বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রাজসিংহ

ভূমিকা1

‘রাজসিংহ’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র ঐতিহাসিক উপন্যাস। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের পর উপন্যাসটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। এরপর ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত চতুর্থ সংস্করণে আমূল পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের পর উপন্যাসটির কলেবর পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসটির বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন।

প্রকাশ

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১২৮৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে বঙ্গদর্শন পুনঃপ্রকাশিত হলে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম সংখ্যা থেকেই লিখতে শুরু করেন। ওই বছরের মাঘ সংখ্যায় তিনি কৃষ্ণকান্তের উইল শেষ করেন। এক মাস বাদ দিয়ে চৈত্র (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল) সংখ্যা থেকে লিখতে শুরু করেন রাজসিংহ। ১২৮৫ সালের ভাদ্র মাস পর্যন্ত ছয়টি সংখ্যায় লিখে উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্র অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখে দিয়েছিলেন। তিন বছর পরে ১২৮৮ বঙ্গাব্দে (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ) রাজসিংহ সরাসরি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটির আখ্যাপত্রে রাজসিংহ নামটির পাশে আলাদা ভাবে “ক্ষুদ্র কথা”ও লেখা ছিল।

প্রথম সংস্করণে এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৮৩। ১২৯২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে উপন্যাসটির পৃষ্ঠাসংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৯০। দ্বিতীয় সংস্করণের সময় বঙ্কিমচন্দ্র এটিকে তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপন্যাস গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেন। তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত সামান্য পরিবর্তনের ফলে পৃষ্ঠাসংখ্যা একই থাকে। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ অগস্ট রাজসিংহ-এর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণটি ব্যাপক পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের ফলে সম্পূর্ণ নতুন রূপ লাভ করে এবং পৃষ্ঠাসংখ্যা অনেকটাই বেড়ে হয় ৪৩৪।

কাহিনী

রাজসিংহ উপন্যাসটি আটটি খণ্ড ও একটি উপসংহার অংশে বিন্যস্ত। আটটি খণ্ডের নাম যথাক্রমে “চিত্রে চরণ”, “নন্দনে নরক”, “বিবাহে বিকল্প”, “রন্ধ্রে রন্ধ্রে”, “অগ্নির আয়োজন”, “অগ্নি উৎপাদন”, “অগ্নি জ্বলিল” ও “আগুনে কে কে পুড়িল?” এবং উপসংহার অংশটি “গ্রন্থকারের নিবেদন” নামে নামাঙ্কিত।

প্রথম খণ্ড : চিত্রে চরণ

প্রথম খণ্ডে মোট পাঁচটি পরিচ্ছেদ আছে। এগুলির নাম যথাক্রমে “তসবীরওয়ালী”, “চিত্রে চরণ”, “চিত্রবিচারণ”, “বুড়ি বড় সতর্ক” ও “দরিয়াবিবি”। রাজকন্যা চঞ্চলকুমারী কর্তৃক ঔরঙ্গজেবের চিত্রে পদাঘাতের কী প্রতিক্রিয়া হল, তাই এই খণ্ডের বিষয়বস্তু।

এক বুড়ি ছবিওয়ালি রূপনগরের রাজপ্রাসাদে বিভিন্ন রাজা-রাজড়াদের ছবি দেখাতে এসেছে। এই ঘটনা দিয়েই উপন্যাসের সূত্রপাত। রাজকন্যা চঞ্চলকুমারী বুড়ির কাছ থেকে ঔরঙ্গজেবের ছবি কিনে সেটিকে লাথি মেরে ভেঙে ফেললেন। রাণা রাজসিংহের বীরমূর্তি রাজকন্যার পছন্দ হল। চঞ্চলকুমারী তাঁর কেনা ছবিগুলির মধ্যে থেকে বারবার রাজসিংহের ছবিটি দেখতে লাগলেন। তাঁর এই দুর্বলতাটি সখী নির্মলকুমারীর কাছে ধরা পড়ে গেল। এদিকে ছবিওয়ালি বুড়ি যাতে রাজকুমারীর চিত্রদলনের খবরটি দিল্লিতে কাউকে না বলে, তার জন্য রাজকুমারীর এক সখী তাকে কিছু বখশিশ দিয়েছিল। কিন্তু বুড়ি তার ছেলের কাছে কথাটি বলার জন্য ছটফট করতে লাগল। শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল। বুড়ির পুত্রবধূ সেই খবরটি দরিয়াবিবি নামে একটি স্ত্রীলোককে বলল। দরিয়াবিবি রওনা হল খবরটি বাদশাহের হারেমে বিক্রি করার জন্য।

দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক

দ্বিতীয় খণ্ডে মোট সাতটি পরিচ্ছেদ আছে। এগুলির নাম যথাক্রমে “অদৃষ্টগণনা”, “জেব-উন্নিসা”, “ঐশ্বর্য-নরক”, “সংবাদ-বিক্রয়”, “উদিপুরী বেগম”, “যোধপুরী বেগম” ও “খোদা শাহজাদী গড়েন কেন?”। এই অংশে মোগল-হারেমের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই হারেম ঐশ্বর্য ও আড়ম্বরে নন্দনকাননের সমতুল্য। কিন্তু তার অন্তঃপুরে নরকের পাপাচার বিরাজ করছে।

মবারক নামে এক উচ্চপদস্থ মোগল রাজপুরুষকে দরিয়াবিবি জোর করে এক বিখ্যাত জ্যোতিষীর কাছে তাঁর হাত দেখাতে বাধ্য করলেন। পরে দরিয়াবিবি ঔরঙ্গজেবের কন্যা জেব-উন্নিসার কাছে আসতে গিয়ে দেখল, মবারক সেখানে ঢুকছে। তাই সে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মবারক জেব-উন্নিসার প্রণয়প্রার্থী। কিন্তু শাহজাদি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হলেন না। কারণ বিয়ে করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। বাইরে বেরিয়ে মবারক দরিয়াবিবিকে দেখতে পেলেন। তারপর দরিয়াবিবি জেব-উন্নিসার কামরায় গিয়ে কথাবার্তায় শাহজাদীকে বলল যে, মবারকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। শুনে শাহজাদির রাগ হল। শেষে দরিয়াবিবি রূপনগরের চিত্রদলনের কাহিনিটি বলল জেব-উন্নিসাকে। শাহজাদি ঔরঙ্গজেবের খ্রিস্টান বেগম সুরাসক্ত উদিপুরীর কাছে রূপনগরের খবরটি দিয়ে বাদশাহের কানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ঔরঙ্গজেব চঞ্চলকুমারীকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। সেই খবর শুনে বাদশাহের প্রধানা মহিষী হিন্দু যোধপুরী বেগম উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি দেবী নামে এক দাসীকে রূপনগরে পাঠালেন চঞ্চলকুমারীকে এই কথা বলতে যে, তিনি যেন মোগল-হারেমে আসার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে মবারক জেব-উন্নিসার সঙ্গে কথাবার্তায় পুনরায় তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেন এবং বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু জেব-উন্নিসা বললেন, “ভালবাসা গরীব-দুঃখীর দুঃখ। সে দুঃখ শাহজাদীরা স্বীকার করে না।”

তৃতীয় খণ্ড : বিবাহে বিকল্প

তৃতীয় খণ্ডে মোট দশটি পরিচ্ছেদ আছে। এগুলির নাম যথাক্রমে “বক ও হংসীর কথা”, “অনন্ত মিশ্র”, “মিশ্র ঠাকুরের নারায়ণ স্মরণ”, “মাণিকলাল”, “চঞ্চলকুমারীর পত্র”, “মাতাজীকি জয়”, “নিরাশা”, “মেহেরজান”, “প্রভুভক্তি” ও “রসিকা পানওয়ালী”। চঞ্চলকুমারীকে ঔরঙ্গজেব বিবাহের জন্য সেনা পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে চঞ্চলকুমারী বিবাহের বিকল্প ব্যবস্থা করছেন রাজসিংহের সঙ্গে। এই ঘটনাগুলিই এই খণ্ডের উপজীব্য।

