট্রাকশন করা যাবে না। দোতলা হোস্টেলকে তিন বা চারতলা করা যেতে পারে।
চিঠি নিয়ে কলেজে প্রবল হাসাহাসি। রাতারাতি লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গায়ে পোস্টার পড়ে গেল, ‘গার্লস আর ওয়েটিং ফর ভার্টিকাল ইরেকশান।’
আবাসিক মেয়েরা কিছু মনে করেনি। পোস্টার ছিঁড়েও দেয়নি।
ঠাট্টা-ইয়ার্কি সত্ত্বেও গোদা কথা হল, গার্লস হোস্টেলে তীব্র স্থানাভাব। একেকটা ঘরে পাঁচ থেকে ছজন থাকে। সিনিয়র দিদিরা হাউসস্টাফশিপ কমপ্লিট করার পরেও বেড ছাড়ে না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য পড়াশুনো ছাত্রীদের হোস্টেলে থেকেই করে। সত্যি কথা বলতে কি, হোস্টেলে আনঅথরাইজড এবং অথরাইজড বোর্ডারের সংখ্যা সমান সমান। রোজ সকালে বাথরুমের সামনে সুলভ শৌচালয়ের মতো লম্বা লাইন পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে আপ্পু বৃন্দাকে হোস্টেলে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বৃন্দা না বলে কী করে?
‘তোকে অত কথা ভাবতে হবে না। তুই আমার সঙ্গে রিনা ম্যাডামের কাছে চলে চল। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ বৃন্দার ব্যাকপ্যাক ধরে টানতে টানতে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সবুজ লোহার গেট পেরিয়ে কম্পাউন্ডের ভিতরে ঢুকল আপ্পু।
লাল রঙের বাড়ি। জানলা-দরজা সবুজ রঙের। প্যারাপেট এবং থামের রং হালকা বাদামি। ছাপমারা ব্রিটিশ আর্কিটেকচার। বিশাল আর্চওয়ালা প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ডানদিকে গেস্টরুম। পুরুষ প্রজাতি গেস্টরুম পর্যন্ত অ্যালাওড। গেস্টরুমে গোটাপাঁচেক সোফা রাখা রয়েছে। গোটাপাঁচ টেবিল। মেঝেয় জুটের কার্পেট। কতদিন ধুলো ঝাড়া হয়নি কে জানে! দেওয়ালে কয়েকটা পেন্টিং অথবা ফোটোগ্রাফ ঝুলছে। বছরের পর বছর ধরে তাদের ওপরে ধুলোর আস্তরণ জমেছে, জাল বুনেছে মাকড়সা। কাঠের ফ্রেমের চৌখুপ্পির মধ্যে কালো আর ধূসর রঙের টানাপোড়েন ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না।
ছাদ থেকে ঝুলছে পাখা এবং টিউবলাইট। পুরনো দিনের বাড়ির উচ্চতা এখনকার বাড়ির দেড়গুণ। বড় ঘরে কম সংখ্যক ফ্যান এবং টিউবলাইট থেকে হাওয়া এবং আলো ছড়ানোর জন্য তাদের লম্বা রড দিয়ে ঝোলানো হয়েছে। দেওয়ালে লাগানো পে-ফোনের বাক্সে ঝুল জমেছে। বৃন্দা আন্দাজ করল, মোবাইল পূর্ববর্তী জমানায় বাক্সটা বসানো হয়েছিল। মোবাইল আসার পরে প্রয়োজন ফুরোলেও কেউ খুলে নেওয়ার কথা ভাবেনি। বাক্সটা অ্যান্টিক পিসের মতো দেওয়াল থেকে লটকে আছে।
শুধু বাক্স কেন, গোটা গেস্টরুম থেকেই অ্যান্টিক-অ্যান্টিক গন্ধ বেরোচ্ছে। আপ্পু বলল, ‘গেস্টরুম দেখার জন্য তোকে হোস্টেলে আনিনি। রিনা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করবি চল।’
প্রধান ফটকের বাঁদিকে হোস্টেল সুপার রিনা দত্তর কোয়ার্টার। সেগুন কাঠের বিশাল দরজার এককোণে মান্ধাতার বাবার আমলের গোল, সাদাকালো কলিং বেল। আপ্পু বেল টিপতেই ক্যাঁক-ক্যাঁক করে বিকট শব্দ হল। মুহূর্তের মধ্যে শোনা গেল কুকুরের ঘেউঘেউ চিৎকার, পাখির কলরব এবং বিকট বাজখাঁই গলায় ধমক, ‘ক্যা?’
