মহারাণার সাক্ষাৎ পাইয়া, প্রণাম করিয়া মাণিকলাল যুক্তকরে নিবেদন করিলেন, “যদি এ দাসকে অন্য কোন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান মহারাজের অভিপ্রায় হয়, তবে বড় অনুগৃহীত হইব৷”
রাণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, এখানে কি হইয়াছে?”
মাণিকলাল উত্তর করিল, “এখানে ত কোন কাজ নাই। কাজের মধ্যে ক্ষুধার্ত মোগলদিগের শুষ্ক মুখ দেখা ও আর্তনাদ শুনা। তাহা কখনও কখনও পর্বতের উপর গাছে চড়িয়া দেখিয়া আসিতেছি। কিন্তু সে কাজ, যে সে পারিবে। আমি ভাবিতেছি কি যে, এতগুলা মানুষ, হাতী, ঘোড়া, উট, এই রন্ধ্রে পচিয়া মরিয়া থাকিবে,-দুর্গন্ধে উদয়পুরেও কেহ বাঁচিবে না–বড় মড়ক উপস্থিত হইবে৷”
রাণা বলিলেন, “অতএব তোমার বিবেচনা এই, মোগল সেনাকে অনাহারে মারিয়া ফেলা অকর্তব্য?”
মাণিক। বোধ হয়। যুদ্ধে লক্ষ জনকে মারিলেও দেখিয়া দু:খ হয় না। বসিয়া বসিয়া অনাহারে একজন লোকও মরিলে দু:খ হয়।
রাণা। তবে উহাদিগের সম্বন্ধে কি করা যায়?
মাণিক। মহারাজ! আমার এত বুদ্ধি নাই যে, আমি এমন বিষয়ে পরামর্শ দিই। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে সন্ধিসংস্থাপনের এই উত্তম সময়। জঠরাগ্নির দাহের সময়ে মোগল যেমন নরম হইবে, ভরা পেটে তেমন হইবে না। আমার বোধ হয়, রাজমন্ত্রিগণ ও সেনাপতিগণকে ডাকিয়া পরামর্শ করিয়া এ বিষয়ের মীমাংসা করা ভাল।
রাজসিংহ এ প্রস্তাবে সম্মত ও স্বীকৃত হইলেন। উপবাসে এত মানুষ মারাও তাঁহার ইচ্ছা নহে। হিন্দু, ক্ষুধার্তের অন্ন যোগান পরমধর্ম বলিয়া জানে। অতএব হিন্দু, শত্রুকেও সহজে উপবাসে মারিতে চাহে না।
সন্ধ্যার পর শিবিরে রাজসভা সমবেত হইল। তথা প্রধান সেনাপতিগণ, প্রধান রাজমন্ত্রিগণ উপস্থিত হইলেন। রাজমন্ত্রিগণের মধ্যে প্রধান দয়াল সাহা। তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মাণিকলালও ছিল।
রাজসিংহ বিচার্য্ বিষয়টা সকলকে বুঝাইয়া দিয়া, সভাসদগণের মত জিজ্ঞাসা করিলেন। অনেকেই বলিলেন, “মোগল ঐখানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিয়া পচিয়া থাকুক–ঔরঙ্গজেব বেটাকে ধরিয়া আনিয়া উহাদের গোর দেওয়াইব। না হয়, দোসাদের দল আনিয়া মাটি চাপা দেওয়াইব। মোগল হইতে বার বার রাজপুতের যে অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা স্মরণ করিলে, কাহারও ইচ্ছা হইবে না যে, মোগলকে হাতে পাইয়া ছাড়া যায় |”
ইহার উত্তরে মহারাণা বলিলেন, “না হয় স্বীকার করিলাম যে, এই মোগলদিগকে এইখানে শুকাইয়া মারিয়া মাটি চাপা দেওয়া গেল। কিন্তু ঔরঙ্গজেব আর ঔরঙ্গজেবের উপস্থিত সৈন্যগণ মরিলেই মোগল নি:শেষ হইল না। ঔরঙ্গজেব মরিলে শাহ আলম বাদশাহ হইবে। শাহ আলমের সঙ্গে দাক্ষিণাত্য-বিজয়ী মহাসৈন্য পর্বতের অপর পারে সশস্ত্রে উপস্থিত আছে। আর দুইটা মোগলসেনা আর দুই দিকে বসিয়া আছে। আমরা কি এই সকলগুলিকে নি:শেষ ধ্বংস করিতে পারিব? যদি না পারি, তবে অবশ্য একদিন সন্ধিস্থাপন করিতে হইবে। যদি সন্ধি করিতে হয়, তবে এমন সুসময় আর কবে হইবে? এখন ঔরঙ্গজেবের প্রাণ কণ্ঠাগত–এখন তাহার কাছে যাহা চাহিব, তাহা পাইব। সময়ান্তরে কি তেমন পাইব?”