যোধপুরী বেগমের দূতী এসে সমস্ত কথা চঞ্চলকুমারীকে বললে রাজকুমারী তাঁর পিতৃকুলের পুরোহিত অনন্ত মিশ্রকে ডেকে একটি চিঠি লিখে রাণা রাজসিংহের কাছে তাঁকে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। অনন্ত মিশ্র রাজসিংহের কাছে যাওয়ার পথে ডাকাতের হাতে পড়লে সেই চিঠিও ডাকাতদলের হস্তগত হল। সেই ডাকাতদলটিকে আবার রাণা রাজসিংহ একলাই পরাস্ত করলেন। মাণিকলাল নামে দলের একজনই কেবল রক্ষা পেল। সে রাণাকে কথা দিল, রাণার জন্য সে সাধ্যমতো কাজ করবে। অনন্ত মিশ্রের কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটি মাণিকলাল রাজসিংহকে দিলেন। রাজসিংহ রাজধানীতে না ফিরে উদয়পুরের দিকে চললেন। এমন সময় তাঁর সৈন্যসামন্ত “মাতাজীকি জয়” ধ্বনি দিয়ে তাঁর সঙ্গে এসে মিলিত হল। ওদিকে রাজসিংহের কাছ থেকে তাঁর চিঠির কোনো উত্তর না পেয়ে চঞ্চলকুমারী নিরাশ হলেন। মোগল সেনা চঞ্চলকুমারীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রূপনগরে এসে তাঁবু ফেলল। সেই তাঁবুর মধ্যে মেহেরজান নামে এক নর্তকীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। এই মেহেরজানই দরিয়াবিবি। মাণিকলাল তার মেয়ের একটা ব্যবস্থা করে রাণার খোঁজে যাত্রা করল এবং নিজের বুদ্ধিবলে গুপ্তস্থানে রাণার সন্ধান পেল। রাজসিংহ মাণিকলালকে ছদ্মবেশে মোগল সেনার মধ্যে থাকতে বললেন আর বলে দিলেন সে যেন রাজকুমারীর সঙ্গেই ফেরেন। প্রভুভক্ত মাণিকলাল রাণার জন্য এই দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত হল। মাণিকলাল রূপনগরে এক রসিকা পানওয়ালির খোঁজ পেল এবং তার সাহায্যে এক মুসলমান সেনাকে বন্দী করে তার পোষাক-পরিচ্ছদ নিয়ে মোগল সেনার মধ্যে আত্মগোপন করল।

চতুর্থ খণ্ড : রন্ধ্রে রন্ধ্রে

এই খণ্ডের সাতটি পরিচ্ছেদে মোগল-রাজপুত যুদ্ধ, চঞ্চলকুমারীর উদ্ধার ও মাণিকলাল-নির্মলকুমারীর বিবাহের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পরিচ্ছেদগুলির নাম যথাক্রমে “চঞ্চলের বিদায়”, “নির্মলকুমারীর অগাধ জলে ঝাঁপ”, “রণপণ্ডিত মবারক”, “জয়শীলা চঞ্চলকুমারী”, “হরণ ও অপহরণে দক্ষ মাণিকলাল”, “ফলভোগী রাণা” ও “স্নেহশালিনী পিসী”।