হয়তো রিনা ‘কে’ বলতে চেয়েছেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে, বৃন্দা শুনল ‘ক্যা?’ দরজার ওপারে এত রকমের আওয়াজ আর চেঁচামেচি হচ্ছে যে বৃন্দার মনে হল নোয়ার নৌকায় ওঠার জন্য স্ট্যাম্পিড শুরু হয়েছে।
দরজা খুলে উঁকি মারলেন যিনি, তাকে টিনটিনের কমিক স্ট্রিপের জেনারেল আলকাজারের বউয়ের মতো দেখতে। আপ্পুর মতো লম্বা না হলেও, অনেকটা লম্বা। চওড়াতেও আপ্পুর সমকক্ষ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। পরে আছেন লাল কাফতান। চোখে লাল তিনকোনা ফ্রেমের চশমা। ওই তিনকোনা ফ্রেমের কারণেই রিনাকে জেনারেল আলকাজারের বউ ভেবেছিল বৃন্দা! রিনার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মুখ থেকে হালকা অ্যালকোহলের গন্ধ আসছে। ঘড়িতে সময় দেখল বৃন্দা। বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। এখন থেকেই মদ্যপান করছেন? এ দেখি স্যামির থেকেও এক কাঠি সরেস।
‘আরে আপ্পু! প্লিজ ডু কাম!’ দরজা খুলে আপ্পুকে ভিতরে আহ্বান করলেন রিনা। বৃন্দা পিছন পিছন বসার ঘরে ঢুকল। দু’কামরাওয়ালা কোয়ার্টারের প্রথম ঘরকে বসার ঘর বলতে হয় তাই বলা। না হলে, এটিকে লাইব্রেরি অথবা ল্যাবরেটরি অথবা শুঁড়িখানা—যা খুশি বলা যেতে পারত।
ঘরের চারটি দেওয়াল জোড়া বুক র্যাক। তাতে প্যাথোলজি বিষয়ক নোটবুক, রেফারেন্স বুক, টেক্সট বুক, জার্নাল, ম্যাগাজিন থইথই করছে। টেবিলের ওপরে রাখা একটি হাই এন্ড ডেস্কটপ কম্পিউটার ও একটি বাইনোকিউলার মাইক্রোস্কোপ। ডেস্কটপটি তার দিয়ে মাইক্রোস্কোপের সঙ্গে যুক্ত। মাইক্রোস্কোপের আই-পিসে ডিজিটাল ক্যামেরা ফিট করা। এই হাই-টেক সেটআপের পাশে গেলাসে সাদা পানীয়। বুক র্যাকের পাশে লালরঙা বার কাউন্টার ভরতি গোটা পঞ্চাশেক ছোট-বড় বোতল।
স্যামির কল্যাণে বৃন্দা সারা পৃথিবীর অ্যালকোহলের ব্র্যান্ড চেনে। তার জ্ঞানের বাইরে অবস্থান করছে এইরকম কিছু বোতলও দেখা যাচ্ছে। ঘরময় সিগারেটের গন্ধ।
‘সো… ধান্দাটা কী?’ নিখুঁত তিনটে রিং ছেড়ে প্রশ্ন করলেন রিনা। কোনও সামাজিক সম্ভাষণ নয়, হাই হ্যালো নয়, একদম কাজের কথা। রিনার দুনিয়াদারি দেখা আছে। তিনি ফালতু ‘পেপ টক’ পছন্দ করেন না।
‘এর নাম বৃন্দা। একে হোস্টেলে একটা বেড দিতে হবে।’
‘বেড দেওয়ার দায়িত্ব তোদের। আমার কাছে যখন এনেছিস, তখন কোনও একটা প্যাঁচ আছে। সেটা কী?’ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন রিনা।
‘ও কলকাতার মেয়ে। হস্টেলের তেমন দরকার নেই।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি। তা না হলে আমার কাছে আনবি কেন? আমি বলতে চাইছি ওকে হোস্টেলে বেড দেওয়ার জন্য তুই এত ইগার কেন? ভোটে দাঁড় করাবি?’