দয়াল সাহা বলিলেন, “নাই পাইলাম। তবু এই মহাপাপিষ্ঠ পৃথিবীর কণ্টকস্বরূপ ঔরঙ্গজেবকে বধ করিলে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করা হইবে। এমন পুণ্য আর কোন কার্যে নাই, মহারাজ মতান্তর করিবেন না |”
রাজসিংহ বলিলেন, “সকল মোগল বাদশাহই দেখিলাম–পৃথিবীর কণ্টক। ঔরঙ্গজেব শাহজাঁহার অপেক্ষাও কি নরাধম? খস্রু হইতে আমাদের যত অমঙ্গল ঘটিয়াছে, ঔরঙ্গজেব হইতে কি তত হইয়াছে? শাহ আলম যে পিতৃপিতামহ হইতেও দুরাচার না হইবে, তাহার স্থিরতা কি? আর তোমরা যদি এমন ভরসাই কর–সে ভরসা আমিও না করি, তা নয়–যে এই চারিটি মোগল সেনাই আমরা পরাজিত করিতে পারিব, তবে ভাবিয়া দেখ, কত অসংখ্য মনুষ্যহত্যার পর সে আশা ফলে পরিণত হইবে। কত অসংখ্য রাজপুত বিনষ্ট হইবে। অবশিষ্ট থাকিবে কয় জন? আমরা অল্পসংখ্যক; মুসলমান বহুসংখ্যক। আমরা সংখ্যায় কমিয়া গেলে, আবার যদি মোগল আসে, তবে কার বাহুবলে তাদের আবার তাড়াইব?”
দয়াল সাহা বলিল, “মহারাজ! সমস্ত রাজপুতানা একত্রিত হইলে মোগলকে সিন্ধু পার করিয়া রাখিয়া আসিতে কতক্ষণ লাগে?”
রাজসিংহ বলিলেন, “সে কথা সত্য। কিন্তু তাহা কখন হইয়াছে কি? এখনও ত সে চেষ্টা করিতেছি–ঘটিতেছে কি? তবে সে ভরসা কি প্রকারে করিব?”
দয়াল সাহা বলিলেন, “সন্ধি হইলেও ঔরঙ্গজেব সন্ধি রক্ষা করিবে, এমন ভরসা করি না। অমন মিথ্যাবাদী, ভণ্ড কখনও জন্মগ্রহণ করে নাই। মুক্তি পাইলেই, সে সন্ধিপত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, যা করিতেছিল, তাহাই করিবে |”
রাজসিংহ বলিলেন, “তাহা ভাবিলে কখনই সন্ধি করা হয় না। তাই কি মত?”
এইরূপ অনেক বিচার হইল। পরিশেষে সকলেই রাণার কথার যথার্থ্য স্বীকার করিলেন।
সন্ধিস্থাপনের কথাই স্থির হইল।
তখন কেহ আপত্তি করিল, “ঔরঙ্গজেব ত কই, সন্ধির চেষ্টায় দূত পাঠান নাই। তাঁর গরজ, না আমাদের গরজ?”
তাহাতে রাজসিংহ উত্তর করিলেন, “দূত আসিবে কি প্রকারে? সে রন্ধ্রপথের ভিতর হইতে একটি পিঁপড়া উপরে আসিবার পথ রাখি নাই |”
দয়াল সাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে আমাদেরই বা দূত যাইবে কি প্রকারে? সেবার ঔরঙ্গজেব আমাদিগের দূতকে বধ করিবার আজ্ঞা দিয়াছিল, এবার যে সে আজ্ঞা দিবে না, তার ঠিকানা কি?”