মোগল সৈন্যের সঙ্গে চঞ্চলকুমারী দিল্লির পথে যাত্রা করলেন। তারপর নির্মলকুমারীও স্থির থাকতে না পেরে দিল্লির পথে পদব্রজে রওনা হল। এদিকে পাহাড়ের সংকীর্ণ রন্ধ্রপথে রাজপুত কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে মোগল সেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে মবারক হাল ধরলেন। তাঁর বুদ্ধিবলে যখন অল্পসংখ্যক রাজপুত সৈন্য বিপুল মোগল সেনার দ্বারা অবরুদ্ধ হল, তখন রাজসিংহ যুদ্ধে প্রাণ দেওয়াই স্থির করলেন। কিন্তু চঞ্চলকুমারী দৃঢ়তার সঙ্গে মবারকের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। মবারক রাজকুমারীর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে পথ ছেড়ে দিলেন। এদিকে পথে মাণিকলালের সঙ্গে নির্মলকুমারীর সাক্ষাৎ হল এবং উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। মাণিকলালের কৌশলে মোগল সেনা পলায়ন করল। রাজসিংহ চঞ্চলকুমারীকে নিয়ে উদয়পুরে ফিরলেন। তারপর মাণিকলালের অর্থলোলুপ স্নেহশালিনী পিসির সাহায্যে নির্মলকুমারী ও মাণিকলালের যথাশাস্ত্র বিবাহ সম্পন্ন হল।

পঞ্চম খণ্ড : অগ্নির আয়োজন

পঞ্চম খণ্ডে মোট ছ’টি পরিচ্ছেদ আছে। এগুলির নাম যথাক্রমে “শাহজাদী অপেক্ষা দুঃখী ভাল”, “রাজসিংহের পরাভব”, “অগ্নি জ্বালিবার আয়োজন”, “অগ্নি জ্বালিবার আরও আয়োজন”, “সে প্রয়োজন কি?” ও “আগুন জ্বালিবার প্রস্তাব”। মোগল-রাজপুতের আসন্ন মহাসংঘর্ষের প্রস্তুতিই এই খণ্ডের আলোচ্য বিষয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে মবারক একটি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেলে দরিয়াবিবি তাঁকে উদ্ধার করল। কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার পুনরুজ্জীবনে মবারক দরিয়াকে বিয়ে করে বেশ সুখেই কিছুদিন কাটালেন। শাহজাদির জন্য মবারকের ক্ষোভ রইল না। এদিকে রাজসিংহ মোগলের হাত থেকে চঞ্চলকুমারীকে ছিনিয়ে আনলেও রাজকুমারীর কাছে বাক্‌চাতুর্যে পরাভূত হলেন। চঞ্চলকুমারী রাণাকে তাঁদের বিবাহের পূর্বে পিতামাতার আশীর্বাদ আনাতে বললেন। কিন্তু চঞ্চলকুমারীর পিতা চিঠিতে জানালেন, রাজসিংহের সঙ্গে তিনি কন্যার বিবাহে রাজি নন। তাঁরা যদি বিয়ে করেন তবে তাঁর অভিশাপ লাগবে। তবে যদি কোনোদিন তিনির রাণাকে উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করেন, তাহলেই নিজেই বিয়ে দেবেন। অগত্যা উপস্থিত চঞ্চলকুমারী ও রাজসিংহের বিয়ে হল না। চঞ্চলকুমারী একা আছেন বলে নির্মলকুমারীকে মাণিকলালকে ছেড়ে রাজকুমারীর প্রাসাদে এসে থাকতে হল। চঞ্চলকুমারীর প্রাসাদে আসার পথে এক বিখ্যাত জ্যোতিষীর কাছে গণনা করে নির্মলকুমারী জানতে পারল, যদি সসাগরা পৃথিবীপতির মহিষী এসে কোনোদিন চঞ্চলকুমারীর সেবা করেন, তবে তাঁর বিয়ে হবে। ওদিকে ঔরঙ্গজেব ও রাজসিংহ উভয়েই যুদ্ধের উদ্যোগ করতে লাগলেন।