এতক্ষণে বৃন্দার বোধোদয় হল। রিনা অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করেছেন। আপ্পু তো-তো করতে করতে জবাব দিল, ‘অতটা ভাবিনি। ও এবার মিস আইএমসি হয়েছে। সেই জন্য বলছিলাম…’
‘লেম এক্সকিউজ!’ সিগারেট অ্যাশট্রেতে পিষে বৃন্দার দিকে তাকিয়ে রিনা বললেন, ‘বাড়ি কোথায়?’
‘সাউথে!’ দায়সারা উত্তর দেয় বৃন্দা।
‘সাউথ-পোল না সাউথ-আমেরিকা না সাউথ-ইন্ডিয়া না সাউথ-টোয়েন্টি ফোর পরগনাস?’ শ্লেষের তির মাখানো মালটিপল চয়েস প্রশ্ন ধেয়ে এল রিনার কাছে থেকে।
‘সাউথ ক্যালকাটা।’ লজ্জা পেয়ে বলে বৃন্দা। ক্যাজুয়ালি উত্তর দেওয়া অনুচিত হয়েছে।
‘বোড়াল না গড়িয়া না পশ্চিম পুঁটিয়ারি?’ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করেন রিনা। লাল ত্রিকোণ ফ্রেমের ওপাশে তাঁর চোখ ঝকঝক করছে। বৃন্দার মধ্যে নধর মুরগি খুঁজে পেয়েছিল তিনি।
‘মুদিয়ালি।’ অসহায়ভাবে বলে বৃন্দা।
‘মুদিয়ালির কোথায়? চারু মার্কেট?’ রিনা ইচ্ছে করে মুদিয়ালির এমন জায়গার নাম করলেন, যেখানে কয়েকটা বস্তি আছে। বৃন্দা মাথা নেড়ে বলল ‘এসআর দাস রোড আর এসপি মুখার্জি রোডের ক্রসিং-এ।’
‘ওই কর্নারে তো একটাই বাড়ি। শান্তিধাম।’ জ্বলজ্বলে চোখে বৃন্দার দিকে তাকিয়ে বলেন রিনা। বৃন্দার মনে পড়ে যায় স্যামির পরামর্শ। কলেজের কেউ যেন জানতে না পারে যে সে সার্জারির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের মেয়ে। বৃন্দা কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ‘আপনারও মুদিয়ালিতে বাড়ি?’
রিনা কিছু বলার আগে ভিতরের ঘর থেকে পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ‘হ্যাঁগো, একবার শুনবে? এটা নিয়ে যাও না!’ রিনার কৌতূহলের অবসান ঘটল কি না বোঝা গেল না, তবে পুরুষ কণ্ঠের অনুরোধ শুনে তিনি প্রশ্ন করা বন্ধ রেখে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। ফাঁকা ঘরে বৃন্দা আপ্পুর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল। ফিশফিশ করে বলল, ‘এটা কী কেস গুরু?’
আপ্পু ঠোঁটে তর্জনী রেখে ইশারা করল, ‘চুপ।’
রিনা ফেরত এসেছেন। কম্পিউটার খুলে একটা ফোল্ডার হাঁটকে বললেন, ‘দোতলার রুম নম্বর থার্টিন।’
‘ম্যাডাম, ওই ঘরটা বাথরুমের পাশে।’ আপ্পু আপত্তি করে, ‘বাথরুমের দখল নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া হয়। ও ঘরে কেউ থাকতে পারে?’