রাজসিংহ বলিলেন, “এবার যে বধ করিবে না, তাহা স্থির। কেন না, এখন কপট সন্ধিতেও তাহার মঙ্গল। তবে দূত যেখানে যাইবে কি প্রকারে, তাহার গোলযোগ আছে বটে |”
তখন মাণিকলাল নিবেদন করিল, “সে ভার আমার উপর অর্পিত হউক। আমি মহারাণার পত্র ঔরঙ্গজেবের নিকট পৌঁছাইয়া দিব, এবং উত্তর আনিয়া দিব |”
সকলেই সে কথায় বিশ্বাস করিল; কেন না, সকলেই জানিত, কৌশলে ও সাহসে মাণিকলাল অদ্বিতীয়। অতএব পত্র লিখিবার হুকুম হইল। দয়াল সাহা পত্র প্রস্তুত করাইলেন। তাহার মর্ম এই যে–বাদশাহ, সমস্ত সৈন্য মেবার হইতে উঠাইয়া লইয়া যাইবেন। মেবারে গোহত্যা ও দেবালয়ভঙ্গ নিবারণ করিবেন, এবং জেজেয়ার কোন দাবি করিবেন না। তাহা হইলে রাজসিংহ পথ মুক্ত করিয়া দিবেন, নিরুদ্বেগে বাদশাহকে যাইতে দিবেন।
পত্র সভাসদ সকলকে শুনান হইল। শুনিয়া মাণিকলাল বলিল, “বাদশাহের স্ত্রী-কন্যা আমাদিগের নিকট বন্দী আছে। তাহারা থাকিবে?”
বলিবামাত্র সভামধ্যে একটা হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। সকলে একবাক্যে বলিল, “ছাড়া হইবে না |” কেহ বলিল, “থাক। উহারা মহারাণার আঙ্গিনা ঝাঁটাইবে |” কেহ বলিল, “উহাদের ঢাকায় পাঠাইয়া দাও। হিন্দু হইয়া, বৈষ্ণবী সাজিয়া, হরিনাম করিবে |” কেহ বলিল, “উহাদের মূল্যস্বরূপ এক এক ক্রোর টাকা বাদশাহ দিবেন |” ইত্যাদি নানা প্রকার প্রস্তাব হইল। মহারাণা বলিলেন, “দুইটা মুসলমান বাঁদীর জন্য সন্ধি ত্যাগ করা হইবে না। সে দুইটাকে ফিরাইয়া দিব, লিখিয়া দাও |”
সেইরূপ লেখা হইল। পত্রখানি মাণিকলালের জিম্মা হইল। তখন সভাভঙ্গ হইল।
রাণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, এখানে কি হইয়াছে?”
মাণিকলাল উত্তর করিল, “এখানে ত কোন কাজ নাই। কাজের মধ্যে ক্ষুধার্ত মোগলদিগের শুষ্ক মুখ দেখা ও আর্তনাদ শুনা। তাহা কখনও কখনও পর্বতের উপর গাছে চড়িয়া দেখিয়া আসিতেছি। কিন্তু সে কাজ, যে সে পারিবে। আমি ভাবিতেছি কি যে, এতগুলা মানুষ, হাতী, ঘোড়া, উট, এই রন্ধ্রে পচিয়া মরিয়া থাকিবে,-দুর্গন্ধে উদয়পুরেও কেহ বাঁচিবে না–বড় মড়ক উপস্থিত হইবে৷”
রাণা বলিলেন, “অতএব তোমার বিবেচনা এই, মোগল সেনাকে অনাহারে মারিয়া ফেলা অকর্তব্য?”
মাণিক। বোধ হয়। যুদ্ধে লক্ষ জনকে মারিলেও দেখিয়া দু:খ হয় না। বসিয়া বসিয়া অনাহারে একজন লোকও মরিলে দু:খ হয়।
রাণা। তবে উহাদিগের সম্বন্ধে কি করা যায়?