ষষ্ঠ খণ্ড : অগ্নি উৎপাদন

এই খণ্ডের পরিচ্ছেদ সংখ্যা নয়। এগুলির নাম যথাক্রমে “অরণিকাষ্ঠ—উর্বশী”, “অরণিকাষ্ঠ—পুরুরবা”, “অগ্নিচয়ন”, “সমিধসংগ্রহ—উদিপুরী”, “সমিধসংগ্রহ—স্বয়ং যম”, “পুনশ্চ সমিধসংগ্রহের জন্য”, “সমিধসংগ্রহ—জেব-উন্নিসা”, “সব সমান”, “সমিধসংগ্রহ—দরিয়া”। কীভাবে বিভিন্ন দিক থেকে আগুন জ্বলার প্রস্তুতি চলছল, তারই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এই খণ্ডে।

রাজসিংহ মাণিকলালকে দিয়ে একটি চিঠি পাঠালেন ঔরঙ্গজেবকে। নির্মলকুমারীও চলল দিল্লি, যদি সখীর পরিচর্যার জন্য বাদশাহের পত্নীকে পাওয়া যায় এই আশায়। মাণিকলাল ও নির্মলকুমারী পাথরবিক্রেতার অনেক সরঞ্জাম নিয়ে নানারকম কৌশল করে দিল্লির উদ্দেশ্যে যেতে লাগল। দিল্লিতে নির্মলকুমারী বাদশাহের অন্তঃপুরে যোধপুরী বেগমের কাছে উপস্থিত হল। নির্মলকুমারী উদিপুরীর কাছে গিয়ে তাঁর নেশাচ্ছন্ন মুহূর্তে চঞ্চলকুমারীর চিঠিখানি দিয়ে এল। কিন্তু হারেম থেকে বের হওয়ার সময় ঔরঙ্গজেবের হাতে ধরা পড়ে গেল। ঔরঙ্গজেব নির্মলকুমারীর বুদ্ধিমত্তায় বিস্মিত হলেন। কিন্তু তাকে মুক্তি দিলেন না। যোধপুরী বেগমের মহলে রেখে দিলেন। ছদ্মবেশী মাণিকলালকে নির্মলকুমারী তৈজসপত্রের মধ্যে দিয়ে একটি চিঠি দিল। জেব-উন্নিসা মবারক ও দরিয়ার একত্রে বসবাসের খবরে রেগে বাদশাহের কাছে মবারকের নামে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনলেন। ফলে শাহজাদির রোষে মবারককে সর্পদ্রষ্ট হতে হল। কিন্তু মবারকের মৃত্যুসংবাদ এলে জেব-উন্নিসার আনন্দ হল না, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি বুঝলেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রে সবাই সমান। সাপে-কাটা মবারকের দেহ কবর থেকে তুলে এনে বাঁচানো যায় কিনা, সে চেষ্টা করার জন্য তিনি একজন বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ করলেন। এদিকে মাণিকলাল মবারককে বাঁচিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলল। উন্মাদিনী দরিয়া জেব-উন্নিসার চোখে জল দেখে অট্টহাস্য করে উঠল।

সপ্তম খণ্ড : অগ্নি জ্বলিল

সপ্তম খণ্ডের চারটি পরিচ্ছেদে রাজসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের বন্দী হওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পরিচ্ছেদগুলির নাম যথাক্রমে “দ্বিতীয় Xerxes—দ্বিতীয় Platoes”, “নয়নবহ্নিও বুঝি জ্বলিয়াছিল”, “বাদশাহ বহ্নিচক্রে” ও “অগ্নিচক্র বড় ভীষণ হইল”।

ঔরঙ্গজেব ও রাজসিংহ যুদ্ধের উদ্যোগ করতে লাগলেন। ঔরঙ্গজেব নির্মলকুমারীকে আদর করে ইম্‌লি বেগম বলে ডাকতেন। নির্মলকুমারীর বুদ্ধিমত্তা ও বাক্‌চাতুর্যে বাদশাহ এতই মুগ্ধ যে, তিনি তাকে বেগম পর্যন্ত করতে চাইলেন। কিন্তু নির্মলকুমারী তা প্রত্যাখ্যান করলেন। রাজসিংহ পার্বত্য পথে সেনা-সংস্থাপনের কৌশলে ঔরঙ্গজেবের বিপুল সেনাবাহিনী সহজেই বিপদে পড়ল। রাজসিংহ বেগমদের বন্দিনী করলেন। যে মবারককে মাণিকলাল প্রাণদান করেছিল, তার চেষ্টায় ঔরঙ্গজেব এক রন্ধমধ্যে কিছুসংখ্যক সেনা নিয়ে প্রবেশ করে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন।

অষ্টম খণ্ড : আগুনে কে কে পুড়িল?