‘ওই ঘরে কেউ থাকে না বলেই বৃন্দাকে অ্যালট করছি। চারটে বেড আছে। তার মধ্যে দুটো বেড অকুপাই করে দুই হাউসস্টাফ ছিল। ওরা এমডিতে চান্স পেয়ে সদ্য হোস্টেল ছেড়েছে। রুম এখন খালি।’
‘আমার কোনও প্রবলেম নেই।’ তড়িঘড়ি বলে বৃন্দা। সে কোনওদিনও হোস্টেলে থাকবে না। তার রুম বাথরুমের পাশে হলে অসুবিধে নেই।
‘ঠিক হ্যায়!’ কি-বোর্ড টিপে ডেটা এন্ট্রি করতে করতে রিনা বলেন, ‘নাম-ঠিকানা বলো…’
‘বৃন্দা ব্যানার্জি, ওয়ান বাই ওয়ান এ এসআর দাস রোড, কলকাতা…’ নাম ঠিকানা বলার পরে পিন নম্বর বলতে বলতে বৃন্দা খেয়াল করল, রিনা কি বোর্ড টিপছেন না। মনিটরের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন।
ঘটনাটা শুধু বৃন্দার নয়, আপ্পুরও চোখে পড়েছে। সে বলল, ‘ম্যাডাম, ঠিকানা লিখবেন না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ…’ লাল ত্রিকোণ ফ্রেমের চশমা ঠিক করে টকাটক কি-বোর্ড টেপেন রিনা। আর একটা সিগারেট মুখে গুঁজে ফশ করে দেশলাই ধরান। তাঁর চোখে চিকচিক করছে জল এবং কৌতূহল। ড্রয়ার খুলে চাবি বার করে বৃন্দার হাতে দিতে গিয়ে প্রশ্ন করলেন ‘শান্তিধাম?’
আবছা ঘাড় নাড়ে বৃন্দা। আপ্পু যেন কিছু বুঝতে না পারে।
‘স্যামি? বাবা?’ ক্যাজুয়ালি বলেন রিনা।
আবার আবছা নড করে বৃন্দা। মনে মনে প্রার্থনা করে রিনা যেন আর কিছু জিজ্ঞাসা না করেন।
রিনা কি বৃন্দার প্রার্থনা বুঝতে পেরেছেন? বোধহয় হ্যাঁ। তিনি আবার পুরনো চেহারায়। এক চুমুক ভদকা পান করে আপ্পুকে বললেন, ‘তোরা এবার আয়। একটা আর্টিকলের জন্য ছবি তুলতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি।’
ভিতর থেকে আবার পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ‘রিনা, কারা এসেছে?’
রিনা উত্তর দেওয়ার আগে বৃন্দা আর আপ্পু সুপারের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এল। চওড়া দালান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপ্পু বলল, ‘ভেতর থেকে যে লোকটি কথা বলছিলেন, উনি রিনা ম্যাডামের হাজব্যান্ড। ভালো নাম জানা নেই। সবাই পুশকিনদা বলে। উনিও ডাক্তার। শুনেছি অনেক বছর আগে অ্যাক্সিডেন্টের ফলে ওনার স্পাইনে চোট লাগে। তারপর থেকে দুই পা অবশ।’
‘ও।’ মার্বেল বসানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে বলে বৃন্দা।
‘কমিউনিটি মেডিসিনের নিরোধ দে-র সঙ্গে রিনা ম্যাডামের শান্টিং-এর রিলেশান আছে। তবে আমি শিয়োর নই।’
‘শান্টিং আবার কী?’
‘নেকুপষুমুনুগিরি হচ্ছে?’ দুই হাত দিয়ে সঙ্গমের ইঙ্গিত করে আপ্পু বলে, ‘শান্টিং জানিস না?’
