» » » সপ্তম পরিচ্ছেদ : খোদা শাহজাদী গড়েন কেন?

আবার জেব-উন্নিসার বিলাস-মন্দিরে, মবারক রাত্রিকালে উপস্থিত। এবার মবারক, গালিচার উপর জানু পাতিয়া উপবিষ্ট–যুক্তকর, ঊর্ধ্ব্মুখ। জেব-উন্নিসা সেই রত্নখচিত পালঙ্কে, মুক্তাপ্রবালের ঝালরযুক্ত শয্যায় জরির কামাদার বালিসের উপর হেলিয়া, সুবর্ণের আলবোলায়, রত্নখচিত নলে, তামাকু সেবন করিতেছিল। পাশ্চাত্য মহাত্মগণের কৃপায়, তামাকু তখন ভারতবর্ষে আসিয়াছে।

জেব-উন্নিসা বলিতেছেন, “সব ঠিক বলিবে?”

মবারক যুক্তকরে বলিল, “আজ্ঞা করিলেই বলিব।”

জে। তুমি দরিয়াকে বিবাহ করিয়াছ?

ম। যখন স্বদেশে থাকিতাম, তখন করিয়াছিলাম।

জে। তাই অনুগ্রহ করিয়া আমাকে নেকা করিতে চাহিয়াছিলে?

ম। আমি অনেক দিন হইল, উহাকে তাল্লাক্ দিয়া পরিত্যাগ করিয়াছি।

জে। কেন পরিত্যাগ করিয়াছ?

ম। সে পাগল। অবশ্য তাহা আপনি বুঝিয়া থাকিবেন।

জে। পাগল বলিয়া ত আমার কখনও বোধ হয় নাই।

ম। সে আপনার কার্যআসিদ্ধির জন্য হুজুরে হাজির হয়। কাজের সময়ে আমিও তাহাকে কখন পাগল দেখি নাই। কিন্তু অন্য সময়ে সে পাগল। আপনি তাহাকে খানখাহ কোন দিন আনাইয়া দেখিবেন।

জে। তুমি তাহাকে পাঠাইয়া দিতে পারিবে? বলিও যে, আমার কিছু ভাল সুরমার প্রয়োজন আছে।

ম। আমি কাল প্রভাতে এখান হইতে দূরদেশে কিছু দিনের জন্য যাইব।

জে। দূরদেশে যাইবে? কৈ, সে কথা আমাকে কিছু বল নাই!

ম। আজ সে কথা নিবেদন করিব ইচ্ছা ছিল।

জে। কোথায় যাইবে?

ম। রাজপুতানায় রূপনগর নামে গড় আছে। সেখানকার রাও সাহেবের কন্যাকে মহিষী করিবার অভিপ্রায় শাহানশাহের মর্‍‍জি মবারকে হইয়াছে। কাল তাঁহাকে আনিবার জন্য রূপনগরে ফৌজ যাইবে। আমাকে ফৌজের সঙ্গে যাইতে হইবে।

জে। সে বিষয়ে আমার কিছু বলিবার আছে। কিন্তু আগে আর একটি কথার উত্তর দাও। তুমি গণেশ জ্যোতিষীর কাছে ভাগ্য গণাইতে গিয়াছিলে?

ম। গিয়াছিলাম।

জে। কেন গিয়াছিলে?

ম। সবাই যায়, এই জন্য গিয়াছিলাম, এ কথা বলিলেই সঙ্গত উত্তর হয়; কিন্তু তা ছাড়া আরও কারণ ছিল। দরিয়া আমাকে জোর টানিয়া লইয়া গিয়াছিল?

জে। হুঁ!

এই বলিয়া জেব-উন্নিসা কিছুকাল পুষ্পরাশি লইয়া ক্রীড়া করিল। তার পর বলিল, “তুমি গেলে কেন?”

মবারক ঘটনাটা যথাযথ বিবৃত করিলেন। জেব-উন্নিসা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “জ্যোতিষী কি বলিয়াছিল যে, তুমি শাহজাদী বিবাহ কর, তাহা হইতে তোমার শ্রীবৃদ্ধি হইবে?”

ম। হিন্দুরা শাহজাদী বলে না। জ্যোতিষী, রাজপুত্রী বলিয়াছিল।

জে। শাহজাদী কি রাজপুত্রী নয়?

ম। নয় কেন?

জে। তাই কি তুমি সে দিন বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছিলে?