অষ্টম খণ্ডে কার ভাগ্যে কী ঘটল তা বর্ণিত হয়েছে। এই খণ্ডের ষোলোটি পরিচ্ছেদের নাম যথাক্রমে “বাদশাহের দহনারম্ভ”, “দাহনে বাদশাহের বড় জ্বালা”, “উদিপুরীর দহনারম্ভ”, “জেব-উন্নিসার দহনারম্ভ”, “অগ্নিতে ইন্ধনক্ষেপ—জ্বালা বাড়িল”, “শাহজাদী ভস্ম হইল”, “দগ্ধ বাদশাহের জলভিক্ষা”, “অগ্নিনির্বাণের পরামর্শ”, “অগ্নিতে জলসেক”, “অগ্নিনির্বাণকালে উদিপুরী ভস্ম”, “অগ্নিকাণ্ডে তৃষিতা চাতকী”, “অগ্নি পুনর্জ্বালিত”, “মবারকের দহনারম্ভ”, “অগ্নির নূতন স্ফুলিঙ্গ”, “মবারক ও দরিয়া ভস্মীভূত” ও “পূর্ণাহুতি—ইষ্টলাভ”।

ঔরঙ্গজেব সংকীর্ণ পার্বত্য পথে বন্দী অবস্থায় ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে যখন শুনলেন যে তাঁর বেগমেরা বন্দী হয়েছেন, তখন রেগে অস্থির হলেন। বন্দী বাদশাহ জ্বালা আর সহ্য করতে না পেরে একমাত্র উপায়স্বরূপ নির্মলকুমারীর শিক্ষিত পায়রাটি উড়িয়ে দিলেন। নির্মলকুমারী উদিপুরীকে চঞ্চলকুমারীর সেবাকার্যে নিযুক্ত করার জন্য জোর করলে গর্বিতা উদিপুরীর অপমানের একশেষ হল। এদিকে রাজসিংহের হাতে বন্দিনী জেব-উন্নিসার হৃদয়ে যখন মবারক-বিরহের তীব্র জ্বালা, তখন তিনি মবারককে সামনে দেখতে পেলেন না। শেষে যখন দেখলেন তখন জেব-উন্নিসার হৃদয়ের জ্বালা আরো বাড়ল। চঞ্চলকুমারী তাঁকে আশ্বাস দিলেন, রাতে মবারকের সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দেবেন। মবারককে পেয়ে শাহজাদির সমস্ত গর্ব ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। তিনি মুক্তি পেলে মবারককে বিবাহ করবেন বলে স্থির করলেন। ওদিকে নির্মলকুমারীর পায়রা ঔরঙ্গজেবের চিঠি নিয়ে এল, তাতে ক্ষুধার্ত বাদশাহ তাঁর ইম্‌লি বেগমের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করেছেন। রাজসিংহ মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সন্ধি করতে রাজি হলেন। জেব-উন্নিসা ও মবারকের বিবাহে যেন ঔরঙ্গজেব রাগ না করেন, সে ব্যবস্থা করার জন্য রাজসিংহ লিখলেন। রাজসিংহ ঔরঙ্গজেবকে মুক্তি দিলেন, কিন্তু উদিপুরীকে রাজকুমারীর তামাক সাজতেই হল। ঔরঙ্গজেব বিদায় হলে নির্মলকুমারী চঞ্চলকুমারীকে বলল পিতাকে চিঠি লেখার জন্য। এবার তাদের বিয়ের তো কোনো বাধা নেই। চঞ্চলকুমারীর পিতা জানালেন, তিনি দু’ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে আসছেন। ঔরঙ্গজেব সন্ধির শর্ত অমান্য করে পুনরায় যুদ্ধের উদ্যম করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে মবারককে হত্যারও একটা ব্যবস্থা করলেন। মবারক জেব-উন্নিসাকে গ্রহণ করলেও দরিয়াকে ভুলতে পারেননি। এমন সময় পাগলি দরিয়াকে দেখে বুঝলেন যে, তাঁকে মরতেই হবে। চঞ্চলকুমারীর পিতা বিক্রম সোলাঙ্কি সেনা সমেত রাজসিংহের সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেন। মবারকের সাহায্যে আবার মোগল সেনা পরাজিত হল। দরিয়ার গুলিতে মবারক মারা গেলেন। শাহজাদি সাধারণ স্ত্রীলোকের মতোই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। যুদ্ধের শেষে চঞ্চলকুমারী ও রাজসিংহের বিবাহ সম্পাদিত হল।