মাণিক। মহারাজ! আমার এত বুদ্ধি নাই যে, আমি এমন বিষয়ে পরামর্শ দিই। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে সন্ধিসংস্থাপনের এই উত্তম সময়। জঠরাগ্নির দাহের সময়ে মোগল যেমন নরম হইবে, ভরা পেটে তেমন হইবে না। আমার বোধ হয়, রাজমন্ত্রিগণ ও সেনাপতিগণকে ডাকিয়া পরামর্শ করিয়া এ বিষয়ের মীমাংসা করা ভাল।
রাজসিংহ এ প্রস্তাবে সম্মত ও স্বীকৃত হইলেন। উপবাসে এত মানুষ মারাও তাঁহার ইচ্ছা নহে। হিন্দু, ক্ষুধার্তের অন্ন যোগান পরমধর্ম বলিয়া জানে। অতএব হিন্দু, শত্রুকেও সহজে উপবাসে মারিতে চাহে না।
সন্ধ্যার পর শিবিরে রাজসভা সমবেত হইল। তথা প্রধান সেনাপতিগণ, প্রধান রাজমন্ত্রিগণ উপস্থিত হইলেন। রাজমন্ত্রিগণের মধ্যে প্রধান দয়াল সাহা। তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মাণিকলালও ছিল।
রাজসিংহ বিচার্য্ বিষয়টা সকলকে বুঝাইয়া দিয়া, সভাসদগণের মত জিজ্ঞাসা করিলেন। অনেকেই বলিলেন, “মোগল ঐখানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিয়া পচিয়া থাকুক–ঔরঙ্গজেব বেটাকে ধরিয়া আনিয়া উহাদের গোর দেওয়াইব। না হয়, দোসাদের দল আনিয়া মাটি চাপা দেওয়াইব। মোগল হইতে বার বার রাজপুতের যে অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা স্মরণ করিলে, কাহারও ইচ্ছা হইবে না যে, মোগলকে হাতে পাইয়া ছাড়া যায় |”
ইহার উত্তরে মহারাণা বলিলেন, “না হয় স্বীকার করিলাম যে, এই মোগলদিগকে এইখানে শুকাইয়া মারিয়া মাটি চাপা দেওয়া গেল। কিন্তু ঔরঙ্গজেব আর ঔরঙ্গজেবের উপস্থিত সৈন্যগণ মরিলেই মোগল নি:শেষ হইল না। ঔরঙ্গজেব মরিলে শাহ আলম বাদশাহ হইবে। শাহ আলমের সঙ্গে দাক্ষিণাত্য-বিজয়ী মহাসৈন্য পর্বতের অপর পারে সশস্ত্রে উপস্থিত আছে। আর দুইটা মোগলসেনা আর দুই দিকে বসিয়া আছে। আমরা কি এই সকলগুলিকে নি:শেষ ধ্বংস করিতে পারিব? যদি না পারি, তবে অবশ্য একদিন সন্ধিস্থাপন করিতে হইবে। যদি সন্ধি করিতে হয়, তবে এমন সুসময় আর কবে হইবে? এখন ঔরঙ্গজেবের প্রাণ কণ্ঠাগত–এখন তাহার কাছে যাহা চাহিব, তাহা পাইব। সময়ান্তরে কি তেমন পাইব?”
দয়াল সাহা বলিলেন, “নাই পাইলাম। তবু এই মহাপাপিষ্ঠ পৃথিবীর কণ্টকস্বরূপ ঔরঙ্গজেবকে বধ করিলে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করা হইবে। এমন পুণ্য আর কোন কার্যে নাই, মহারাজ মতান্তর করিবেন না |”
রাজসিংহ বলিলেন, “সকল মোগল বাদশাহই দেখিলাম–পৃথিবীর কণ্টক। ঔরঙ্গজেব শাহজাঁহার অপেক্ষাও কি নরাধম? খস্রু হইতে আমাদের যত অমঙ্গল ঘটিয়াছে, ঔরঙ্গজেব হইতে কি তত হইয়াছে? শাহ আলম যে পিতৃপিতামহ হইতেও দুরাচার না হইবে, তাহার স্থিরতা কি? আর তোমরা যদি এমন ভরসাই কর–সে ভরসা আমিও না করি, তা নয়–যে এই চারিটি মোগল সেনাই আমরা পরাজিত করিতে পারিব, তবে ভাবিয়া দেখ, কত অসংখ্য মনুষ্যহত্যার পর সে আশা ফলে পরিণত হইবে। কত অসংখ্য রাজপুত বিনষ্ট হইবে। অবশিষ্ট থাকিবে কয় জন? আমরা অল্পসংখ্যক; মুসলমান বহুসংখ্যক। আমরা সংখ্যায় কমিয়া গেলে, আবার যদি মোগল আসে, তবে কার বাহুবলে তাদের আবার তাড়াইব?”
দয়াল সাহা বলিল, “মহারাজ! সমস্ত রাজপুতানা একত্রিত হইলে মোগলকে সিন্ধু পার করিয়া রাখিয়া আসিতে কতক্ষণ লাগে?”