‘ও! তাই বলো!’ নিজেকে সামলে নেয় বৃন্দা, ‘আমি শুনেছি যে বায়োকেমিস্ট্রির এইচওডি-র সঙ্গেও ওঁর ওই ব্যাপারটা আছে।’
‘কমিউনিটি মেডিসিনের হেডুর নাম নিরোধ স্যার। বিয়েথা করেনি। আমাদের কলেজের উলটো ফুটে, প্রাচী সিনেমা হলের পাশের রাস্তাটার নাম ডিক্সন লেন। ওই রাস্তায় নিরোধ স্যার একা একটা পুরোনো বাড়িতে থাকেন। একদিন রিনা ম্যাডাম যান, একদিন আরতী ম্যাডাম যান। রিনা ম্যাডামের বাচ্চা-কাচ্চা নেই। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে গেলে পঙ্গু পুশকিনদাকে নিয়ে বিপদে পড়বেন। নিরোধ স্যারকেও আর পাবেন না। ওই জন্য মন দিয়ে জনমোর্চার ডাক্তারি অ্যাসোসিয়েশান করেন আর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পান্ডাদের হাতে রাখেন। নেতাদের সব কথা শোনেন। যেমন আমার কথা শুনলেন।’ দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বলল আপ্পু।
লেডি আর্চার্স হোস্টেলের স্থাপত্য দেখে বৃন্দা মুগ্ধ। সাদা-কালো চৌখুপ্পি মেঝে, লোহার রেলিং, উঁচু কাঠের দরজার ওপরে রঙিন কাচের জাফরি—একদম উনিশ শতকের কলকাতার বাড়ি। লাহাবাড়ি বা দাঁ ফ্যামিলিদের প্যালেসে শুটিং না করে এখানে করা যেতে পারে। টানা বারান্দায় ঝোলানো খাঁচায় বন্দি টিয়াপাখির বদলে এখানে তার থেকে ঝুলছে মেয়েদের নানান মাপের অর্ন্তবাস, জিনস, টি-শার্ট, পেটিকোট, তোয়ালে।
বারান্দার একদম শেষ ঘরটার সামনে এসে আপ্পু বলল, ‘এই হল তোর রুম। আমি জানতাম রিনা ম্যাডাম তোকে এই ঘরটা অ্যালট করবেন। দরজা খোল।’
ইয়াব্বড়ো তালায় চাবি ঢোকাতে ঢোকাতে বৃন্দা বলল, ‘রুম নম্বর তেরো হয় কী করে? আগের রুমের মাথায় নম্বর হল সাতাশ। সেই হিসেবে এটা আঠাশ হওয়া উচিত।’
কাঠের খড়খড়ি দেওয়া দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আপ্পু বলল, ‘এই হোস্টেলের বারো নম্বর ঘরের পরের ঘরটার নম্বর হল চোদ্দ। আনলাকি থার্টিনে কেউ থাকবে না বলে ওই নম্বরটা ওমিট করা হয়েছে। পরে হিসেব মেনটেইন করার জন্য আঠাশ নম্বর ঘরকে তেরো নম্বরের শিরোপা দেওয়া হয়েছে। আনলাকি নাম্বার ফর অ্যান ওমিনাস রুম।’
‘ওমিনাস কেন?’ ঘরে ঢুকে বলল বৃন্দা।
‘এটা সাইমন আর লেডি আর্চারের মাস্টার বেডরুম ছিল। এই ঘরেই সাইমন তার বউ আর ভিস্তিওয়ালাকে রেড হ্যান্ডেড ধরেছিলেন। এই ঘরেই দুটো মার্ডার আর একটা সুইসাইড হয়েছিল। এই ঘরে ওঁরা নাকি ফিরে আসেন।’
‘ভ্যাট!’ হেসে ফেলে বৃন্দা। বারান্দার উল্টোদিকের দুটো বড় বড় জানলা খুলে দেয়। শেষ বিকেলের রোদে ঘর ভরে যায়।
ঘরটা বিশাল বড়। আরও বড় লাগছে, কেন না এই ঘরে আসবাব কম। দুটি সিঙ্গল বেড, দুটি টেবিল আর দুটি চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। তিরিশ ফুট বাই তিরিশ ফুট ঘরে এই কটা ফারনিচার নস্যি। অনেক ওপরে দুটো চার ব্লেডওয়ালা ফ্যান চুপচাপ বৃন্দাকে মাপছে। দেওয়াল আর সিলিংয়ে ঝুল, মেঝেতে এক আঙুল পুরু নোংরা। খাট, টেবিল, চেয়ার—সব ধুলোর আস্তরণে ঢাকা। ‘হ্যাঁচ্চো’ ‘হ্যাঁচ্চো’ করে বারতিনেক হাঁচে বৃন্দা।