উপসংহার : গ্রন্থকারের নিবেদন

“উপসংহার” অংশে বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস রচনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন এবং রাজসিংহের বীরত্ব সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন।

ঐতিহাসিকতা

জেমস টডের দ্য অ্যানালাস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অফ রাজস্থান গ্রন্থে রূপনগরের এক রাজকুমারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে, রাজসিংহ উপন্যাসের চঞ্চলকুমারী আসলে কিসনগড় রাজ্যের রাজকুমারী চারুমতী। আওরঙ্গজেব চারুমতীকে বিয়ে করতে চাইলে তিনি কুলপুরোহিতকে দিয়ে রাজসিংহের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তবে রাজসিংহের সঙ্গে চারুমতীর বিয়ে হলেও তা নিয়ে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজসিংহের বিরোধ বাধেনি।

চরিত্র : রাজসিংহ

রাণা রাজসিংহ, রাজা রবি বর্মা অঙ্কিত
রাণা রাজসিংহ, রাজা রবি বর্মা অঙ্কিত

রাজসিংহ ঐতিহাসিক চরিত্র। তাঁর নামানুসারেই উপন্যাসটির নামকরণ করা হয়েছে। অশোককুমার কুণ্ডুর মতে, “…তিনি যে নায়ক বলেই তাঁর নামে গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে তা নয়, বঙ্কিমের প্রতিপাদ্য বিষয় যে হিন্দুর বাহুবলের প্রতিষ্ঠা তা রাজসিংহকে কেন্দ্র ক’রেই প্রকাশিত বলে, আদর্শ হিসাবে তাঁর নামানুসারেই গ্রন্থের নামকরণ করেছেন।” তবে রবীন্দ্রনাথ রাজসিংহকে এককভাবে উপন্যাসের নায়ক বলতে রাজি হননি। তাঁর মতে, “ঐতিহাসিক অংশের নায়ক ঔরঙ্গজেব, রাজসিংহ ও বিধাতাপুরুষ।”

রাজসিংহ রাজপুত বীর। তাঁর চরিত্রে বীরত্ব, মহত্ত্ব ও রণকৌশলের সমন্বয় ঘটেছে। এগুলি তাঁর ইতিহাস-সম্মত গুণাবলি। তিনি দেশপ্রেমিক। পরাধীনতার প্রতি তাঁর স্বাভাবিক ঘৃণা। কিন্তু এর বাইরে বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে নিজের কল্পনা দ্বারা রাজসিংহের চরিত্রে নতুন ঘটনা যোগ করেছেন, সেখানেই চরিত্রটি সজীব হয়ে উঠেছে।

