» » » প্রথম পরিচ্ছেদ : বক ও হংসীর কথা

বর্ণাকার

নির্মল ধীরে ধীরে রাজকুমারীর কাছে গিয়া বসিলেন। দেখিলেন, রাজকুমারী একা বসিয়া কাঁদিতেছেন। সে দিন যে চিত্রগুলি ক্রীত হইয়াছিল, তাহার একখানি রাজকুমারীর হাতে দেখিলেন। নির্মলকে দেখিয়া চঞ্চল চিত্রখানি উল্টাইয়া রাখিলেন— কাহার চিত্র, নির্মলের তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। নির্মল কাছে গিয়া বসিয়া বলিল, “এখন উপায়?”

চ। উপায় যাই হউক— আমি মোগলের দাসী কখনই হইব না।

নি। তোমার অমত, তা ত জানি, কিন্তু আলম্‌গীর বাদশাহের হুকুম, রাজার কি সাধ্য যে, অন্যথা করেন? উপায় নাই, সখি!—সুতরাং তোমাকে ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। আর স্বীকার করা ত সৌভাগ্যের বিষয়। যোধপুর বল, অম্বর বল; রাজা, বাদশাহ, ওমরাহ, নবাব, সুবা যাহা বল, পৃথিবীতে এত বড় লোক কে আছে যে, তাহার কন্যা দিল্লীর তক্তে বসিতে বাসনা করে না? পৃথিবীশ্বরী হইতে তোমার এত অসাধ কেন?

চঞ্চল রাগ করিয়া বলিল, “তুই এখান হইতে উঠিয়া যা।”

নির্মল দেখিল, ও পথে কিছু হইবে না। তবে আর কোন পথে রাজকুমারীর কিছু উপকার যদি করিতে পারে, তাহার সন্ধান করিতে লাগিল। বলিল, “আমি যেন উঠিয়া গেলাম— কিন্তু যাঁহার দ্বারা প্রতিপালিত হইতেছি, আমাকে তাঁহার হিত খুঁজিতে হয়। তুমি যদি দিল্লী না যাও, তবে তোমার বাপের দশা কি হইবে, তাহা কি একবার ভাবিয়াছ?”

চঞ্চল। ভাবিয়াছি। আমি যদি না যাই, তবে আমার পিতার কাঁধে মাথা থাকিবে না– রূপনগরের গড়ের একখানি পাথর থাকিবে না, তা ভাবিয়াছি–আমি পিতৃহত্যা করিব না। বাদশাহের ফৌজ আসিলেই আমি তাহাদিগের সঙ্গে দিল্লী যাত্রা করিব। ইহা স্থির করিয়াছি।

নির্মল প্রসন্ন হইল। বলিল, “আমিও সেই পরামর্শই দিতেছিলাম।”

রাজকুমারী ভ্রূভঙ্গী করিলেন— বলিলেন, “তুই কি মনে করেছিস যে, আমি দিল্লীতে গিয়া মুসলমান বানরের শয্যায় শয়ন করিব? হংসী কি বকের সেবা করে?”

নির্মল কিছুই বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি করিবে?”

চঞ্চলকুমারী হস্তের একটি অঙ্গুরীয় নির্মলকে দেখাইল; বলিল, “দিল্লীর পথে বিষ খাইব।” নির্মল জানিত, ঐ অঙ্গুরীয়তে বিষ আছে।

নির্মল বলিল, “আর কি কোন উপায় নাই?”

চঞ্চল বলিল, “আর উপায় কি সখি? কে এমন বীর পৃথিবীতে আছে যে, আমায় উদ্ধার করিয়া দিল্লীশ্বরের সহিত শত্রুতা করিবে? রাজপুতানার কুলাঙ্গার সকলই মোগলের দাস— আর কি সংগ্রাম আছে, না প্রতাপ আছে?”

নি। কি বল রাজকুমারী! সংগ্রাম, কি প্রতাপ যদি থাকিত, তবে তাহারাই বা তোমার জন্য সর্বস্ব পণ করিয়া দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে বিবাদ করিবে কেন? পরের জন্য কেহ সহজে সর্বস্ব পণ করে না। প্রতাপ নাই, সংগ্রাম নাই, রাজসিংহ আছে— কিন্তু তোমার জন্য রাজসিংহ সর্বস্ব পণ করিবে কেন? বিশেষ তুমি মাড়বারের ঘরাণা।

চ। সে কি? বাহুতে বল থাকিলে কোন্ রাজপুত শরণাগতকে রক্ষা করে নাই? আমি তাই ভাবিতেছিলাম নির্মল! আমি এ বিপদে সেই সংগ্রাম, প্রতাপের বংশতিলকেরই শরণ লইব— তিনি কি আমায় রক্ষা করিবেন না?

বলিতে বলিতে চঞ্চল দেবী ঢাকা ছবিখানি উল্টাইলেন–নির্মল দেখিল, সে রাজসিংহের মূর্তি। চিত্র দেখিয়া রাজকুমারী বলিতে লাগিলেন, “দেখ সখি, এ রাজকান্তি দেখিয়া তোমার কি বিশ্বাস হয় না যে, ইনি অগতির গতি, অনাথার রক্ষক? আমি যদি ইহার শরণ লই, ইনি কি রক্ষা করিবেন না?”

নির্মলকুমারী অতি স্থিরবুদ্ধিশালিনী— চঞ্চলের সহোদরাধিকা। নির্মল অনেক ভাবিল। শেষে চঞ্চলের প্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “রাজকুমারি! যে বীর তোমাকে এ বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবে, তাহাকে তুমি কি দিবে?”