আপ্পু বলে, ‘জানলাগুলো বন্ধ করে দে। ওদিকটায় গ্রুপ ডি স্টাফের কোয়ার্টার। সবসময় হাঁ করে হোস্টেলের জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।’
বৃন্দা বলে, ‘আমার ডাস্ট অ্যালার্জি হচ্ছে। কী ধুলো।’
আপ্পু জানলা বন্ধ করে বলে, ‘ডাস্ট অ্যালার্জি সেরে যাবে। তোর ভূতে ভয় নেই তো? থাকলে আগে থেকে বল। পরে নাকি কান্না চলবে না।’
‘আজ পর্যন্ত ভূত কেউ দেখেছে?’ রুমাল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলে বৃন্দা।
‘কেউই দেখেনি। তবে দু-একজন মেয়ে এ ঘরে থাকার চেষ্টা করে ফেল করেছে। রাতে নাকি খাটের পায়া নড়ে, জানলা নিজের থেকে খোলা-বন্ধ হয়, সুইচ না টিপলেও বনবন করে পাখা ঘুরতে শুরু করে, গাউন-পরা মেমসাহেব হাই হিল জুতো পরে খটখট করে ঘুরে বেড়ায়। আমি চাইছি রুমটা ইউজ হোক। যেখানে থাকার এত সমস্যা, সেখানে ভূতের ভয়ে এত বড় একটা রুম খালি যাবে, এটা ঠিক না।’
‘ভূতের গন্ধ যে ঘরের গায়ে লেগে গেছে, সে ঘরে থাকা শক্ত। বিচ্ছিরি মানসিক চাপ পড়ে।’ হাসতে হাসতে বলে বৃন্দা। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমিও যথেষ্ট ভিতু। কোনওদিন রাতে এ ঘরে থাকব কি না সন্দেহ। তবে দিনের বেলা রেস্ট নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এত বড় ঘরে আমি একা থাকব? কোনও রুমমেট পাব না?’
‘যারা পারমানেন্টলি হোস্টেলে থাকছে বা থাকবে, তারা কেউ আসতে রাজি নয়। তোদের ব্যাচের সাবিনা, জেমসি, শ্রীপর্ণাকে বলেছি। ওরা কেউ আসেনি। অন্য রুমে পাঁচ-সাতজন গাদাগাদি করে থাকবে, কিন্তু এই রুমে আসবে না। আমি দময়ন্তীকে বলেছি। ও নিমরাজি। বলেছে, কেউ একজন এলে, তবেই আসবে। সেই জন্যেই তোকে পাকড়ালাম। তোরা দুজনে বছরখানেক এই রুমে কাটিয়ে দিতে পারলে সামনের বছর এই ঘরে পাঁচজন ঢুকে যাবে। অন্য রুমের ওপরে চাপ কিছুটা হলেও কমবে।’
বৃন্দার হাঁচি বন্ধ হয়নি। সে বলল, ‘চলো, এবার বেরোই। বাড়ি ফিরতে হবে।’
রুম নম্বর থার্টিন থেকে বেরিয়ে আসে বৃন্দা আর আপ্পু। আপ্পু রুমের দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি বৃন্দার হাতে দিয়ে বলে, ‘কাল বাড়ি থেকে চাদর নিয়ে এসে পেতে ফেলিস। নীচে ফুলমতিয়া বসে আছে, ওকে পঞ্চাশ টাকা দিস। রুম সাফ করে দেবে। বন্ধ থেকে থেকে ড্যাম্প হয়ে গেছে।’
‘ফুলমতিয়া কে?’ চাবি ব্যাগে ঢুকিয়ে বলে বৃন্দা।
‘ক্যান্টিনের জীবনদার বউ। গাইনিকলজি ডিপার্টমেন্ট আর লেবার রুমের আয়া। যখন ডিউটি থাকে না, তখন লেডিজ হোস্টেলের ঝাড়ুদারনি-কাম-উওম্যান ফ্রাইডে। চোথা করার জন্য মাইক্রো জেরক্স, রাত একটার সময় ভদকার বোতল, পাজামা পার্টির জন্য হ্যাশ—সব ওর কাছে পাবি। আমাদের হোস্টেলের মাঝখানের বাগানে গাঁজা গাছের চাষ হয়, এটা জানতিস?’