চঞ্চলকুমারীর বিপদে রাজসিংহের রূপনগর যাত্রার পিছনে তাঁর বীরত্বের অভিমান এবং শরণাগতের প্রতি কর্তব্যপালনের মনোভাবটি কাজ করেছে। তিনি বয়সে প্রৌঢ়। তাই নতুন নারীর প্রতি আকর্ষণ তাঁর পক্ষে অনিবার্য না হলেও মবারকের সামএন দাঁড়িয়ে চঞ্চলকুমারীর রূপ দেখে সেই সৌন্দর্যের কাছে হার মেনেছিলেন। তারপর রাজসিংহের হৃদয়ে ধীরে ধীরে চঞ্চলকুমারীর স্মৃতি জাগরিত হলেও রাজোচিত ও বয়সোচিত গাম্ভীর্যে তিনি তা দমন করেছেন। চঞ্চলকুমারীর মন পরীক্ষা তাঁর বিচক্ষণতার পরিচায়ক। চঞ্চলকুমারীর পিতার অমতে তাঁকে বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত রাজসিংহের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। কারণ, সেই বিবাহের ফলে রাজপুতানাতেও তাঁর শত্রুবৃদ্ধি ঘটত। চঞ্চলকুমারী ও রাজসিংহের মিলনে বঙ্কিমচন্দ্র প্রেমের চাপল্য দেখাননি। তার কারণ সম্ভবত রাজসিংহের বয়স। তাছাড়া চঞ্চলকুমারী-সংক্রান্ত ঘটনা ছাড়া উপন্যাসে রাজসিংহের সাংসারিক জীবনের আর কোনো ছবি পাওয়া যায় না।

রাজসিংহের অন্যান্য গুণের মধ্যে দয়া ও কৃতজ্ঞতাবোধ অন্যতম। ডাকাত মাণিকলালকে তিনি দয়াপরবশ হয়ে রক্ষা করেছেন, আবার তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে উপযুক্ত মর্যাদাও দিয়েছেন। আবার মবারকের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সঙ্গে জেব-উন্নিসার মিলন নিষ্কণ্টক করতে তৎপর হয়েছেন। যুদ্ধে ছলে-বলে শত্রুকে পরাজিত করা নীতি হলেও, রাজসিংহের নীতি ছিল স্বতন্ত্র। তাই পারিষদবর্গের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ক্ষুধার্ত ঔরঙ্গজেব ও তাঁর সৈন্যদের মুক্তি দিতে দ্বিধা করেননি।

প্রতিক্রিয়া

১৩০০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে (যে মাসে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়) রবীন্দ্রনাথ রাজসিংহ উপন্যাসের চতুর্থ সংস্করণের একটি সমালোচনা লিখে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশ করেন। গবেষক গোপালচন্দ্র রায় মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্র উক্ত সমালোচনাটি দেখেও থাকতে পারেন। পরে সমালোচনাটি রবীন্দ্রনাথের আধুনিক সাহিত্য গ্রন্থে “রাজসিংহ” নামে প্রকাশিত হয়। গবেষক অশোককুমার কুণ্ডুর মতে, রাজসিংহ-এর রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়নটির তুলনায় সার্থক সমালোচনা আজ পর্যন্ত হয়নি। উপন্যাসটির গতি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। চলমান সৈন্যদলের সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন উপন্যাসের কাহিনিকে।

সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মনে করেন শেকসপিয়রীয় তথা ইউরোপীয় ট্র্যাজেডির ধারাটিকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর একাধিক উপন্যাসে পরিস্ফুট করে তুলেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “…‘রাজসিংহে’ সেই য়ুরোপীয় ট্র্যাজেডিই এক নূতন ছন্দে তাঁহার কল্পনাকে পুনরায় আশ্রয় করিয়াছে।…পুরুষবীর মোবারককে প্রবৃত্তির ক্রীড়ানক করিয়া তাহার জীবনেও দৈবের সেই অট্টহাস-কোন অধ্যাত্মনীতি বা ন্যায়নীতি দ্বারা সেই ট্র্যাজেডির অন্ধকার ভেদ করা যায় না।”

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. উইকিপিডিয়ায় ‘রাজসিংহ’ প্রবন্ধ