ম। আমি কেবল ধর্মস ভাবিয়া সে কথা বলিয়াছিলাম। আপনার স্মরণ থাকিতে পারে, আমি গণনার পূর্ব হইতে এ কথা বলিতেছি।

জে। কৈ, আমার ত স্মরণ হয় না। তা যাক–সে সকল কথাতে আর কাজ নাই। তোমাকে এত জিজ্ঞাসা করিলাম, তাতে তুমি গোসা করিও না। তোমার গোসায় আমার বড় দুঃখ হইবে। তুমি আমার প্রাণাধিক,-তোমাকে যতক্ষণ দেখি, ততক্ষণ আমি সুখে থাকি। তুমি পালঙ্কের উপর আসিয়া বসো–আমি তোমাকে আতর মাখাই।

জেব-উন্নিসা তখন মবারককে পালঙ্কের উপর বসাইয়া স্বহস্তে আতর মাখাইতে লাগিল। তার পর বলিল, “এখন সেই রূপনগরের কথাটা বলিব। জানি না, রূপনগরীর পিতা তাহাকে ছাড়িয়া দিবে কি না। ছাড়িয়া না দেয়, তবে কাড়িয়া লইয়া আসিবে।”

মবারক বলিল, “এরূপ আদেশ ত বাদশাহের নিকট আমরা পাই নাই।”

জে। এ স্থলে আমাকেই না হয় বাদশাহ মনে করিলে? যদি বাদশাহের এরূপ অভিপ্রায় না হইবে, তবে ফৌজ যাইতেছ কেন?

ম। পথের বিঘ্ননিবারণের জন্য।

জে। আলম্গীঘর বাদশাহের ফৌজ যে কাজে যাইবে, সে কাজে তাহারা নিষ্ফল হইবে? তোমরা যে প্রকারে পার, রূপনগরীকে লইয়া আসিবে। বাদশাহ যদি তাহাতে নাখোশ হন, তবে আমি আছি।

ম। আমার পক্ষে সেই হুকুমই যথেষ্ট তবে, আপনার আপনার এরূপ অভিপ্রায় কেন হইতেছে, জানিতে পারিলে আমার বাহুতে আরও বল হয়।

জেব-উন্নিসা বলিল, “সেই কথাটাই আমি বলিতে চাহিতেছিলাম। এই রূপনগরওয়ালীকে আমার কৌশলেই তলব হইয়াছে।”

ম। মতলব কি?

জে। খুবসুিরৎ। যদি হয়, তবে উদিপুরীর বদলে সেই বাদশাহের উপর প্রভুত্ব করিবে। আমি তাহাকে আনিতেছি, ইহা জানিলে, রূপনগরওয়ালী আমার বশীভূত থাকিবে। তা হ’লেই আমার একাধিপত্যের যে একটু কণ্টক আছে, তাহা দূর হইবে। তা, তুমি যাইতেছ, ভালই হইতেছে। যদি দেখ যে, সে উদিপুরী অপেক্ষা সুন্দরী–

ম। আমি হজরৎ বেগম সাহেবাকে কখনও দেখি নাই।

জে। দেখ ত দেখাইতে পারি–এই পরদা।র আড়ালে লুকাইতে হইবে।

ম। ছি!

জেব-উন্নিসা হাসিয়া উঠিল, বলিল, “দিল্লীতে তোমার মত কয়টা বানর আছে? তা যাক–আমি তোমায় যা বলি শুন। উদিপুরী না দেখ, আমি তাহার তসবির দেখাইতেছি। কিন্তু রূপনগরীকে দেখিও। যদি তাহাকে উদিপুরীর অপেক্ষ সুন্দরী দেখ, তবে তাহাকে জানাইবে যে, আমারই অনুগ্রহে সে বাদশাহের বেগম হইতেছে। আর যদি দেখ দেখিতে তেমন নয়——”

জেব-উন্নিসা একটু ভাবিল। মবারক জিজ্ঞাসা করিল, “যদি দেখি, দেখিতে ভাল নহে, তবে কি করিব?”

জে। তুমি বড় বিবাহ ভালবাস; তুমি আপনি বিবাহ করিও। বাদশাহ যাহাতে অনুমতি দেন, তাহা আমি করিব।

ম। অধমের প্রতি কি আপনার একটু ভালবাসাও নাই?

জে। বাদশাহজাদীদের আবার ভালবাসা!

ম। আল্লা তবে বাদশাহজাগীদিগকে কি জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন?

জে। সুখের জন্য! ভালবাসা দুঃখ মাত্র।

মবারক আর শুনিতে ইচ্ছা করিল না। কথা চাপা দিয়া কহিল, “যিনি বাদশাহের বেগম হইবেন, তাঁহাকে আমি দেখিব কি প্রকারে?”

জে। কোন কলকৌশলে।

ম। শুনিলে বাদশাহ কি বলিবেন?

জে। সে দায়-দোষ আমার।

ম। আপনি যা বলিবেন, তাই করিব। কিন্তু এ গরীবকে একটু ভালবাসিতে হইবে।

জে। বলিলাম না যে, তুমি আমার প্রাণাধিক?

ম। ভালবাসিয়া বলিয়াছেন কি?

জে। বলিয়াছি, ভালবাসা গরীব-দুঃখীর দুঃখ। শাহজাদীরা সে দুঃখ স্বীকার করে না। মর্মািহত হইয়া মবারক বিদায় লইয়া চলিয়া গেল।

Leave a Reply