» » » পঞ্চম পরিচ্ছেদ : উদিপুরী বেগম

বর্ণাকার

ঔরঙ্গজেব জগৎপ্রথিত বাদশাহ। তিনি জগৎপ্রথিত সাম্রাজ্যের অধিকারী হইয়াছিলেন। নিজেও বুদ্ধিমান, কর্মপদক্ষ, পরিশ্রমী এবং অন্যান্য রাজগুণে গুণবান ছিলেন। এই সকল অসাধারণ গুণ থাকিতেও সেই জগৎপ্রথিতনামা রাজাধিরাজ, আপনার জগৎপ্রথিত সাম্রাজ্য একপ্রকার ধ্বংস করিয়া মানবলীলা সংবরণ করিলেন।

ইহার একমাত্র কারণ, ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধূর্ত্, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক, প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন–কিন্তু অন্ত:পুর অসংখ্য সুন্দরীরাজিতে মধুমক্ষিকা পরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনিতে ধ্বনিত হইত।

তাঁহার মহিষীও অসংখ্য–আর সবার বিধানের সঙ্গে সম্বন্ধশূন্যা বেতনভাগিনী বিলাসিনীও অসংখ্য। এই পাপিষ্ঠাদিগের সঙ্গে এই গ্রন্থের সম্বন্ধ বড় অল্প। কিন্তু কোন কোন মহিষীর সঙ্গে এই উপাখ্যানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।

মোগল বাদশাহেরা যাঁহাকে প্রথম বিবাহ করিতেন, তিনিই প্রধানা মহিষী হইতেন। হিন্দুদ্বেষী ঔরঙ্গজেবের দুর্ভাগ্যক্রমে একজন হিন্দুকন্যা তাঁহার প্রধানা মহিষী। আকব্বর বাদশাহ রাজপুত রাজগণের কন্যা বিবাহ করা প্রথা প্রবর্তিত করিয়াছিলেন। সেই নিয়ম অনুসারে, সকল বাদশাহেরই হিন্দুমহিষী ছিল। ঔরঙ্গজেবের প্রধানা মহিষী যোধপুরী বেগম।

যোধপুরী বেগম প্রধানা মহিষী হইলেও প্রেয়সী মহিষী ছিলেন না। যে সর্বাকপেক্ষা প্রেয়সী, সে একজন খ্রিষ্টিয়ানি; উদিপুরী নামে ইতিহাসে পরিচিতা। উদয়পুরের সঙ্গে ইঁহার কোন সম্বন্ধ ছিল বলিয়া নাম উদিপুরী নহে। আসিয়া খণ্ডের দূরপশ্চিমপ্রান্তস্থিত যে জর্জিয়া এখন রুষিয়া রাজ্যভুক্ত, তাহাই ইঁহার জন্মভূমি। বাল্যকালে একজন দাসব্যবসায়ী ইঁহাকে বিক্রয়ার্থে ভারতবর্ষে আনে, ঔরঙ্গজেবের অগ্রজ দারা ইঁহাকে ক্রয় করেন। বালিকা বয়:প্রাপ্ত হইলে অদ্বিতীয় রূপলাবণ্যবতী হইয়া উঠিল। তাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া দারা তাহার অত্যন্ত বশীভূত হইলেন। বলিয়াছি, উদিপুরী মুসলমান ছিল না, খ্রিষ্টিয়ান। প্রবাদ আছে যে, দারাও শেষে খ্রিষ্টিয়ান হইয়াছিলেন।

দারাকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া, তবে ঔরঙ্গজেব সিংহাসনে বসিতে পাইয়াছিলেন। দারাকে পরাস্ত করিয়া, ঔরঙ্গজেব প্রথমে তাহাকে বন্দী করিয়া, পরে বধ করেন। দারাকে বধ করিয়া নরাধম ঔরঙ্গজেব এক আশ্চর্যর প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিল। উড়িয়াদিগের কলঙ্ক আছে যে, বড় ভাই মরিলে ছোট ভাই বিধবা ভ্রাতৃজায়াকে বিবাহ করিয়া তাহার শোকাপনোদনকরে। এই শ্রেণীর একজন উড়িয়াকে আমি একদা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “তোমরা এমন দুষ্কর্ম্ম কেন কর?” সে ঝটিতি উত্তর করিল, “আজ্ঞে, ঘরের বৌ কি পরকে দিব?” ভারতেশ্বর ঔরঙ্গজেবও বোধ হয় সেইরূপ বিচার করিলেন। তিনি কোরাণের বচন উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, ইসলাঙম ধর্মাইনুসারে তিনি অগ্রজপত্নী বিবাহ করিতে বাধ্য। অতএব দারার দুইটি প্রধানা মহিষীকে স্বীয় অর্ধাইঙ্গের ভাগিনী হইতে আহূত করিলেন। একটি রাজপুতকন্যা; আর একজন এই উদিপুরী মহাশয়া। রাজপুতকন্যা এই আজ্ঞা পাইয়া যাহা করিল, হিন্দুকন্যা মাত্রেই সেই অবস্থায় তাহা করিবে, কিন্তু আর কোন জাতীয়া কন্যা তাহা পারিবে না;-সে বিষ খাইয়া মরিল। খ্রিষ্টিয়ানীটা সানন্দে ঔরঙ্গজেবের কণ্ঠলগ্না হইল। ইতিহাস এই গণিকার নাম কীর্তিুত করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছেন, আর যে ধর্মইরক্ষার জন্য বিষ পান করিল, তাহার নাম লিখিতে ঘৃণা বোধ করিয়াছেন। ইতিহাসের মূল্য এই।

উদিপুরীর যেমন অতুল্য রূপ, তেমনি অতুল্য মদ্যাসক্তি। দিল্লীর বাদশাহেরা মুসলমান হইয়াও অত্যন্ত মদ্যাসক্ত ছিলেন। তাঁহাদিগের পৌরবর্গ এ বিষয়ে তাঁহাদের দৃষ্টান্তনুগামী হইতেন। রঙমনহালেও এ রঙ্গের ছড়াছড়ি! এই নরকমধ্যেও উদিপুরী নাম জাহির করিয়া তুলিয়াছিল।

জেব-উন্নিসা হঠাৎ উদিপুরীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিতে পারিল না। কেন না, ভারতেশ্বরের প্রিয়তমা মদ্যপানে প্রায় বিলুপ্তচেতনা; বসনভূষণ কিছু বিপর্য্যস্ত, বাঁদীরা সজ্জা পুনর্বিন্যস্ত করিল; ডাকিয়া সচেতন ও সাবধান করিয়া দিল। জেব-উন্নিসা আসিয়া দেখিল, উদিপুরীর বাম হাতে সটকায়, নয়ন অর্ধিনিমীলিত, অধরবান্ধুলীর উপর মাছি উড়িতেছে; ঝটিকা বিভিন্ন ভূপতিত বৃষ্টিনিষিক্ত পুষ্পরাশির মত উদিপুরী বিছানায় পড়িয়া আছে।

জেব-উন্নিসা আসিয়া কুর্ণিশ করিয়া বলিল, “মা! আপনার মেজাজ উত্তম ত?”

উদিপুরী অর্ধউজাগতের স্বরে, রসনার জড়তার সহিত বলিল, “এত রাত্রে কেন?”

জে। একটা বড় খবর আছে।

উ। কি? মারহাট্টা ডাকু মরেছে?

জে। তারও অপেক্ষা খোশ খবর।

এই বলিয়া জেব-উন্নিসা গুছাইয়া বাড়াইয়া রঙ ঢালিয়া দিয়া, চঞ্চলকুমারীর সেই তসবির ভাঙ্গার গল্পটা করিলেন। উদিপুরী জিজ্ঞাসা করিল, “এ আর খোশ খবর কি?”

জেব-উন্নিসা বলিল, “এই মহিষের মত বাঁদীগুলা হজরতের তামাকু সাজে, আমি তাহা দেখিতে পারি না। রূপনগরের সেই সুন্দরী রাজকুমারী আসিয়া হজরতের তামাকু সাজিবে, বাদশাহের কাছে এই ভিক্ষা চাহিও।”

উদিপুরী না বুঝিয়া, নেশার ঝোঁকে বলিল, “বহুত আচ্ছা।”

ইহার কিছু পরে রাজকার্যম পরিশ্রমক্লান্ত বাদশাহ শ্রমাপনয়ন জন্য উদিপুরীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন। উদিপুরী নেশার ঝোঁকে চঞ্চলকুমারীর কথা, জেব-উন্নিসার কাছে যেমন শুনিয়াছিল, তেমনই বলিল। “সে আসিয়া আমার তামাকু সাজিবে,” এ প্রার্থনাও জানাইল। বলিবামাত্র ঔরঙ্গজেব শপথ করিয়া স্বীকার করিলেন। কেন না, ক্রোধে অস্থির হইয়াছিলেন।

Leave a Reply