‘এখানে গাঁজা?’ বৃন্দা অবাক।
‘এখানেই তো সুবিধে। পুলিশের বাবাও জানতে পারবে না। ফুলমতিয়া গাঁজা সাপ্লাই করে ওর বরকে। জীবনদার ক্যান্টিনে উৎকৃষ্ট ”মণিপুরি গাঁজা” নামে যা পাওয়া যায়, তা আসলে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের ফসল।’
বৃন্দা বলতে যাচ্ছিল, ‘আমার কোনওটারই দরকার নেই।’ বলল না। আপ্পু মেয়েটা ভালো। অযথা চটিয়ে লাভ নেই।
আপ্পু বৃন্দাকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আলমারি খুলে অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ট্যাবলেট দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নে। হাঁচি বন্ধ হয়ে যাবে।’
এই ঘরে খাটের সংখ্যা দেখে বৃন্দা আন্দাজ করল পাঁচজন থাকে। সিনিয়র দিদিদের বৃন্দা চেনে না। তাদের ব্যাচের জেমসি এই রুমে থাকছে। সে পাজামা আর টি-শার্ট পরে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে ল্যাপটপে স্কাইপ করছে। মুখের কাছে মাউথপিস ধরে বিড়বিড় করে কথা বলছে আর কুলকুলিয়ে হাসছে। ল্যাপটপের পর্দায় মাঝবয়সি এক মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। বোধহয় জেমসির মা। ওয়েব-ক্যামের থেকে দূরে রইল বৃন্দা। জেমসিকে বলল, ‘চললাম।’ জেমসি অন্যমনস্ক ভাবে হাত নাড়ল।
লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সবুজ গেট পেরিয়ে বাইরে এসে বৃন্দা আপ্পুকে রুমের চাবি ফেরত দিয়ে বলল, ‘আমি কাল বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, মশারি —এই সব নিয়ে আসব। তুমি ফুলমতিয়াকে বোলো, রুমটা সাফ করে রাখতে। আমি কাল দিঠির সঙ্গে কথা বলে নেব।’
‘দিঠি?’
‘দময়ন্তীর ডাকনাম। ওর ভালোনামটা বড্ডো বড়। ওই নামে আমাদের ক্লাসে ওকে কেউ ডাকে না। আমরা দিঠি বলি।’
‘গুড। আমিও দিঠিই বলব।’
‘আপ্পুদি, আমি তাহলে এগোলাম। কাল দেখা হবে।’
আপ্পু হাসি মুখে কথা বলছিল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ওপিয়াম নিয়ে ইউনিয়ন রুমে মিটিং আছে। যাবি না?’
‘ওপিয়াম? মানে ফুলমতিয়ার গাঁজা? তাই নিয়ে মিটিং?’
‘আমাদের কলেজ ফেস্টের নাম ওপিয়াম।’ চোখ পাকিয়েছে আপ্পু।
‘আজ ছেড়ে দাও প্লিজ!’ মিনতি করে বৃন্দা।
‘ঠিক আছে। আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। তবে এটা মনে রাখিস, কলকাতার প্রথম পাঁচটা ইন্টার-কলেজ ফেস্টের মধ্যে ওপিয়াম বিলং করে। স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করার জন্য বহুত হ্যাপা পোয়াতে হয়। ফার্স্ট ইয়ার বলে গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়ালে চলবে না। অ্যাডভার্টাইজমেন্ট জোগাড়ের কাজগুলো তোকে দিয়ে করাব।’
‘আমি অ্যাড তুলতে বেরোব?’ কাঁদোকাঁদো গলায় বলে বৃন্দা। ‘আমাকে কেউ চেনে? না, আমি কাউকে চিনি?’
‘কাউকে চিনতে হবে না। রিপু তোকে ওষুধ কোম্পানির অ্যাড্রেস বলে দেবে। তুই গিয়ে মার্কেটিং ম্যানেজারের হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে আসবি। মিস আইএমএসকে দেখলে ওরা মাল্লু ছাড়তে বাধ্য।’
‘ভ্যাট!’ হেসে ফেলে বৃন্দা।