রাজকুমারী বুঝিলেন। কাতর অথচ অধিকম্পিত কণ্ঠে বলিলেন, “কি দিব সখি! আমার কি আর দিবার আছে? আমি যে অবলা!”

নি। তোমার তুমিই আছ।

চঞ্চল অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “দূর হ!”

নির্মল। তা রাজার ঘরে এমন হইয়া থাকে। তুমি যদি রুক্মিণী হইতে পার, যদুপতি আসিয়া অবশ্য উদ্ধার করিতে পারেন।

চঞ্চলকুমারী মুখাবনত করিল। যেমন সূর্যোাদয়কালে মেঘমালার উপর আলোর তরঙ্গের পর উজ্জ্বলতর তরঙ্গ আসিয়া পলকে পলকে নূতন সৌন্দর্য্য উন্মেষিত করে, চঞ্চলকুমারীর মুখে তেমনই পলকে পলকে সুখের, লজ্জার, সৌন্দর্য্যের নবনবোন্মেষ হইতে লাগিল। বলিল, “তাঁহাকে পাইব, আমি কি এমন ভাগ্য করিয়াছি? আমি বিকাইতে চাহিলে তিনি কি কিনিবেন?”

নি। সে কথার বিচারক তিনি— আমরা নই। রাজসিংহের বাহুতে শুনিয়াছি, বল আছে; তাঁর কাছে কি দূত পাঠান যায় না? গোপনে— কেহ না জানিতে পারে, এরূপ দূত কি তাঁহার কাছে যায় না?

চঞ্চল ভাবিল। বলিল, “তুমি আমার গুরুদেবকে ডাকিতে পাঠাও। আমায় আর কে তেমন ভালবাসে? কিন্তু তাঁহাকে সকল কথা বুঝাইয়া বলিয়া আমার কাছে আনিও। সকল কথা বলিতে আমার লজ্জা করিবে।”

এমন সময়ে সখীজন সংবাদ লইয়া আসিল যে, একজন মতিওয়ালী মতি বেচিতে আসিয়াছে। রাজকুমারী বলিলেন, “এখন আমার মতি কিনিবার সময় নহে। ফিরাইয়া দাও।” পুরবাসিনী বলিল, “আমরা ফিরাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু সে কিছুতেই ফিরিল না। বোধ হইল যেন, তার কি বিশেষ দরকার আছে?” তখন অগত্যা চঞ্চলকুমারী তাহাকে ডাকিলেন।

মতিওয়ালী আসিয়া কতকগুলি ঝুটা মতি দেখাইল। রাজকুমারী বিরক্তি হইয়া বলিলেন, “এই ঝুটা মতি দেখাইবার জন্য তুমি এত জিদ করিতেছিলে?”

মতিওয়ালী বলিল, “না। আমার আরও দেখাইবার জিনিস আছে। কিন্তু তাহা আপনি একটু পুষিদা না হইলে দেখাইতে পারি না।”

চঞ্চলকুমারী বলিল, “আমি একা তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পারিব না; কিন্তু একজন সখী থাকিবে। নির্মল থাক, আর সকলে বাহিরে যাও।”

তখন আর সকলে বাহিরে গেল। দেবী— সে মতিওয়ালী দেবী ভিন্ন আর কেহ নয়— যোধপুরী বেগমের পাঞ্জা দেখাইল। দেখিয়া, পড়িয়া চঞ্চলকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ পাঞ্জা তুমি কোথায় পাইলে?”

দে। যোধপুরী বেগম আমাকে দিয়াছেন।

চ। তুমি তাঁর কে?

দে। আমি তার বাঁদী।

চ। কেনই বা এ পাঞ্জা লইয়া এখানে আসিয়াছ?

দেবী তখন সকল কথা বুঝাইয়া বলিল। শুনিয়া নির্মল ও চঞ্চল পরস্পরের মুখপানে চাহিতে লাগিলেন।

চঞ্চল, দেবীকে পুরস্কৃত করিয়া বিদায় দিলেন।

দেবী যাইবার সময় যোধপুরীর পাঞ্জাখানী লইয়া গেল না। ইচ্ছাপূর্বক রাখিয়া গেল। মনে করিল, “কোথায় ফেলিয়া দিব,— কে কুড়াইয়া নিবে!” এই ভাবিয়া দেবী চঞ্চলকুমারীর নিকট পাঞ্জা ফেলিয়া গেল। সে গেলে পর চঞ্চলকুমারী বলিলেন, “নির্মল! উহাকে ডাক; সে পাঞ্জাখানা ফেলিয়া গিয়াছে।”

নি। ফেলিয়া যায় নাই— বোধ হইল যে, ইচ্ছাপূর্বক রাখিয়া গিয়াছে।

চ। আমি নিয়া কি করিব?

নির্মল। এখন রাখ, কোন সময়ে না কোন সময়ে যোধপুরীকে ফেরৎ দিতে পারিবে।

চ। তা যাই হোক, বেগমের কথায় আমার বড় সাহস বাড়িল। আমরা দুইটি বালিকায় কি পরামর্শ করিতেছিলাম— তা ভাল, কি মন্দ— ঘটিবে কি না ঘটিবে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছিলাম না। এখন সাহস হইয়াছে। রাজসিংহের আশ্রয় গ্রহণ করাই ভাল।

নি। সে ত অনেক কাল জানি।

এই বলিয়া নির্মল হাসিল। চঞ্চলও মাথা হেঁট করিয়া হাসিল।

নির্মল উঠিয়া গেল। কিন্তু তাহার মনে কিছুমাত্র ভরসা হইল না। সে কাঁদিতে কাঁদিতে গেল।

Leave a Reply