রাজসিংহ বলিলেন, “সে কথা সত্য। কিন্তু তাহা কখন হইয়াছে কি? এখনও ত সে চেষ্টা করিতেছি–ঘটিতেছে কি? তবে সে ভরসা কি প্রকারে করিব?”
দয়াল সাহা বলিলেন, “সন্ধি হইলেও ঔরঙ্গজেব সন্ধি রক্ষা করিবে, এমন ভরসা করি না। অমন মিথ্যাবাদী, ভণ্ড কখনও জন্মগ্রহণ করে নাই। মুক্তি পাইলেই, সে সন্ধিপত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, যা করিতেছিল, তাহাই করিবে |”
রাজসিংহ বলিলেন, “তাহা ভাবিলে কখনই সন্ধি করা হয় না। তাই কি মত?”
এইরূপ অনেক বিচার হইল। পরিশেষে সকলেই রাণার কথার যথার্থ্য স্বীকার করিলেন।
সন্ধিস্থাপনের কথাই স্থির হইল।
তখন কেহ আপত্তি করিল, “ঔরঙ্গজেব ত কই, সন্ধির চেষ্টায় দূত পাঠান নাই। তাঁর গরজ, না আমাদের গরজ?”
তাহাতে রাজসিংহ উত্তর করিলেন, “দূত আসিবে কি প্রকারে? সে রন্ধ্রপথের ভিতর হইতে একটি পিঁপড়া উপরে আসিবার পথ রাখি নাই |”
দয়াল সাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে আমাদেরই বা দূত যাইবে কি প্রকারে? সেবার ঔরঙ্গজেব আমাদিগের দূতকে বধ করিবার আজ্ঞা দিয়াছিল, এবার যে সে আজ্ঞা দিবে না, তার ঠিকানা কি?”
রাজসিংহ বলিলেন, “এবার যে বধ করিবে না, তাহা স্থির। কেন না, এখন কপট সন্ধিতেও তাহার মঙ্গল। তবে দূত যেখানে যাইবে কি প্রকারে, তাহার গোলযোগ আছে বটে |”
তখন মাণিকলাল নিবেদন করিল, “সে ভার আমার উপর অর্পিত হউক। আমি মহারাণার পত্র ঔরঙ্গজেবের নিকট পৌঁছাইয়া দিব, এবং উত্তর আনিয়া দিব |”
সকলেই সে কথায় বিশ্বাস করিল; কেন না, সকলেই জানিত, কৌশলে ও সাহসে মাণিকলাল অদ্বিতীয়। অতএব পত্র লিখিবার হুকুম হইল। দয়াল সাহা পত্র প্রস্তুত করাইলেন। তাহার মর্ম এই যে–বাদশাহ, সমস্ত সৈন্য মেবার হইতে উঠাইয়া লইয়া যাইবেন। মেবারে গোহত্যা ও দেবালয়ভঙ্গ নিবারণ করিবেন, এবং জেজেয়ার কোন দাবি করিবেন না। তাহা হইলে রাজসিংহ পথ মুক্ত করিয়া দিবেন, নিরুদ্বেগে বাদশাহকে যাইতে দিবেন।
পত্র সভাসদ সকলকে শুনান হইল। শুনিয়া মাণিকলাল বলিল, “বাদশাহের স্ত্রী-কন্যা আমাদিগের নিকট বন্দী আছে। তাহারা থাকিবে?”
বলিবামাত্র সভামধ্যে একটা হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। সকলে একবাক্যে বলিল, “ছাড়া হইবে না |” কেহ বলিল, “থাক। উহারা মহারাণার আঙ্গিনা ঝাঁটাইবে |” কেহ বলিল, “উহাদের ঢাকায় পাঠাইয়া দাও। হিন্দু হইয়া, বৈষ্ণবী সাজিয়া, হরিনাম করিবে |” কেহ বলিল, “উহাদের মূল্যস্বরূপ এক এক ক্রোর টাকা বাদশাহ দিবেন |” ইত্যাদি নানা প্রকার প্রস্তাব হইল। মহারাণা বলিলেন, “দুইটা মুসলমান বাঁদীর জন্য সন্ধি ত্যাগ করা হইবে না। সে দুইটাকে ফিরাইয়া দিব, লিখিয়া দাও |”
সেইরূপ লেখা হইল। পত্রখানি মাণিকলালের জিম্মা হইল। তখন সভাভঙ্গ হইল।